শহিদ মিনার : ভাষার জন্য আত্মোৎসর্গের অনন্য প্রতীক

73

এমরান চৌধুরী

ভাষা শহিদদের স্মৃতিকে আমাদের উত্তরসূরিদের কাছে পরিচিত ও জিইয়ে রাখার মানসে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়। এই স্মৃতিস্তম্ভই আজকের শহিদ মিনার। এই শহিদ মিনার প্রথম নির্মিত হয় ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণের যে স্থানে পুলিশ গুলি চালায় ঠিক সেই জায়গায়। ১০ ফুট উঁচু ও ৬ ফুট চওড়া ভিত্তির ওপর নির্মিত এই স্মৃতিস্তম্ভের নকশাকার ছিলেন সাঈদ হায়দার আর রেখাঙ্কন করেন বদরুল আলম। নির্মিত প্রথম শহিদ মিনারটি ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে ভাষা আন্দোলনে শহিদ শফিউরের পিতা প্রথম উদ্বোধন করেন। অধুনালুপ্ত দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন ২৬ ফেব্রæয়ারি এটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। ২৪ ফেব্রæয়ারি থেকে ২৬ ফেব্রæয়ারির মধ্যে এ মিনার হয়ে উঠেছিল ভাষাপ্রেমী বাঙালির তীর্থ কেন্দ্র। জাতি ধর্ম পেশা শ্রেণি নির্বিশেষে সব বয়সী মানুষের গ্রোত ছিল শহিদ মিনারের দিকে। মাতৃভাষার জন্য যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন তাঁদের জন্য আবেগে, অনুভূতিতে, স্নেহে ঐ সব মানুষের হৃদয় মন ছিল পরিপূর্ণ। তাঁরা শহিদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে ফুল দিচ্ছিলেন শহিদ মিনারের ভিত্তিমূলে। ফুলে ফুলে শহিদ মিনার ভরে যেতে সময় লাগছিল না। কিন্তু এভাবে মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা দেখানো ভালো লাগেনি তখনকার নাজিমউদ্দিন -নুরুল আমিনের মুসলিম লীগ সরকারের। তারা সশস্ত্র বাহিনী দিয়ে বাঙালির প্রথম শহিদ মিনারটি ২৬ ফেব্রæয়ারি দুপুর ও বিকেলের মধ্যে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। তবে ইতিমধ্যেই বাঙালির হৃদয়ে যে মিনার গাঁথা হয়ে গিয়েছিল তা মুছে ফেলার সাধ্য যে কারো নেই তা তারা বুঝতে পারেনি।
১৯৫৬ সালের ২১ ফেব্রæয়ারি আবু হোসেন সরকারের আমলে বর্তমান শহিদ মিনারের স্থান নির্বাচন ও ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয়। ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে আবু হোসেন সরকারের পতন ঘটে। ফলে স্থান নির্বাচন এবং ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হলেও শহিদ মিনারের পরিকল্পনা প্রণয়ন বা বাস্তবায়নের কাজ তেমন অগ্রসর হয়নি। ৬ সেপ্টেম্বর আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলায় প্রথম আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শহিদ মিনারের পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের কাজ অনেক দূর অগ্রসর হয়। এ সময় ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল আইন সভায় বাংলা একাডেমি এ্যাক্ট ১৯৫৭’ পাশ হয়। ১৯৫৭ সালের ১০ আগস্ট বর্ধমান হাউসে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়। শহিদ মিনারের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়ে তদানীন্দন চিফ ইঞ্জিনিয়ার এ জব্বার এর ওপর। ঐ বছর শরৎকালে শিল্পী হামিদুর রহমান ইংল্যান্ডে শিল্পকলা বিষয়ে উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত করে দেশে ফিরে আসেন। প্রধান প্রকৌশলী জব্বার এবং শিল্পী জয়নুল আবেদীন হামিদুর রহমানকে শহিদ মিনারের জন্য একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে অনুরোধ করেন। সেই অনুরোধের প্রেক্ষিতে শিল্পী হামিদুর রহমান শহিদ মিনারের একটি মডেল এবং ৫২টি নকশা ও পরিকল্পনা পেশ করেন। অন্যান্য স্থপতি এবং শিল্পীরাও প্রতিযোগিতামূলক নকশা দিয়েছিলেন। কিন্তু গ্রীক স্থপতি ডক্সিয়াডেস, প্রধান প্রকৌশলী জব্বার এবং শিল্পী জয়নুল আবেদীনের সমন্বয়ে গঠিত নির্বাচন কমিটি আছে হামিদুর রহমানের নকশাটিকে অনুমোদন করেন।
১৯৫৭ সালের নভেম্বর মাসে শহিদ মিনারের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। একটানা কাজের মধ্য দিয়ে ১৯৫৮ সালের ২১ ফেব্রæয়ারির মধ্যে শহিদ মিনারের ভিত, মঞ্চ এবং তিনটি স্তম্ভ নির্মাণের কাজ শেষ হয়। এছাড়া পরিকল্পিত শহিদ মিনারের জন্য শিল্পী নভেরা আহমেদ তিনটি ভাস্কর্যের কাজও শেষ করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৫৭ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৫৮ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত হামিদুর রহমানের তত্ত¡াবধানে শহিদ মিনারের কাজ চলছিল। কিন্তু আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং অক্টোবর মাসে সামরিক শাসন প্রবর্তিত হলে শহিদ মিনারের কাজ বন্ধ হয়ে যায় এবং শহিদ মিনার থেকে যায় অসমাপ্ত। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত শহিদ মিনারের জন্য নির্মিত মঞ্চ এবং অসমাপ্ত কয়েকটা স্তম্ভই ছিল এদেশের শহিদ মিনার। ১৯৬২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের তখনকার গভর্নর লে. জে. আজম খান শহিদ মিনারের অসমাপ্ত কাজ শেষ করার উদ্যোগ নেন। তিনি তার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. মাহমুদ হাসানকে সভাপতি করে ১৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেন। কমিটির সদস্যদের মধ্যে ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. মমতাজউদ্দিন আহমদ, ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, ড. কাজী মোতাহের হোসেন, অধ্যক্ষ মুহম্মদ আবদুল হাই, ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, বাংলা একাডেমির পরিচালক সৈয়দ আলী আহসান এবং ইসলামিক একাডেমির পরিচালক আবুল হাসিম। অধ্যাপক মুনির চৌধুরী এই কমিটির সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। এই কমিটিকে ১৯৬২ সালের ১ মে এর মধ্যে শহিদ মিনার নির্মাণ সম্পর্কে তাদের সুপারিশ পেশ করতে বলা হয়। ঐ কমিটি শিল্পী হামিদুর রহমানের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার যে সুপারিশ করেন সে মতে কাজ শুরু হয়ে যায়। ১৯৬৩ সালের ২০ ফেব্রæয়ারি এই শহিদ মিনারের নির্মাণ কাজ শেষ হয়। কিন্তু ১৯৬৩ সালে সমাপ্ত শহিদ মিনার শিল্পী হামিদুর রহমানের নকশাভিত্তিক হলেও শহিদ মিনার স্তম্ভে যে চোখের নকশা থাকার কথা ছিল তার পরিবর্তে সেখানে লোহার শিক গলিয়ে দেয়া হয়।
১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রæয়ারি সদ্য সমাপ্ত শহিদ মিনারের উদ্বোধন করেন শহিদ আবুল বরকতের মা হাসিনা বেগম। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল বাহাত্তর বছর। ১৯৬৩ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এই শহিদ মিনারই ছিল সকল আন্দোলন-সংগ্রামের অনুপ্রেরণার উৎস। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় ও ৭১ এর অসহযোগ আন্দোলনে এই শহিদ মিনার থেকে লড়াকু বাঙালিরা পেয়েছে সামনে এগিয়ে যাওয়ার দীপ্ত প্রেরণা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দেশে পাকিস্তানি হায়েনাদের নারকীয় তান্ডব শুরু হলে শহিদ মিনারটিও রক্ষা পায়নি। তারা ভারী গোলাবর্ষণ করে শহিদ মিনারের স্তম্ভগুলো ধ্বংস করে দেয়। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে ধ্বংসস্তূপ থেকে জেগে ওঠে স্মৃতির মিনার। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম শহিদ দিবস পালিত হয় ভাঙা শহিদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময় রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে সভাপতি করে শহিদ মিনার পুনর্নিমাণের জন্যে গঠিত হয় একটি কমিটি। এই কমিটি থেকে শহিদ মিনারের জন্য ১৫ ফেব্রæয়ারি মধ্যে স্থপতিদের কাছ থেকে নকশা ও পরিকল্পনা আহ্বান করা হয়। শিল্পী হামিদুর রহমান স্থপতি এম.এস. জাফরের সঙ্গে মিলিতভাবে একটি সংস্থা গঠন করেন। সেই সংস্থা থেকে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের জন্য নকশা ও পরিকল্পনা পেশ করেন। নকশাটি ছিল ১৯৫৭ সালে শিল্পী হামিদুর রহমানের করা মূল পরিকল্পনাভিত্তিক।
ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় জীবনে যুগপৎ শোক ও আনন্দের মাস। কেননা ১৯৫২ সালের এই মাসে পৃথিবীতে আমাদের পূর্বসূরিদের বুকের তরতাজা রক্তে রচিত হয় গৌরবের গল্প। যে গৌরবের গল্পের জন্য সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের মানুষ আলাদাভাবে পরিচিত। বাংলা ভাষার জন্য জীবনদানকারী এসব রক্তজবার স্মরণে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে নির্মাণ করা হয় স্মৃতির ভাস্কর্য, যার নাম ‘মোদের গরব’। ভাষা শহিদ রফিক, সালাম, বরকত, শফিউর, জব্বার যেন আমাদের সামনে জীবন্ত দাঁড়ানো এ ভাস্কর্যে। ১৩ লক্ষ ৪৩ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ ভাস্কর্যের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০০৬ সালের ১৩ নভেম্বর। স্মৃতি ভাস্কর্য মোদের গরব এর উদ্বোধন করা হয় ২০০৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। বাংলা একাডেমি বর্ধমান হাউজের সামনে অবস্থিত এই ভাস্কর্যটি গোপাল চন্দ্র পালের সহায়তায় নির্মাণ করেন অখিল পাল।
দেশের সর্বোচ্চ শহিদ মিনারটি নির্মিত হয় জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাঙালি জাতির দুঃখ- বেদনা, আনন্দ-অশ্রুসিক্ত গৌরবময় ৮টি সন ৪৭, ৫২, ৫৪, ৫৬, ৬৫, ৬৬, ৬৯ আর ৭১ এর স্মারকরূপে নির্মাণ করা হয় এই শহিদ মিনারটি। ৬৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ঢাকার সাভারে নির্মিত শহিদ মিনারটির স্থপতি ছিলেন রবিউল হুসাইন। ২০০৪ সালের ৬ নভেম্বর এই শহিদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন উপাচার্য অধ্যাপক খন্দকার মুস্তাফিজুর রহমান। ৭১ ফুট উচ্চ, ৫১ ফুট ব্যাসের এই শহিদ মিনার উদ্বোধন করা হয় ২০০৬ সালের ২১ ফেব্রæয়ারি। দেশের স্মৃতিস্তম্ভের ইতিহাসে এটিই সবচেয়ে বড় শহিদ মিনার। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের শহিদদের চির অমর করে রাখার জন্য দেশের ৬৪টি জেলার পাশাপাশি প্রায় সবক’টি উপজেলা সদরে নির্মিত হয়েছে শহিদ মিনার। আর একুশের বিশ্বায়নের পর পৃথিবীর দেশে দেশে শহিদ মিনার নির্মিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশের জাতীয় চেতনার শহিদ মিনার তাই কেবল একটি প্রতীক নয়। এর অন্তরে বাহিরের রয়েছে মূল্যবান অর্থ ও তাৎপর্য। বাহির থেকে আমরা শহিদ মিনারকে দেখি ভাষা শহিদদের স্মৃতির প্রতীক হিসেবে। কিন্তু একটু অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখলে বড় স্তম্ভ আর দু’দিকের দুটো করে চারটি ছোট স্তম্ভের অর্থ বোঝা খুব একটা কঠিন নয়। বড় স্তম্ভটি হলো মাতৃভাষা, তথা মা, আর দু’দিকের চারটি স্তম্ভ হলো সন্তানের প্রতীক। মা অর্ধবৃত্তাকারে তাঁর শহিদ সন্তানদের নিয়ে দন্ডায়মান, যাঁরা তাঁর মর্যাদা রক্ষার জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। গৌরবান্বিত মা তাঁর সন্তানদের জন্য দোয়া করছেন। সে সঙ্গে মা চারটি সন্তানের মধ্য দিয়ে তাঁর লক্ষ কোটি সন্তানকে দেখতে পাচ্ছেন। মা, মাতৃভূমি, ভাষা আর রফিক, সালাম, বরকত, শফিউর যেন আত্মত্যাগের মূর্ত প্রতীক হয়ে এক সারিতে দাঁড়িয়ে আছে প্রত্যেক বাংলা ভাষাভাষীর সামনে।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক