মুশফিক হোসাইন
গত সপ্তাহে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর, চট্টগ্রামের সক্ষমতা বাড়ানোর কথা লিখেছিলাম। যেদিন লেখাটি ছাপা হলো সেদিনই ঘটনা ক্রমে ঢাকা যেতে হলো। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর, যাতে সর্বাধিক বিমান চলাচল করে। ঢাকা দেশের রাজধানী। স্বাভাবিকভাবে বিমান চলাচলের হার এই বিমান বন্দরে বেশি হবে। এটাই স্বাভাবিক। ঢাকা বিমান বন্দর এক সময় তেজগাওয়ে ছিল। স্বাধীনতার পর তা বর্তমান লোকেশনে আনা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিদেশ থেকে সম্মানিত অতিথি যেমন বেশি আসছেন। তেমনি বিদেশে বাংলাদেশিদের ভ্রমণও কর্মসংস্থান বেড়েছে। দৈনিক ফ্লাইট অপারেটর সংখ্যাও বহুগুণ বেড়েছে। প্রশ্ন হলো দেশের প্রদান বিমান বন্দরের মান কি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের? তার সক্ষমতা কি বেড়েছে? চোখ বন্ধ করে বলা যাবে-না। এই বিমান বন্দরের নামকরণ নিয়ে একই অবস্থা। বিএনপি নাম রেখেছিল, জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে চট্টগ্রামের এমএ হান্নান বিমান বন্দরের নাম বদলের প্রতিশোধ নিয়ে ঢাকার জিয়া আন্তর্জাতিক বন্দরের নামকরণ করে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। নামে কী আসে যায়? যতদূর জানা যায় গতবছর গোয়েন্দা সংস্থা, সিভিল এভিয়েশন এবং ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা সমন্বয়ে একটি দল শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে জরিপ চালায়। তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের কাছে ওই জরিপের প্রতিবেদন জমা দেয়। গত বছরের এপ্রিল মাসে একই ধরনের আরও একটি জরিপ চালানো হয়েছিল। ওই জরিপে যেসব সুপারিশ করা হয়েছিল, তার সামান্যতম অংশ বাস্তবায়ন করা হয়েছে বলে সর্বশেষ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে আছে বলে জরিপ দলটি উল্লেখ করে।
ঢাকার জাতীয় দৈনিক পত্রিকা দ্য ডেইলি স্টার সর্বশেষ জরিপ প্রতিবেদনের একটি অনুলিপি পেয়েছে বলে জানা যায়। যাতে বিমানবন্দরটি নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে, নিরাপত্তাজনিত কারণে এতে সমস্যাগুলো নিয়ে বিস্তারিত তথ্য উল্লেখ করা হয়নি।
তাদের তথ্য থেকে জানা যায় যে, কার্গো ও রপ্তানি এলাকায় অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জামের ঘাটতি আছে। তাই এ অঞ্চলগুলো ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত হয়। এছাড়া বিমান বন্দরের খুব কাছেই অনেক উঁচু উঁচু ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। আশপাশে বেশকিছু আবাসিক এলাকা সরকার অনুমোদন দিয়েছে। এ কারণেও বিমান বন্দরের নিরাপত্তা হুমকীর মুখে পড়েছে। আগের জরিপেও এ বিষয়টি উল্লেখ করা হলে, কোন ব্যবস্থা বা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি বলে সর্বশেষ প্রতিবেদনে তা বলা হয়েছে।
এছাড়া বিমান বন্দরের প্রবেশকারী যানবাহন নিচ থেকে স্ক্যান করার জন্য চারটি গেটে ক্যামেরা বসানোর জোরালো সুপারিশ করা হয়েছে। জরিপ দলটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করে যে ২০১২ সালে বাউনিয়া বেড়িবাঁধে মানুষ চলাচল বন্ধ করতে একটি আন্ডারপাশ বা সুরঙ্গ নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছিল। যা জরিপ চলাচলকালীন সময়েও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, রানওয়ে ১৪ থেকে বিমান ওঠা-নামা দেখতে প্রচুর মানুষ বাউনিয়া অঞ্চলে ভিড় করেন। এমন কি রাতে সেখানে কিছু লেজার লাইট ব্যবহার করা হয়। যা চালক, উড়োজাহাজ ও বিমান বন্দরের নিরাপত্তার জন্য হুমকী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় বিমান বন্দরের এ অঞ্চলটিতে আলোক স্বল্পতা রয়েছে। কারণ ৫৭টি ফ্লাড লাইটের আলো বিমান বন্দরের ১ হাজার ২৯৮ জায়গার সব কোণায় পৌঁছায় না। এছাড়া এখানে সিসিটিভির কভারেজ ও আশানুরূপ নয়। কিছু কিছু সিসিটিভি ক্যামেরা রাতে ভালোভাবে কাজ করে না বলে জানানো হয়েছে। প্রতিবেদনে কিছু এলাকায় নাইট-ভিশন সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন এবং সেগুলো কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণের সুপারিশ করা হয়েছে। বিমানবন্দরের ভেতরে অনেক ঝোপ আছে, যা নিরাপত্তা কর্মীদের দৃষ্টিসীমায় বাধা তৈরি করে। এগুলো নির্দিষ্ট সময় অন্তর ছাঁটাইয়ের সুপারিশ করা হয়েছে।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী দ্যা ডেইলী স্টারকে বলেন; এই পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে এবং বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বাড়াতে অনেক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা দায়িত্ব পালনে কোন ধরনের অবহেলা সহ্য করবো না’। বিমান বন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে কোন ছাড় দেয়া হবে না।’ বাংলাদেশ পাইলট এসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জানান, কাজের অগ্রগতি আপাতত কম হলেও বিমান বন্দরের সম্প্রসারণ কাজ চলছে। আশা করা যায় শিগগিরই এ অবস্থার উন্নতি হবে। তবে তিনি বলেন, লেজারগুলো খুব বিপদজ্জনক। পাইলটরা কাছাকাছি এসে এগুলোর কারণে ঠিকমতো দেখতে পান না। এজন্য জনসচেতনতা বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই।
এ হলো বিমান বন্দরের কৌশলগত সক্ষমতার বিষয়। যে বিষয় নিয়ে আলোচনার অবতারণা করলাম। তা হলো বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি সম্প্রতি লন্ডন ও তুরস্ক সফরে গিয়েছিলেন। তিনি গত সাতই মার্চ দেশে ফেরেন। আমরা ফ্লাইটটি ছিল একইদিনে। সময় মতো বিমান বন্দরে পৌঁছে জানতে পারি ফ্লাইট একঘণ্টা ডিলে। কারণ জানতে চাইলে কর্তৃপক্ষ জানান, মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিদেশ সফর শেষে দেশে আসছেন, তিনি আসার পর সব ফ্লাইট অপারেট শুরু হবে। তার ভাষায় বিমান বন্দরে আসা-যাওয়ার সব ফ্লাইট এ কারণে স্থগিত করা হয়েছে। জানতে চাইলাম ফ্লাইট ডিলে জেনেও কেন বোর্ডিং কার্ড ইস্যু করা হলো। এছাড়া আমাদের বহির্গমন টার্মিনালে যেতেও বলা হয়েছিল। ভদ্রলোক আমতা আমতা করে বললেন, আজ সকালে, দুপুরে এবং বিকেল নিয়ে এই তিনবার এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। ফলে সকল ফ্লাইট বিলম্বে যাত্রা করবে। আমি জানালাম, প্রথম আলো পত্রিকায় দেখলাম রাষ্ট্রপতি বিকাল ৪.৩০মি ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছার কথা। আর আপনি বলছে আজ দিনে তিনবার বিমান অপারেশন বন্ধ করা হয়। প্রশ্ন হলো শাহজালাল দেশের প্রধান বিমানবন্দর। রাষ্ট্রপতি সেখানে অবতরণ করতেই পারেন। ঢাকা রাজধানী, তিনি সেখানে অবশ্যই আসবেন। কিন্তু তাই বলে ঢাকা বিমান বন্দরে সাথে সংশ্লিষ্ট সকল বিমান চলাচল বন্ধ করার কোন যুক্তি নেই। নাগরিকদের অনেকেই দেশের বাইরে কাজে যোগদান, বা অন্যকোন প্রয়োজন থাকতে পারে। এতে প্রমাণ করে ঢাকা বিমানবন্দরের সক্ষমতা অপটিমাম নয়। রাষ্ট্রপতি ভিভিআইপি ব্যক্তিত্ব। তার যোগ্য সমমান অবশ্যই দিতে হবে।
ঢাকা বিমানবন্দর রাজধানী সংশ্লিষ্ট বলে এখানে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বা বিশেষ ব্যক্তিত্বের আবাসন ঘটতে পারে। এটাই স্বাভাবিক। সেজন্য দেশের প্রধান বিমানবন্দর শাহজালাল বিমান বন্দরের জন্য একটি জরুরি রানওয়ে/বিমান অবতরণ কেন্দ্র জরুরি। যাতে করে দেশের সাথে ঢাকা বিমানবন্দরের সংযোগ বিচ্ছিন্ন না হয়। এমনও হতে পারে অনেক সংকটাপন্ন ব্যক্তি/রোগী বিমান চলাচল বন্ধের কারণে মৃত্যুর মুখে পড়তে পারেন। রাষ্ট্রপতি, অতিথি, প্রধানমন্ত্রী যাঁরা বিশেষ সুবিধার দাবি রাখেন, তারা যেন নিরাপদে যাত্রা বা প্রত্যাবর্তন করতে সক্ষম হয়, সেজন্য সম্ভব হলে দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিমানবন্দরে আলাদা চ্যানেল গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
বর্তমান সময়ে মানুষের আয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া ভ্রমন করতে বিশ্বে বিমানের গুরুত্ব বাড়তো সে বিবেচনায় বিমানবন্দরগুলোর নিরাপত্তা ও সক্ষমতা বাড়ানোর গুরুত্ব অপরিসীম। বিমানবন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জড়িত। হালে রপ্তানি এবং আমদানি বিমানকেন্দ্রিক হচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য দেশে আরও বিমান বন্দর প্রতিষ্ঠা ও সাথে সাথে বন্দরের নিরাপত্তা ও সক্ষমতা বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই।
লেখক: কবি, নিসর্গী ও ব্যাংক নির্বাহী (অব.)