শান্তি চুক্তির হাত ধরেই শান্তি আসুক পাহাড়ে

12

 

পার্বত্য জেলাবাসী গত ২ ডিসেম্বর ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে উদযাপন করেছে পার্বত্য শান্তিচুক্তির দুই যুগপূর্তি। ১৯৯৭ সালের এ দিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত আগ্রহ ও সদিচ্ছায় পার্বত্য জেলায় সংঘাত ও অশান্তি দূর করার লক্ষ্যে জনসংহতি সমিতির সাথে এ চুক্তি করা হয়। এ দিনটি পার্বত্য জেলাবাসীদের জন্য নতুন ইতিহাস সৃষ্টির দিন। আনন্দের দিন। সেদিন বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি ছিল এ চুক্তির প্রতি। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, এ চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য জেলায় তাৎক্ষণিক শান্তির পায়রা উড়েছিল। এ অঞ্চলে আর্থ-সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়েছে। শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রসার ঘটেছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও বাঙালিদের মাঝে পরস্পর সহমর্মিতা ও সম্প্রীতি আগের যেকোন সময়ের চেয়ে দৃঢ় হয়েছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী আঞ্চলিক সংগঠনসমূহের কিছু সন্ত্রাসী ও উগ্রবাদী লোকের কারণে দীর্ঘদিন এ অঞ্চলে সংঘাতময় পরিস্থিতি বিরাজ করলেও এখন কিন্তু তা নেই, তবে আঞ্চলিক সংগঠনসমুহের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মাঝেমধ্যে ব্যাপক রক্তক্ষয়ী সংঘাত বা গুপ্ত হত্যার মত ঘটনা ঘটছে, যা শান্তি চুক্তিকে অনেকটা চ্যালেঞ্জের মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর এ পর্যন্ত ২৪ বছরে পাহাড়ে সশস্ত্র চার গ্রæপের হাতে ৯ শতাধিক পার্বত্যবাসী ও পর্যটক খুন হয় এবং ১৫শ গুম হয়েছে। গুম বা অপহরণ হওয়াদের মধ্যে ৬০ ভাগ মুক্তিপণের টাকা দিয়ে জীবন রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। এ অশান্তির মধ্যে চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে রয়েছে অনুযোগ ও অসন্তোষ। চুক্তির শর্তেও অধিকাংশই বাস্তবায়ন হয়েছে সরকার দাবি করলেও জনসংহতি সমিতির অভিযোগ মূল ধারাগুলোর বাস্তবায়ন করা হয়নি। অন্যদিকে চুক্তিবিরোধী যে পক্ষটি ১৯৯৭ সালে চুক্তির বিরোধিকায় নেমে ছিল তারা এখনো সক্রিয়। পার্বত্যবাসীর হতাশা- ক্ষোভের সুযোগ নিয়ে অশান্তি সৃষ্টিতে তৎপর এই মহল। প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে, চুক্তির যেসব শর্ত এখনও বাস্তবায়ন হয়নি, সরকারের উচিৎ আলাপ আলোচনার মদ্যে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া। অন্যথায় সাধারণ পাহাড়ি জনগণের হতাশা বাড়বে, অসন্তোষ দানা বাঁধবে। বলাবাহুল্য যে, পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন সামরিক-রাজনৈতিক সরকার উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের নামে সমতলভূমি থেকে বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানান্তর করে। এ ঘটনা পার্বত্য জনজীবনে নতুন সংকটের জন্ম দেয়। এতে পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের মনে সন্দেহ, অবিশ্বাস, অনাস্থা ও ক্ষোভের সঞ্চার হয়, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে সশস্ত্র তৎপরতার মধ্য দিয়ে। সে সময় পার্বত্য জনপদে সশস্ত্র সংঘর্ষ, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, গুপ্তহত্যা এসব ছিল নিত্যদিনের খবর। সে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির অবসান ঘটিয়ে শান্তির পথে আসা সম্ভব হয়েছিল ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে স্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তির মাধ্যমে। এই চুক্তির আওতায় সে সময়কার বিচ্ছিন্নতাবাদী শান্তি বাহিনীর ২ হাজার সশস্ত্র কর্মী অস্ত্র সমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। অবসান ঘটে অব্যাহত রক্তপাতের। উল্লেখ্য, দীর্ঘদিন ধরে চলা সংঘাতময় পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তির এ ঘটনা সমকালীন বিশ্ব পটভূমিতে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। তখনকার সরকারেরও এটি বড় অর্জন। সে দিন এ চুক্তি স্বাক্ষর না হলে আজকের পরিস্থিতি কী হতো তা কল্পনা করাও কঠিন। কিন্তু বর্তমান যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে পাহাড়ে পূর্ণ শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা বলা যাবে না। এখানে সশস্ত্র গ্রুপের মধ্যে চলছে অস্ত্রের মহড়া। চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে এই চার গ্রæপ নিজেদের মধ্যে খুনখারাবি করছে। যে কারণে গত দুই দশকে চার গ্রুপ নিজেদের সংঘর্ষে জড়িয়ে এ পর্যন্ত ৯ শতাধিক নেতাকর্মী, তাদের সমর্থক ও সাধারণ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। পার্বত্য সমস্যার মূলে রয়েছে এ অঞ্চলে ভূমি নিয়ে বিরোধ। ভূমি কমিশন গঠন করে এ বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়া হলেও এ কাজে তেমন অগ্রগতি নেই। এ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভূমি সমস্যার একটি ন্যায়সঙ্গত সমাধান জরুরি। এটা সত্য যে, এ ধরনের চুক্তি বাস্তবায়নে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বিষয়। তবে ২৪ বছর কম সময় নয়। আমরা চাই, সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে আরো তৎপর হবে, অন্যদিকে পার্বত্যবাসীও ধৈর্যশীল থাকবেন। সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনাও জরুরি। চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি পাহাড়ি সংগঠনসমূহের নেতাকর্মীদের কার্যকর সহযোগিতা দরকার।