শান্তিচুক্তির ২৫ বছর পূর্তি আজ

31

এম. কামাল উদ্দিন, রাঙামাটি ও শাফায়েত হোসেন, বান্দরবান

পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির ২৫ বছর পূর্তি হচ্ছে আজ। এই উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে তিন পার্বত্যজেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এরমধ্যে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি রাঙামাটিসহ তিন পার্বত্য জেলায় গণসমাবেশ ও র‌্যালির আয়োজন করেছে। রাঙামাটিতে সকাল ১০ টায় কুমার সমিত রায় জিমনেসিয়াম চত্ত¡রে গণসমাবেশ করবে জনসংহতি সমিতির জেলা কমিটি। এছাড়া আলোচনা সভার আয়োজন করেছে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং জেলা আওয়ামী লীগ। এ উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী।
এদিকে পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে নানান বাঁধার কথা উল্লেখ করে পক্ষে-বিপক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন একাধিক সংগঠন ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। এরমধ্যে সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও রাঙামাটির সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার এমপি বলেন, সরকার শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে অত্যন্ত আন্তরিক। আপনার ইতোমধ্যে অবগত হয়েছেন শান্তি চুক্তির বেশীর ভাগ চুক্তিই বাস্তবায়িত হয়েছে। বাকি চুক্তির কিছু অংশ বাস্তবায়নও প্রক্রিয়াধীন। পাহাড়ের সকল উন্নয়নে প্রধানতম বাঁধা অবৈধ অস্ত্র ও চাঁদাবাজি। বর্তমান সরকার পাহাড়ে উন্নয়নে অত্যন্ত আন্তরিক। চুক্তি অনুযায়ী পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্র থাকার কথা না। তারপরও জেএসএস ও ইউপিডিএফসহ বাকি আঞ্চলিক সংগঠনগুলো নিয়মিত চাঁদাবাজি করে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, চুক্তি বাস্তবায়নে জেএসএস সরকারকে আন্তরিকতার সাথে সহযোগিতা করছে না। যার কারণে চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে কালক্ষেপন হচ্ছে। একদিকে তারা চুক্তি বাস্তবায়নের কথা বলছে; অন্য দিকে পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্র দিয়ে চাঁদাবাজি করছে। একদিকে তারা চুক্তির কথা বলছে অপরদিকে অস্ত্র দিয়ে সাধারণ মানুষ মারছেন। আমরা বার বার পাহাড়ের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়ে আসছি। চুক্তির ২৫ বছরেও পাহাড় থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হচ্ছে না।
এই সংসদ সদস্য পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে সেনাবাহিনী-র‌্যাব’র যৌথ অভিযানের মাধ্যমে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে সরকারের প্রতি আহবান জানান।
অন্যদিকে সাবেক সংসদ সদস্য ও এম এন লারমা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের সভাপতি উষাতন তালুকদার বলেন, শান্তি হয়েছে দু’টি পক্ষের মধ্যে। একটি পক্ষ হলো বর্তমান সরকার অপর পক্ষ হলো জনসংহতি সমিতি। তাই চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে কথা হবে এই দু’পক্ষের মধ্যে। এখন দেখছি শান্তি চুক্তি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের লোকজন বেহুদা কথাবার্তা বলছে। এতে করে কার কি লাভ তা আমার বোধগম্য নয়। চুক্তির শর্ত মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামে অফিস-আদালত, চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, নিয়োগ, ভ‚মি ব্যবস্থাপনাসহ সব কিছুই আঞ্চলিক পরিষদের হাত দিয়ে বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা দেখছি তার বিপরীত।
রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মুছা মাতব্বর বলেন, পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া। চুক্তির ৭২টি শর্তের মধ্যে ৪৮টি বাস্তবায়িত হয়েছে- তার মানে বলা যায়, ইতোমধ্যে শান্তি চুক্তির ৭৫ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়ে গেছে। বাকি ধারাগুলো বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় আছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এ সরকারই শান্তিচুক্তির পুরোপুরি বাস্তবায়ন করবে। পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বাঁধাগ্রস্ত করছে পাহাড়ে অবস্থান নেওয়া অবৈধ অস্ত্রধারীরা। পাহাড় থেকে সব অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার হলে অচিরেই পার্বত্য শান্তি চুক্তির পূর্ণবাস্তবায়ন সহজ হবে। পার্বত্য শান্তি চুক্তির পরপরই পাহাড়ের অবৈধ অস্ত্রের ঝন্ঝনানি, খুন-খারাবি, চাঁদাবাজি বেড়ে গেছে।

উন্নয়ন হলেও পাহাড়ে থামেনি সংঘাত :
‘শান্তি’ ও ‘সম্প্রীতি’র পার্বত্য জেলার স্লোগানের তৃপ্তি যেনো কিছুতেই পাচ্ছেন না পাহাড়বাসী। তিন পার্বত্যাঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য সম্পাদিত শান্তি চুক্তির আজ ২৫ বছর পূর্ণ হলো। কিন্তু পাহাড়ে সংগঠনগুলোর মধ্যে দ্বন্দ-সংঘাত বেড়ে অশান্তই থাকছে পাহাড়। গত ১ বছরেই পাহাড়ি সংগঠনগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও পারিবারিক কলহে অন্তত ১৪ জন খুন হয়েছেন। অপহরণের শিকার হয়েছেন উল্লেখযোগ্য মানুষ। দীর্ঘ ২৫টি বছর কেটে গেলেও পাহাড়ে থামেনি অস্ত্রের ঝনঝনানি। দিনে দিনে বাড়ছে সংঘাত, খুন, গুমসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ড। আর এসবের পেছনে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে অস্ত্র ও চাঁদাবাজি। যার কারণে পাহাড়বাসী আতঙ্ক নিয়েই বসবাস করছেন এখনো।
যে লক্ষ্য নিয়ে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে সেই লক্ষ্য পূরণ না হলেও ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে তিন পাবর্ত্যজেলাতেই। আর এই উন্নয়নের স্পৃহা হিসেবে কাজ করেছে এই শান্তিচুক্তি- এমনটাই মনে করেন সংশ্লিষ্ট সচেতন মহল।
যদিও সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে- শান্তি চুক্তির অধিকাংশ শর্তই বাস্তবায়িত হয়েছে। বাকি শর্তগুলোও দ্রæত বাস্তবায়িত হবে।
অন্যদিকে সরকারের সাথে সম্পাদিত এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করা সংগঠন জেএসএস অভিযোগ করছে, সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের পরিবর্তে লঙ্ঘন করছে।
অন্যদিকে শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে সরব সংগঠনগুলো শান্তি চুক্তির শর্তগুলো সংশোধনের দাবিতে তাদের আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন। তাদের দাবি- চুক্তির অধিকাংশ ধারাই সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক।
সরকারের ব্যাপক উন্নয়নের উল্টোস্রোতে গড়ে ওঠা নতুন একটিসহ চারটি সংগঠন জেএসএস (সন্তু), জেএসএস (এমএন) ও ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক পার্টি ও নতুন করে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর লড়াইয়ে রক্তাক্ত হচ্ছে পাহাড়। তাদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কারণে গেল একমাসের বেশি দিন ধরে পাহাড়ে যৌথবাহিনীর অভিযান চলমান রয়েছে এখনো। বান্দরবানের রুমা ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় বন্ধ রয়েছে পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞাও।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি কাজী মুজিবুর রহমান বলেন, শান্তিচুক্তির অনেকগুলো ধারা বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে চুক্তিতে বলা হয়েছে- অবৈধ অস্ত্র জমা দেওয়ার জন্য। কিন্তু অস্ত্র জমা না দেওয়ার কারণে প্রতিনিয়িত হত্যা, গুম, খুন, চাঁদাবাজি হচ্ছে এবং বন্ধ হচ্ছে না সন্ত্রাসী কর্মকান্ড। তবে কিছু উপধারা রয়েছে; সেই ধারাগুলো বাতিলের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ২৫ বছরেও শান্তিচুক্তি কোনো সুফল পায়নি পাহাড়ের মানুষ। সেনা ক্যাম্পগুলো তুলে নেওয়ার কারণে পাহাড়ে এখনো হানাহানি সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বেড়ে গেছে। পাহাড়ে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুনরায় অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প পুনরায় স্থাপন করা হলে হানাহানি বন্ধ হবে বলে মনে করেন এই নেতা।
বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য সিংইয়ং ম্রো বলেন, পাহাড়ে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা থাকলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সার্বক্ষণিক কাজ করছেন বলেই পাহাড়ে শান্তি বিরাজ করছে। শান্তি চুক্তির সুফলও সাধারণ মানুষ পাচ্ছেন। শান্তি চুক্তির প্রায় ধারাগুলো বাস্তবায়ন হয়েছে। পার্বত্য জেলা পরিষদ সকল সম্প্রদায়ের সদস্য নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে।
উল্লেখ্য, পাহাড়ে শান্তি ফেরাতে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকারের পক্ষে তৎকালীন চিফ হুইপ আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় ওরফে সন্তু লারমা শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন।