শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা

185

১৯৭১ সালে ডিসেম্বর মাস। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জাতি যখন উদয়ের পথে দাঁড়িয়ে দেখছে, পূর্বদিগন্তে বিজয়ের লাল সূর্য উদিত হচ্ছে, দেশ যখন স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে- ঠিক তখনই স্বাধীনতার নেতৃত্বের আসনে থাকা, আগামীর স্বাধীন বাংলাদেশের সেরা মেধাবী ও বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নৃশংসভাবে হত্যা করে পাকহানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তি কমিটির সদস্যরা। বধ্যভ‚মিতে বড় অসহায় অবস্থায় নিঃশেষে প্রাণ দেন আমাদের দেশের সেরা শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা। রণক্ষেত্রে বীর বাঙালির হাতে নাস্তানাবুদ হয়ে শেষে জাতিকে মেধাশূন্য করার সুদূরপ্রসারী ঘৃণ্য নীলনকশা বাস্তবায়নে নেমেছিল তারা। ঘাতকরা চেয়েছিল, জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে। শ্বাপদীয় জন্তুর মতো ঘাতকরা ১৪ ডিসেম্বর রাতের আঁধারে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। এ হত্যাকাণ্ড ইতিহাসে এক জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড। আজকের এই দিনে মহান শহীদ বুদ্ধিজীবীসহ সব শহীদদের বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।
সূত্র অনুযায়ী, দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের মধ্যে এই দিনে ডা. ফজলে রাব্বী, আবদুল আলীম চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, সেলিনা পারভীন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সন্তোষ ভট্টাচাযর্, সিরাজুল হক, চিকিৎসক গোলাম মুতোর্জা, আজহারুল হক, হুমায়ুন কবীর, মনসুর আলীসহ অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। জগন্নাথ হল, রায়েরবাজার নদীর তীর ও মিরপুরের কয়েকটি স্থানে নিয়ে হত্যা করা হয় এসব বুদ্ধিজীবীকে। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে এবং যুদ্ধ চলাকালে হত্যা করা হয় জ্যোর্তিময় গুহঠাকুরতা, গোবিন্দ চন্দ্র দেবসহ আরও অনেক বুদ্ধিজীবীকে। মুনীর চৌধুরী, আলতাফ মাহমুদ ও শহীদুল্লাহ কায়সারও একইভাবে হত্যার শিকার হন। আর এ নারকীয় হত্যাকাÐের সর্বপ্রথম শিকার হয়েছিলেন অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা। দেরিতে হলেও বাংলার মাটিতে বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ বিচার হয়েছে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের। যে জাতি এত ত্যাগ আর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, সে জাতির ইতিহাসে এই বেদনাদায়ক বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ দণ্ড কাযর্করের মধ্যদিয়ে বুদ্ধিজীবী দিবসে ভিন্ন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীর দণ্ড কাযর্করের এ ঘটনায় জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। এ নিমর্ম হত্যাকাণ্ডের সুবিচার জাতির প্রত্যাশা ছিল। সরকারের এ প্রয়াস তাই অভিনন্দনযোগ্য।
উল্লেখ্য যে, ১৪ ডিসেম্বর যেসব বুদ্ধিজীবী অকাতরে প্রাণ দিয়েছেন, তারা সত্যের পথে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। প্রকৃত অর্থে তারা দেশকে, দেশের মানুষকে ভালোবাসতেন। তারা দেশে সত্য ও ন্যায়কেই প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, ছিলেন মানবকল্যাণমুখী। সে জন্য পাকিস্তানের দোসরদের বর্বরতায় তাদের জীবন দিতে হয়েছিল। কিন্তু বুদ্ধিজীবীদের ত্যাগ বৃথা যাওয়ার নয়। দেশের প্রতি এত প্রেম কখনো বিফলে যায় না। সেসব মহান মানুষের ত্যাগই আজ সমৃদ্ধ করেছে নতুন প্রজন্মকে। আপামর বাঙালি জাতি আজ তাদের কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে। বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মকে একাত্তরের ঘাতকদের নতুন করে পরিচয় করে দেয়া অত্যন্ত জরুরি একটি কাজ, যা অস্বীকারের সুযোগ নেই। ছোটদের পাঠ্যপুস্তকে বীরশ্রেষ্ঠদের নিয়ে নিবন্ধ আছে। আছে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক লেখা, বুদ্ধিজীবী নিয়েও রচনা রয়েছে। ফলে নতুন প্রজন্মকে লেখাপড়ার মাধ্যমে আলবদর-আলশামস-রাজাকারসহ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী, বাংলাদেশবিরোধী অপশক্তিকে চেনানোর ব্যবস্থা জরুরি বলেই মনে করা যায়।
সর্বোপরি বলতে চাই, একাত্তরের ঘাতকরা ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বর দেশের যেসব বুদ্ধিজীবী হত্যা করেছে তারা ছিলেন মুক্তচিন্তার পথিক। দেশপ্রেমিক এসব বুদ্ধিজীবী স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয় দেখতে চেয়েছিলেন। বাস্তবতা যে, স্বাধীনতা লাভের কয়েকদিন আগেই তাদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। সংগত কারণে হত্যাকারীদের যেমন ঘৃণা প্রাপ্য, তেমনি কেবল বুদ্ধিজীবী দিবসেই তাদের প্রতি শ্রদ্ধায় আপ্লুত হয়ে উঠব, এমনটি প্রত্যাশিত নয়। আমরা মনে করি, নতুন প্রজন্মের স্বার্থে বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগের পাশাপাশি জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানরা যে চেতনা লালন করেছেন আমৃত্যু, তার যথাযথ বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। এছাড়া অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে বলা দরকার, এসব অপশক্তি যেন কোনো অবস্থায়ই রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা না পায়, এরা যেন কিছুতেই এই দেশে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকে এবং এটিই হতে পারে বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর প্রকৃষ্ট উপায়।