শাহীন মাহমুদের কবিতা ভাষা ও ভাবনা

72

বিবেকের তাড়নায় কবি তুলে আনেন সে-বিপন্নতার ছবিও। কবির ভাষায়: ‘ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া সেই বখে যাওয়া যক্ষের ধন যার রাত কাটে ইয়াবা আর খঞ্জনের অভিসারে নির্ঘুম অশ্রুপাত-মায়ের অভিসম্পাত কোন পাপ আজ বসেছে সিনায়Ñ।’ (‘নিকষ রাত্রিতে ঘরে ফিরে না কিশোর’, প্রসব্য প্রণয়)। এমন নির্ঘুম রাত কাটানো কবি কখনও বলতে পারেন না ‘আমি কেন রাত ভালোবাসি’। এ কবি তাই রাতকে ভালোবাসেন না; কারণ রাতের নিকষ অন্ধকার ছবি তাঁর চোখে ধরা পড়ে। কেননা তিনি আধুনিক কবি। বর্তমান বাস্তবতার বুকে দাঁড়িয়ে তিনি কাব্যে-গানে গর্বিত হতে চান। সমাজ-রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতাকে এড়িয়ে কেবল শিল্পের জন্য সৃষ্টি করে সুনাম কুড়াতে চান না কবি। কবি তো ‘কবিতার দাস’; সে-কথা তাঁর প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গপত্রেই বলে দিয়েছেন। শুধু কবিতায়-ই নয় ছড়ার স্বরবৃত্ত ছন্দে কবিতা লিখেও শাহীন মাহমুদ দক্ষতার ছাপ আঁকেন। ছড়ার ছন্দে তিনি তাঁর সন্তানদের উপদেশ দেন: ‘টাকা পয়সা সব কিছু নয়/ মানুষ হতে হবে/ ধনী গরীব নেই ব্যবধান/ একি সাথে রবে।’ (‘দুষ্ট বাবুর মিষ্টি ছড়া’, প্রসব্য প্রণয়)। এভাবে শিশুতোষ ছড়ায়ও একটি পরিণত জীবনদর্শন কবি এঁকে দেন।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক কবি শাহীন মাহমুদ জাতির পিতার নির্মম হত্যযজ্ঞের বার্ষিকীতেÑজাতীয় শোকদিবসে কেবল শোকগাঁথা উচ্চারণে থেমে যান না। তিনি বেদনা-বিধুর দিনেও স্বপ্ন বুনেন, আশা জাগানিয়া কাব্যভাষায় লিখেন, ‘তবুও ভরা অমাবস্যায় জোছনা নামে/ ৩২নং বাড়িতে ফোটে হাসনাহেনা/ … আবার ক্যাকটাসে ফোটে ফুল।’ (‘শোকার্ত জাতি পিতার শোকে নতজানু’, প্রসব্য প্রণয়)। এই ফুলেল স্বপ্ন দেখতে গিয়েই স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে-ফেলে আসা পুষ্পিত সময়ের হারানো আনন্দ-বেদনা। তবু, ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল আজো ফোটে/ রিমঝিম বৃষ্টিÑঝাপসা করে দৃষ্টিসীমা-/ কষ্টের অবেলায়’ (‘একজন রেণু ও একটি কদম ফুল’, প্রসব্য প্রণয়)। সতেরো শতকে সন্দ্বীপের কবি আবদুল হাকিম (১৬২০Ñ১৬৯০) বলেছিলেন, ‘আরবি ফারসি শাস্ত্রে নাই কোন রাগ।/ দেশী ভাষে বুঝিতে ললাটে পুরে ভাগ \’ (‘বঙ্গবাণী’, নূরনামা)। আর একুশ শতকের শুরুতে আরেক সন্দ্বীপ-সন্তান শাহীন মাহমুদ শোনান, ‘আমার বর্ণমালা মাগো-শুধুই তুমি/ নয় আরবি, নয় হিন্দি নয় উরদুয়ানি।’ (‘আমার পূর্ব পশ্চিম বাংলা’, প্রসব্য প্রণয়)। মাতৃভাষা আর মাতৃভূমির প্রতি প্রেম থেকে জাত দারুণ দ্রোহের দাবানলে জ্বলেই কবি দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘জেগে উঠুক জনকের স্বপ্নডিঙ্গা মুছে যাক শোণিত রক্তজবার করুণ পংক্তিমালা।’ (‘সন্দীপ্ত অগ্নি’, প্রসব্য প্রণয়)। অথচ বর্তমান বাস্তবতায় তা অনেকটাই অসম্ভব ঠেকে। সামরিক শাসনের করাল স্রোতে সময়ের পরিবর্তনে অনেক কিছুই তখন অবাস্তব-আকাশকুসুম কল্পনা মনে হয় যেন। এমনকি যে ‘জয় বাংলা’
স্লো গানে প্রকম্পিত হয়েছিল উনিশশ’ একাত্তর-আমাদের গর্বের সময়Ñবাঙালির রাষ্ট্রের জন্ম-মুহূর্ত। সেই ¯েøাগান আজ কবিতার শিরোনাম থেকে সরে যায়Ñকবি-সম্পাদকের কলমের খোঁচায়। কেননা, ‘হিন্দুয়ানির ভয়ে কবি পাল্টে দেয় কবিতার শিরোনাম’ (‘জয় বাংলা’, প্রসব্য প্রণয়)। এমন বীজমস্ত্রের গৌরব ভুলবার কারণও কবি সক্ষোভে সামনে নিয়ে আসেন তাঁর দৃঢ়চেতা কাব্যভাষায়: ‘ভুলবেই তোÑতারা সব জানোয়ার রেখে যাওয়া নষ্টের উত্তম বীজ।’ (‘জয় বাংলা’, প্রসব্য প্রণয়)। এমন পরিস্থিতিতেও তিনি প্রকৃতির লীলাভ‚মি এই বাংলার ষড়ঋতুর কাছে-বৈশাখের কাছে আহব্বান জানান নতুন স্বপ্নের সুর তুলতে-‘অভিবাদন নাও প্রিয়তমা বৈশাখ/ ছিন্ন করে দাও পৌরাণিক দেবতার বেড়ী/ বাজাও শঙ্খ নতুন স্বপ্নঠোঁটে।’(‘হে বৈশাখ’, প্রসব্য প্রণয়)। এভাবে নিয়তি বা নিসর্গ-প্রকৃতির কাছে আহব্বান, আকুতি আর অভিবাদন জানিয়ে পূর্ণতা পায় কবির ‘প্রসব্য প্রণয়’।
জেগে ওঠে ফিনি´ পাখি (২০১৭) কাব্যে এসে কবি শাহীন মাহমুদ তাঁর জিজ্ঞাসু কাব্যভাষায় আর তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণী কৌশলে মাতবতার বাণী ফুটিয়ে তোলেছেন। শিল্পঋদ্ধ মনন নিয়ে কবি সাবলীল ভাষায় সৃজন করেছেন তাঁর কবিতার কায়া। প্রায় প্রতিটি কবিতায় কবি এখানে বিচ্ছুরণোন্মুখ। সমকালীন সমাজবোধের তীব্রতা আর তাঁর বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গির প্রখরতায় দ্যোতিত হয়ে ওঠে শেখ হাসিনাকে নিবেদিত কবিতায়। কবি লিখেন, ‘তুমিতো মুজিবের ক্লোন হয়ে জন্মেছো/ এদেশ মুজিবের সোনা মোড়ানো দেশ/ … এদেশ বাঙালির দেশ।’ (‘তুমিতো আগুন বরফের ঔরসে জন্মেছো’, জেগে ওঠে ফিনি´ পাখি)। ধর্মান্ধ-সামরিক ছত্র-ছায়ায় বেড়ে ওঠা এদেশীয় খুনীদের খুঁজে বের করতে কবি কাব্যভাষায় সাধনা করেন আর আহŸান জানান তাঁর পাঠককেও-‘চলুন কাকের ভাষা শিখি, ধরে ফেলি সব গুপ্ত খুনিদের।’ (‘একটি কাক ও মানব সভ্যতার প্রথম খুন’, জেগে ওঠে ফিনি´ পাখি)। অসীম আগ্রহ নিয়ে কবি অধ্যয়ন করে চলেন আমাদের অতীত ঐতিহ্য। কবির ভাষায়: ‘ক্লেদ নগরে শিখি তক্ষশীলার পাঠ।’(‘তক্ষèশীলার পাঠ’, জেগে ওঠে ফিনি´ পাখি)। আমাদের অতীত-অহংকার আর ইতিহাসের অমিত পাঠ শেষে কবি তোলে আনেন জাতির পিতার হত্যকারীদের প্রকৃত পরিচয়: ‘তারা ওই হানাদারদের বংশপরম্পরা,/ বাঙালির খোলসে ভিনদেশি বেজন্মা দাগ।’(‘লায়ালপুর ট্রায়াল’, জেগে ওঠে ফিনি´ পাখি)। বাস্তব বাংলাদেশের এই বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতেও কবি তাঁর কাব্যভাষায় কেবল দ্রোহে ফেটে পড়েননি। সমকালীন অনেক বাঙালি কবির মতো কল্পনার মায়াজাল রচনাতে মগ্ন হননি, তিনি পুনর্জাগরণ প্রত্যাশা করেন কবিতায়-‘ফিনিক্স কল্পনায় ভেসে চলি আগুন পাখি হয়ে/ জেগে উঠতে আকুল;’(‘জেগে ওঠে ফিনি´ পাখি’, জেগে ওঠে ফিনি´ পাখি)। এই কাব্যে কবি নিজেকে ‘অতি সাধারণ বাঙালি এক ক্ষুদ্র কবি’ (‘অঞ্জলি লহ মোর কবি নজরুল’, জেগে ওঠে ফিনি´ পাখি) বলে অভিহিত করলেও কাব্য-কুশলতা নৈপুণ্যে তিনি দক্ষতার পরিচয় দেন। নিজস্ব নতুন এক কাব্যভাষা নির্মাণেও তাঁর অবস্থান বেশ দৃঢ়তা লাভ করে এই কাব্যে এসে।
হৃদ্যা আমিও জেগে আছি (২০১৮) কাব্যগ্রন্থে এসে কবি সমকালীনতার পঙ্কিল-পিচ্ছিল মাটিতে দাঁড়িয়ে থেকেও যেনো কল্পনার ডানা মেলে দেন শরৎ আকাশের শুভ্র মেঘের রাজ্যে। তবু বলতে হয় যে, তিনি সমকালের চিত্রকে রূপায়িত করেন কবিতায়। সাহিত্য অন্তপ্রাণ শাহীন মাহমুদ-এর এই সময়ে কবিতার দিকে গভীর মনোনিবেশ লক্ষ্য করে এ কাব্যের সমকালীন সমালোচককেরও মনে হয়েছে যে, এ মুহূর্তে কবিতাই তাঁর একমাত্র আরাধ্য বস্তু (চৌধুরী, ২০১৮)। সমকালীন সমাজ-সমস্যাকে পাশকাটিয়ে তথাকথিত সুশীল-বুদ্ধিজীবীগণের টকশোর নামে টাউট-বাটপাড়ি কবিকে প্রশ্নাকুল করে তোলে। তাই কবিতা দিয়ে কবি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন-‘নির্বোধ জিব আর মগজের কাকতাড়ুয়া/ অসাড় জিব নিয়ে বাঁচো কীভাবে?’(‘ডালিম সমাচার’, হৃদ্যা আমিও জেগে আছি)। এর কারণও কবি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন তাঁর চিত্রময় কাব্যভাষায়: ‘টগবগে তরুণ খাচ্ছে চোলাই মদ মউদুদিনামা,/ আয়না পড়ায় দেখছে বেহেস্তের পুষ্পিত ময়দান।’ (‘পুড়ছে মালাউনের ঘর’, হৃদ্যা আমিও জেগে আছি)। এমন যখন প্রতিবেশ তখন কবির কবিতায় প্রতিধ্বনিত হয়Ñ‘হলি আর্টিজান থেকে নাসির নগর’-সমগ্র বাংলাদেশের যেখানে-সেখানে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসে সন্ত্রস্ত সমাজের হাহাকার। বাঙালির বিপন্ন মানবতার মলিন মর্মযাতনাকে তিনি কবিতায় ধারণ করেন। তাঁর কবিতার পঙক্তি হয়ে উঠে আসে আমাদের জাতির জনকের অনবদ্য অবদান আর তাঁর হত্যাকারীদের প্রতি ধিক্কারের ধনুর্বাণ। শাহীন মাহমুদের কাব্যভাষায় অতি অল্প কথায় চিত্রপটের মতো স্পষ্ট ভেসে ওঠে-‘ঐ পুঁজিবাদ আজও রক্ত চায়। ঐ জাগ্রত সাম্রাজ্য এখনও/ পানির দামে কিনতে চায় মানবতা, অলৌকিক শ্রমঘণ্টা।’ (‘হেনরির হাতুড়ি’, হৃদ্যা আমিও জেগে আছি)। বাংলাদেশের আদিবাসী নারীর বেদনার-ভালোবাসার চিত্রও আঁকেন কবি আদিবাসী ভাষাকে নিজের কাব্যভাষায় নিপুণতার সাথে ঠাঁই দিয়ে। তাঁর কাব্যের আদিবাসী তাই প্রশ্ন রাখে, ‘পিরিতি বাড়াইলা কেনে?’ (‘স্বারতী উঁরাও’, হৃদ্যা আমিও জেগে আছি)। এভাবে দ্রোহ-দারুণ বেদনা আর সমকালের সাথে জড়িয়ে যায় কবির প্রেমের-ভালোবাসার রূপক-চিত্রকল্পগুলি। তাঁর কবিতার ভাষা যেমন প্রতিবাদমুখর, তেমনি জনগণের জয়গানেও মুখরিত অনুক্ষণ। আর সব মিলে স্বদেশের সাথে আধুনিক জীবনের নানান অনুসঙ্গ তাঁর কবিতায় এসে ধরা দেয় পার্থিব-মানবিক প্রেমের টানে। এই প্রেমই তাঁর কাব্য-পাঠককে মুগ্ধ করে রাখে, কবিকে দেয় পাঠকপ্রিয়তার মুকুট।
হেম ও তস্করের পদাবলি (২০১৯) কাব্যগ্রন্থে কবি শাহীন মাহমুদ তাঁর স্বভাবজাত নতুন শব্দের সমাবেশ ঘটিয়ে স্বকীয় কাব্যভাষা সৃষ্টিতে সম্যকরূপে সক্রিয় হয়েছেন। তাঁর কাব্যভাষার মায়াবী মন্ত্রমুগ্ধতা আর নন্দনতত্তে¡র সম্মোহনী স্ফ‚রণ পাঠকে বিস্মিত-বিমুগ্ধ করে তোলে। কাব্যগ্রন্থের শুরুতেই দেখা যায়, কবি প্রচলিত পথে নয়- সমকালের প্রায় সবার বিপরীতে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের বীরাঙ্গনার কথা বলতে শুরু করেন এভাবে, ‘এবার তবে নাহয় উল্টো থেকে লিখ রমানামা, তাঁর কিশোরীকাল/ দুরন্ত যৌবনে হায়েনাদের তাড়া খাওয়া উপোসকালের দিনগুলির কথা।’ (‘দুটি রুগ্ন পা ও পাদুকার গল্প’, হেম ও তস্করের পদাবলি)। কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গও করেন একাত্তরের জননী রমা চৌধুরীকে। বাস্তবের বাতাসে কবি উনিশশ’ ছেয়ট্টির ছয়দফাকে দুলতে দেখেন আর উপলব্ধি করেন যে, ছয়দফার ফসল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়। তাইতো তাঁর কাব্যভাষায় তোলে ধরেন-‘আকাশে বাতাসে আজও দোল খায় সেই ছয়টি পাপড়ি/ ফোটে আছে বিজয় ফুল সাতটি পাপড়ি নিয়ে।’ (‘বিজয় ফুল’, হেম ও তস্করের পদাবলি)। এই বাস্তবতার মধ্যেই অবলীলায় প্রবেশ করে অতিবাস্তব আখ্যান; সেখানে, ‘মায়ের বাসন মাজার শব্দ অলৌকিক দেয়াল ঘড়ি’। বাস্তব আর অতিবাস্তব মিলেমিশে এক মায়াময় আবেশ সৃষ্টি হয় কবি যখন লিখেন, ‘ঘুমঘরে দেখি দৌড়ে পালায় যাপিত জীবন/ অনন্ত কাল; এক ভয়ংকর কালো বিড়াল।’ (‘অলৌকিক দেয়াল ঘড়ি’, হেম ও তস্করের পদাবলি)। এভাবে অধিবাস্তববাদের সাথে মিশে বিভিন্ন মতবাদ। তবে মানবিক প্রেমের রসায়নে সব মিলে এক অভিনতুন কাব্যভাষা গড়ে ওঠে, কবি যখন লিখেন, ‘দৈতবাদের ঘোরে অমাবস্যা নামে/ নির্ঘুম চলে ঘাস আর শিশিরের/ ফোটা ফোটা প্রেম।’ (‘আরশি নগর’, হেম ও তস্করের পদাবলি)। এই মানবিক প্রেম আবার আচমকা তাঁকে বাস্তব-জমিনে নামিয়ে আনে।
সেখানকার প্রতিবেশে কবি অবলোকন করেন কিছু ঊনমানুষ আর কর্পোরটে কারবারিদের ক‚টকৌশল। সে দৃশ্য কবিকে ভাবিয়ে তোলে, তাই তিনি লিখেন, ‘একবারও ভাবলে না কর্পোরেট বেশ্যার মতো দাঁড়িয়ে/ ডামট্রাক, কাভার ভ্যান, কিছু ঊনমানুষ রাস্তার দুধার/ ফুটপাতে চাঁদাবাজ প্রহরী।’ (‘এক নিঃস্পৃহ বৈরাগী’, হেম ও তস্করের পদাবলি)। সাধারণ অবলোকনে আমরা যাকে উন্নয়নের সহায়ক দেখি, কবি গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে সেখানে দেখতে পান পুঁজিবাদী কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের কালো হাত। আর তাই তাঁর কাব্যভাষাতেও ‘ডামট্রাক’, ‘কাভার ভ্যান’ ইত্যাদি শব্দ সেই আধিপত্যবাদীদের প্রতীকরূপে প্রতীয়মান হয়। কবি আপন জন্মভ‚মিতে ওমোন উপদ্রব আশা করেন না। কেননা তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, ‘এদেশ মুজিবের সোনা মোড়ানো দেশ/ … এ দেশ বাঙালির দেশ।’ (‘মাদার অব হিউমিনিটি’, হেম ও তস্করের পদাবলি)। শেখ হাসিনাকে নিবেদিত এই কবিতায় কবি তাই মানবতার মা অভিধা দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অভয় বাণী শোনান। আর শেখ মুজিবের চিন্তা-চেতনা ধারণ করে, সেসব বাস্তবায়নে অগ্রসর হবার আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করেন। এভাবে কবি তাঁর পাঠককে এক সুন্দর আগামীর স্বপ্নও দেখান। কবি নিজে স্বপ্ন দেখেন বলেই পাঠককে স্বপ্ন দেখাতে পারেন। তাইতো কবি তাঁর আত্মপরিচয় দিয়ে লিখেন, ‘আমিতো স্বপ্নবাজ সীমাহীন আকাশ/ রুপোর কাঠিতে ভাঙাই মেঘফুলের ঘুম/ আমিতো তীর ভাঙা ঢেউ’(‘ব্লিডিং হার্ট’, হেম ও তস্করের পদাবলি)। কিন্তু স্বপ্নের আকাশে কবি উড়ে চলেন না তাঁর পা রয়ে যায় এই পৃথিবীর প্রতিবেশে তাই পরক্ষণেই তিনি বলেন, ‘হেমন্ত অরণ্যে আমি মরকুটে বাকল বিষণœ এক অন্তর্দেশ’ (‘হেম ও তস্করের পদাবলি’, হেম ও তস্করের পদাবলি)। এভাবে সমকালীন বাস্তবতাকে বুকে ধারণ করে কবি বিষণ্ণতাকে বিতাড়িত করে এগিয়ে যান এক শৈল্পিক ও কাল্পনিক এক নন্দনকাননের অভিমুখে। ‘মানুষের সবচেয়ে বড় ক্ষমতা বুদ্ধি নয়, হৃদয় নয়Ñকল্পনা। কবিতা এতো শক্তিশালী হয়ে ওঠে এ জন্যেই যে কল্পনা তার পেছনে সবচেয়ে উজ্জ্বলভাবে কাজ করে যায়’ (আবদুল মান্নান, ১৯৮৭: ৯)। কবি শাহীন মাহমুদের কবিতা সেই কল্পনা আর স্বপ্নকে নিয়েই শক্তিশালী। আর তাঁর সহৃদয় পাঠক মাত্রেই অনুভব করেন এক নতুন মোহনীয় কাব্যভাষা শুনে প্রেমময় কল্পজগতের পথে অভিযাত্রার অভিজ্ঞতা। এই নতুন কাব্যভাষা নির্মাণের প্রয়াস নিসন্দেহে কবি শাহীন মাহমুদের কবিতার অন্যতম বিশিষ্টতা।
শাহীন মাহমুদের কবিতায় সমকালীন ভাবনা ও নন্দন তত্তে¡র এক সম্মোহনী খেলা তাঁর কাব্যপাঠককে মুগ্ধ করে। সমকাল আর প্রতিবেশকে তিনি পান্ডিত্য দিয়ে নয়-কবির নান্দনিক দৃষ্টিতে চয়ন করে তাঁর স্বকীয় ভাষাশেলী দিয়ে উপস্থাপন করেন কবিতায়। বিষয়টি আরেকটু স্পষ্ট করবার জন্যে কালিদাসের আমলের একটি ঘটনা বলি: সে আমলে রাজা বিক্রমাদিত্য তার সামনে একটি কাঠের টুকরো রেখে এ সম্পর্কে কিছু বলতে বললে রাজ-পন্ডিত বললেন, ‘শুষ্কং কাষ্ঠং তিষ্ঠং অগ্রে’, অর্থাৎ আগে একটি শুকনো কাঠ আছে। আর কালিদাস বললেন, ‘নীরস তরুবর সম্মুখভাগে’, অর্থাৎ, সামনের দিকে একটি নীরস গাছ। শাহীন মাহমুদের কবিত্বও তেমনি প্রতিবেশের কাঠ দেখে তিনি তাঁর পাঠকে গাছের কল্পনায় নিয়ে যান তাঁর কাব্যপ্রতিভা দিয়ে। নীরস-নির্জীব সময়ের চিত্র আঁকতে আঁকতে কবি তাঁর সরস ভাষার শৈল্পিক বিন্যাসে পাঠকে উপহার দেন এক স্নিগ্ধ আলোকিত সকালের স্বপ্ন। এভাবেই কবি সমকালীন বাংলা কাব্যজগতে শব্দ প্রয়োগ, বাক্য-বিন্যাস, নতুন নতুন শব্দের গাঁথুনিতে গড়ে তোলেছেন এক স্বকীয় কাব্যভাষা যা তাঁর একান্ত নি-ভাষা বা ব্যক্তিভাষা। এমন ভাষা ও ভাবনা নিয়ে কবি শাহীন মাহমুদ বাঙালি কাব্যপ্রেমীদের আরও নতুন নতুন উপহারে উল্লসিত করবেন। আর তাঁর কবিতার অনুবাদ প্রকাশিত হলে বাংলা সাহিত্য বিশ্বদরবারে আরও মর্যাদা লাভে সক্ষম হবে।