শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী

64

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

জহুর আহমদ চৌধুরীর প্রথম পুত্র সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী, চাকসুর প্রথম জিএস আবদুর রব, সিটি কলেজের জিএস সুলতান উল কবির চৌধুরী ছিলেন পরস্পর বন্ধু। সুলতান অসাধারণ সাহসী ও তেজস্বী ছাত্রনেতা। সাইফুদ্দিন ও সুলতান সিটি কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। আবদুর রব চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এম এ ক্লাসের ছাত্র-তুখোড় বক্তা, দক্ষ সংগঠক। চট্টগ্রামের ছাত্র রাজনীতিতে তিনজনই বিশিষ্ট স্থানের অধিকারি।
সাইফুদ্দিন ২৬ মার্চ সকালে দামপাড়ায় তাঁর বাসভবনের সামনে দাঁত মাজছিলেন। এমন সময় বাল্যবন্ধু ছাত্রনেতা শফর আলী সেখানে আসলে সাইফুদ্দিন তাঁকে বলেন ‘পাকিস্তানিরা বাঙালি কোন যুবককে আস্ত রাখবে না। যেভাবে ভিয়েতনামে মার্কিনিরা সেদেশের যুবকদেরকে ধরে ধরে হত্যা করেছিল, বাংলাদেশেও সেভাবে পাঞ্জাবিরা আমাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইবে। আমাদেরকে যুদ্ধে যেতে হবে, দেশ স্বাধীন করতে হবে’।
এরপর সাইফুদ্দিন এই বলে ঘর থেকে বের হয়ে যান যে তিনি প্রথমে আলি আকবর সওদাগরের কাছে যাবেন, সেখান থেকে চকবাজারে যাবেন টাকার জন্য। তাঁর ৭০টি টাকার প্রয়োজন গাড়ি ভাড়ার জন্য, পটিয়া যেতে হবে। পটিয়া সদরে তখন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্য যারা বিদ্রোহ করে বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন তাদের শক্ত ঘাঁটি। তবে সাইফুদ্দিন সেখানে নয়, তিনি যান তাঁর শিক্ষক অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফের কুসুমপুরার বাড়িতে। সুলতানও ইউসুফ সাহেবের ছাত্র, সেই হিসাবে তারা সবাই হয়ত কর্ণফুলী পার হয়ে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ গ্রামীণ জনপদে সাময়িক আশ্রয় নিতে গিয়েছিলেন। সাইফুদ্দিনের বন্ধু এবং অধ্যাপক ইউসুফের ছাত্র কলামিস্ট ইদরিস আলম লিখেছেন, তিনি এবং সাবেক মন্ত্রী ও চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি এম এ মান্নান ২৮ মার্চ সাইফুদ্দিনকে কোরবাণীগঞ্জ থেকে পটিয়া থানার কুসুমপুরা গ্রামে সিটি কলেজের অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফের বাড়িতে রেখে আসেন। সম্ভবত কুসুমপুরা থেকেই পরে কোন এক সময় সাইফুদ্দিন পটিয়া সদরে যান এবং সেখানে সুলতান ও ফিরোজের সাথে তাঁর দেখা হয়। ইদরিস আলমের সাথে পটিয়ায়ও সাইফুদ্দিনের দেখা হয়েছিল। তিনি তখন একবার ভারত সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আবার দেশে ফিরে এসেছেন। তিনি সাইফুদ্দিনকে তাঁর সঙ্গে ভারতে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন কিন্তু সাইফুদ্দিন রাজি হননি। পরবর্তীকালে সুলতান উল কবির চৌধুরী যখন ভারতে যাওয়ার উদ্যোগ নেন, তখন সাইফুদ্দিন তাঁর সঙ্গে যেতে রাজি হয়ে যান। সেই যাত্রাপথেই তাঁরা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ওঁৎ পেতে থাকা পাকিস্তানি সৈন্যদের সামনে পড়ে যান এবং তাদের ব্রাশ ফায়ারে সাইফুদ্দিন, রব, অধ্যাপক দিলীপ চৌধুরী, মোজাফফর আহমদ ও চালক ইউনুস কচুকাটা হয়ে যান।
এই হত্যাকান্ড থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া বাঁশখালীর সাবেক সংসদ সদস্য সুলতান উল কবির চৌধুরীর কাছে ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১১ এপ্রিল পটিয়া ডাক বাংলোয় সাইফুদ্দিন, রব ও ফিরোজের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। তাঁরা সেখানে বসে ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরা বান্দরবানগামী ইপিআরের একটি লরিতে উঠে পড়েন। বান্দরবান পৌঁছে তারা সেখানকার এসডিও আবদুল শাকুরের সাথে দেখা করে ভারতে যাওয়ার রুট নিয়ে খোঁজ-খবর নেন। এসডিও তাদেরকে বলেন, আপনারা ভুল পথে এসেছেন, এই পথে ভারতে যেতে হলে আপনাদেরকে প্রায় চারশ মাইল পথ পাড়ি দিতে হবে। তিনি তাদেরকে বিকল্প সহজ পথ হিসেবে চন্দ্রঘোনা, কাপ্তাই, পাহাড়তলী হয়ে রামগড় দিয়ে ভারতে যাওয়ার পরামর্শ দেন। সেই পরামর্শ অনুযায়ী সুলতান, সাইফুদ্দিন, রব, ফিরোজ, রামুর সিদ্দিক, মিরসরাই’র রুস্তম বা শামসু-এই সাত জনের দলটি চৌদ্দ মাইল পথ পায়ে হেঁটে চন্দ্রঘোনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে তাঁরা দ্রুত ধাবমান একটি জিপকে থামানোর চেষ্টা করেন কিন্তু জিপের চালক তাদের ইশারায় কর্ণপাত না করে দ্রæত তার গন্তব্য পথে চলে যান। বিধি বাম! জিপটি কিছুদূর গিয়ে ছড়ার মধ্যে অচল হয়ে পড়ে থাকে। সুলতানদের দল কাছে এসে দেখেন জিপের আরোহীরা তাদের পূর্ব পরিচিত। তাদের মধ্যে ছিলেন কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ কলেজের গণিতের অধ্যাপক সাতকানিয়ার দিলীপ চৌধুরী, বোয়ালখালী থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোজাফফর আহমদ, ইউনুস, নুরুল ইসলাম, ইদ্রিস। সবার গন্তব্য অভিন্ন জেনে একসঙ্গে যাওয়া সাব্যস্ত হলো এবং সবাই ধরাধরি করে জিপটিকে খাড়া করে চড়ে বসলেন। রাতেই তারা চন্দ্রঘোনা পৌঁছলেন কিন্তু কর্ণফুলী পার হবার ফেরি পেলেন না। সকালে পার হলেন। জিপের সামনের আসনে অধ্যাপক দিলীপ চৌধুরী, আবদুর রব ও মোজাফফর আহমদ। পেছনের সিটে সুলতান, সাইফুদ্দিন, ফিরোজ, সিদ্দিক, রুস্তম, নুরুল ইসলাম ও ড্রাইভারের সহকারী। জিপে ছিলো বঙ্গবন্ধু’র স্বাধীনতার ঘোষণার কপি, প্রচারপত্র, অয়্যারলেস সেট ও কিছু বেতার যন্ত্রপাতি। জিপের সামনে ছিলো একটি সাবমেশিন গান, কয়েকটি রাইফেল ও বেশ কিছু হ্যান্ড গ্রেনেড। জিপ দ্রুত ছুটে যাচ্ছিলো।
ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কিছু আগে একটি মাজারের মোড় পার হতেই হঠাৎ খোলা রাস্তা। একপাশে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, অন্য পাশে ইমাম গাজ্জালী কলেজ। চৈত্রের সকাল বেলার সূর্যের তেজ ঠিকরে পড়ছিলো, রাস্তায় সুনসান নীরবতা। হঠাৎ একটি লোক যেন মাটি ফুঁড়ে উদয় হলো। ড্রাইভার ইউনুস গাড়ির গতি শ্লথ করে তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন রাস্তা পরিষ্কার আছে কি না। সে হ্যাঁ বলতে ড্রাইভার গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেন। ইমাম গাজ্জালী কলেজ পার হবার সাথে সাথেই সেটআপটা ধরা পড়ে গেলো। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের (বর্তমানের বুয়েট) সামনে একটি প্রাইমারি স্কুল; মোড় ঘুরে জিপ সেই স্কুলের সামনে পড়তেই রব দেখলেন পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে কলেজে, তিনি সবাইকে সাবধান করার জন্য চেঁচিয়ে উঠলে ড্রাইভার কড়া ব্রেক কষলেন। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও স্কুলের ছাদে ওঁৎ পেতে থাকা পাকিস্তানি সৈন্যরা গুলিবৃষ্টি উপহার দিয়ে তাঁদেরকে অভ্যর্থনা জানালো। ঝাঁক ঝাঁক রাইফেল, মেশিনগানের গুলিবৃষ্টির সামনে উলঙ্গ জিপ। কোনো আড়াল নেই কোথাও। প্রথম গুলিতেই চাকা ফেটে গাড়ি অচল হয়ে যায়। অরক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা প্রত্যুত্তর দেয়ার চেষ্টা করলেন। গুলি নিঃশেষ হয়ে যায়। টপ টপ করে একজন একজন করে পড়ে গেলেন চট্টগ্রামের ভবিষ্যতের অসীম সম্ভাবনাময় দুই নেতা। প্রথমে সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী, তারপর চাকসু ভিপি আবদুর রব।
সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী ১৯৪৭ সালে দামপাড়া পল্টন রোডে পৈত্রিক বাসভবনে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, সিটি আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, সাবেক পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদক, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, মুক্তিযুদ্ধে লিবারেশন কাউন্সিল ইস্টার্ন জোনের চেয়ারম্যান এবং বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার সদস্য জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরী। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে তা’ দেশে-বিদেশে প্রচারের জন্য জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছেই পাঠিয়েছিলেন। সাইফুদ্দিনের মাতার নাম জাহানারা বেগম।
সাইফুদ্দিন দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বাগমনিরাম প্রাইমারি স্কুলে পড়াশোনা করেন। এরপর এম ই স্কুলে (চট্টগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়) তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়ার পর সরকারি মুসলিম হাই স্কুলে ভর্তি হন। মুসলিম হাই স্কুলে অধ্যয়নকালে ৬২’র ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।
মুসলিম হাই স্কুলে পড়ার সময় তাঁর সৃজনশীল প্রতিভার উন্মেষ ঘটে। তখনকার দিনে মুসলিম হাই স্কুলে বৃহস্পতিবার পাঠ্য বিষয়ের বাইরে এক ঘণ্টা অতিরিক্ত ক্লাশ হতো। বিভিন্ন আলোচনা, বিশেষত নিয়মিত বিতর্কের আসর বসতো। সাইফুদ্দিন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে থাকেন।
১৯৬৭ সালে এসএসসি পাস করেন। ১৯৬৭-৬৮ সালে সিটি কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বছরেই তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে দিবা বিভাগের সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) নির্বাচিত হন। ৬৭ থেকে ৭১-এর ৩০ মার্চ পর্যন্ত সিটি কলেজ ছিলো ছাত্র আন্দোলনের দুর্ভেদ্য দুর্গ। আর এ আন্দোলনের অগ্রভাগে থেকে যারা চট্টগ্রামের রাজপথ প্রকম্পিত করে তুলতেন, সাইফুদ্দিন তাদের অন্যতম। তিনি তুখোড় বক্তা, অপ্রতিদ্ব›দ্বী তার্কিক, অসাধারণ সংগঠক, মেধাবী ছাত্রনেতা, নিষ্পাপ চেহারার নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারি, সদালাপী, বন্ধুবৎসল ছিলেন। সর্বোপরি তিনি এক খাপখোলা তলোয়ারের তুলনাÑসত্যের জন্য, আদর্শের জন্য যিনি প্রয়োজনের সময় ঝলসে উঠতে পারেন। সাইফুদ্দিন খালেদ অর্থও ‘ধর্মের তলোয়ার’। স্ত্রী জাহানারা বেগমের কোল আলো করে যখন প্রথম শিশুপুত্রটি জন্মগ্রহণ করে, তখন জহুর আহমদ চৌধুরী সাধ করে তার নাম রেখেছিলেন সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী। পুত্রটি বড় হয়ে সার্থকনামা হয়েছিলো। অন্যায় দেখলেই এই তরবারি ঝলসে উঠতো। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মুখোমুখি হয়েও এমনি ঝলসে ওঠেছিলেন; বীরের মতো লড়াই করতে করতে প্রাণ বিলিয়ে দিতে এতটুকু বুক কাঁপেনি তাঁর। সাইফুদ্দিনের বন্ধু কলামিস্ট ইদরিস আলম লিখেছেন সাইফুদ্দিন শরীর থেকে বিন্দু বিন্দু রক্তে দেশমাতৃকার মাটি ভিজিয়ে দিয়ে মাতৃঋণ শোধ করেছিলেন এবং অবশেষে অমৃতের পুত্র হয়ে যান দামপাড়ার পল্টন রোডের সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী।
জহুর আহমদ চৌধুরী এমন একজন রাজনৈতিক নেতা, যিনি পাকিস্তান আন্দোলন করতে আপন ভাইকে হারিয়েছিলেন কলকাতার দাঙ্গায়, তার নাম মাহবুবুল আলম। তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সারির একমাত্র নেতা, যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ করতে গিয়ে নিজের জ্যেষ্ঠ পুত্রটিকে কোরবানি দিয়েছিলেন। তিনিই একমাত্র নেতা, যাঁর কাছে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা প্রেরণ করেছিলেন; তিনিই একমাত্র নেতা, যিনি কলকাতা থেকে বহুদূরে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আগরতলায় অবস্থান করে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ঢাকা, কিশোরগঞ্জ এবং বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিস্তীর্ণ এলাকায় লিবারেশন কাউন্সিল ইস্টার্ন জোন গঠন করে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন; তিনিই একমাত্র নেতা যিনি মুক্ত স্বদেশের মাটিতে প্রথম বিজয়ের পতাকা উত্তোলন করেন; তিনিই একমাত্র নেতা, যিনি সর্বপ্রথম ঢাকা রেডিওতে ভাষণ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং বাংলাদেশের প্রথম রেডিও চালু করেছিলেন এবং সম্ভবত তিনিই একমাত্র নেতা যিনি কপর্দকশূন্য অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। অথচ তখন তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পূর্ণ মন্ত্রী। সেজন্য জহুর আহমদ চৌধুরীর অনুশোচনা ছিলো না, তিনি পরিপূর্ণ জীবনযাপন করে পরিতৃপ্তি নিয়েই পরলোকে যাত্রা করেন।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা