শহর মুক্তিযুদ্ধ ও প্রতিরোধ যুদ্ধের নায়ক মৌলভী সৈয়দ এবং আগ্রাবাদের ‘সৈয়দবাড়ি’

211

মুক্তিযুদ্ধে অনেক বাড়িই বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি বা আশ্রয়স্থল হিসেবে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে সেল্টার হিসেবে ব্যবহৃত কোন বাড়ি পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য যে প্রতিরোধ যুদ্ধ হয়েছিলো, সেই যুদ্ধেও ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, এমন বাড়ি ক’টি খুঁজে পাওয়া যাবে আমি জানি না। একটি বাড়ির কথা আমি জানি, যেটি মুক্তিযুদ্ধকালে ‘সৈয়দবাড়ি’ নামে পরিচিত ছিলো, অধুনা সেখানে একটি মার্কেট তৈরি হওয়ায় যার নতুন পরিচিতি হয়েছে ‘ভাণ্ডার মার্কেট’। দুটি যুদ্ধ-মুক্তিযুদ্ধ আর প্রতিরোধ যুদ্ধ-যোগসূত্র একজনই। সেই একজন স্বনামধন্য মৌলভী সৈয়দ আহমদ। তাঁর কারণেই বাড়িটির সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। আবার তিনিই বাড়িটিকে কেন্দ্র করে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে চট্টগ্রামে প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তোলেন।
‘সৈয়দবাড়ি’র সঙ্গে মৌলভী সৈয়দের পূর্ব থেকেই আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিলো। সেই সূত্রে যাতায়াত ছিলো তার সে বাড়িতে। তিনি যখন চট্টগ্রাম শহরে মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হওয়ার কথা চিন্তা করেন, তখন ওই সৈয়দবাড়িরই অনতিদূরবর্তী পানওয়ালাপাড়ায় আবদুল হাই সর্দারের বাড়িতেই তাঁর ঘাঁটি গাড়েন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এই বাড়ির দুই ভাই তাঁর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। বড় ভাই সৈয়দ আবদুল গণি সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা, মাহমুদুল হক সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা।
সৈয়দবাড়ির তৃতীয় সন্তান সৈয়দ আবদুল গণি ও চতুর্থ সন্তান সৈয়দ মাহমুদুল হন ছাত্রলীগ করতেন। মৌলভী সৈয়দ ৬৯-৭০ সালে চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। সৈয়দ আবদুল গণি সেই সময় সিটি কলেজের ছাত্র এবং ছাত্রলীগ করতেন। সৈয়দ ভাই কলেজ এবং শহরের নেতা। গণি তাঁর কর্মী, সেটাও একটি কারণ সৈয়দবাড়ির সঙ্গে সৈয়দ ভাইয়ের সম্পর্কের। মাহমুদুল হক সেই সময় স্কুলের শেষ ক্লাসের ছাত্র।
আগ্রাবাদ ছাত্র রাজনীতির একটা শক্ত ক্ষেত্র ছিলো, ফলে মাহমুদুল হকও রাজনীতির আবর্তে পড়ে মিটিং, মিছিলে অংশ নিতে থাকেন। মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের সময় তুমুল উত্তপ্ত হয়ে ওঠে আগ্রাবাদ। সৈয়দ আবদুল গণি এবং সৈয়দ মাহমুদুল হক দু’ভাইয়ের মধ্যে সেই রাজনৈতিক উত্তাপ সঞ্চারিত হয়েছিলো। উত্তপ্ত রাজপথে স্লোগান মুখর মিছিলে তারা এক একটি অগ্নিশিখা হয়ে জ্বলে উঠেছিলেন। স্বাধীনতার দাবিতে উদ্বেল হয়ে ওঠা বাঙালি জাতিকে নির্মূল করার জন্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনী জাহাজ বোঝাই করে মারণাস্ত্র এনেছিলো বন্দরে, সেই জাহাজের নাম ‘সোয়াত’। বাতাসের আগে খবর রটে গেল সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র নামানোর পাঁয়তারা করছে পাকিস্তানি বাহিনী। চট্টগ্রামের বীর জনতা রুখে দাঁড়ালো-জান যাবে অস্ত্র নামাতে দেবো না। ২৪ মার্চ জাহাজ থেকে অস্ত্র নামাতে বাধা দেয়ার জন্য হাজার হাজার মানুষ সোয়াত ঘেরাও করলো। সৈয়দ আবদুল গণি আর সৈয়দ মাহমুদুল হকও তখন সেই সহস্র জনতার মুখ। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে গণহত্যায় নামে। কিন্তু দিনের বেলা থেকেই একটা গুমোট ভাব, অজানা আশংকা আর অনিশ্চয়তার উত্তেজনা; বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঘোষণা মানুষের মনে ছিলো। তিনি বলেছিলেন ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমাদের ওপর কাছে আমার অনুরোধ রইলো, তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রæর মোকাবেলা করবে। রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু বন্ধ করে দেবে জীবনের তরে।’ পঁচিশে মার্চের পরিস্থিতিতে সেকথা মনে পড়ে গিয়েছিলো সকলের। কাউকে বলে দিতে হয়নি, দলে দলে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে এসে রাজপথ কেটে-খুঁড়ে, গাছ-বাঁশ, ইট-পাথর ফেলে ব্যারিকেড দিয়েছিলো। আগ্রাবাদেও তেমনি ব্যারিকেড দেয়া হয়েছিলো। দেওয়ানহাট, ফায়ারব্রিগেড ও সৈয়দবাড়ির সামনে, বাদামতলীতে ব্যারিকেড দিয়ে রাস্তায় যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। ষোলশহর ২নং গেইটের কাছে পোস্টেড ছিল অস্টম বেঙ্গল রেজিমেন্ট, তার অবাঙালি সিও কর্নেল জানজুয়ার নির্দেশে তাঁর টু-আই-সি বাঙালি মেজর জিয়া বন্দরে সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করতে যাওয়ার পথে দেওয়ানহাটের ব্যারিকেডেই আটকা পড়েছিলেন। যার ফলে তার পশ্চাদ্ধাবমান ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান দেওয়ানহাট ব্যারিকেডে আটকা পড়া জিয়াকে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং জিয়া ফিরে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার সুযোগ পান।
আগ্রাবাদ সৈয়দবাড়ির সন্তান সৈয়দ আবদুল গণি, সৈয়দ মোহাম্মদ জাকারিয়া ও সৈয়দ মাহমুদুল হক এবং এলাকার ছাত্রলীগ কর্মী ইয়াসিন বিল্লাহ, খোকন প্রমুখ সৈয়দবাড়ির সম্মুখে ব্যারিকেড দিয়েছিলেন। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহর থেকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। হালিশহর ইপিআর ক্যাম্প থেকে ক্যাপ্টেন রফিকের নেতৃত্বে ইপিআর জওয়ান ও অফিসাররা বিদ্রোহ করে শহরের বিভিন্ন স্থানে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন, যাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা শহরের ঢুকতে পারে। রফিক সাহেব নিজে সিআরবি পাহাড়ের ওপর তার কৌশলগত সদর দপ্তর স্থাপন করে পূর্ব থেকেই অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। সৈয়দ আবদুল গণি ও তাঁর ভাই মাহমুদুল হক সিআরবি পাহাড়ে ইপিআর-এর জন্য খাবার, পানি, ওষুধ সরবরাহ করেন ক’দিন। কিন্তু অসম যুদ্ধের দুর্বলতা ক’দিনেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রফিক সাহেব উইথড্র করে কোর্ট বিল্ডিং-এ অবস্থান নেন এবং সেখানেও দু’তিনদিনের বেশি টিকতে না পেরে কালুরঘাটের দিকে চলে যান।
এদিকে হালিশহরের ইপিআর যোদ্ধারাও উইথড্র করে বিভিন্ন দিকে পালিয়ে যেতে থাকে। তখন তাদের পরিচয় গোপন করার জন্য সামরিক পোশাক খুলে ফেলতে হচ্ছিলো। এ সময় সৈয়দবাড়ির মুক্তিযোদ্ধা ভ্রাতৃদ্বয়ের কাজ হয়ে পড়ে ইপিআর জওয়ানদের সিভিল ড্রেস সরবরাহ করা। পাকিস্তানি সৈন্যরা দ্রুত শহর দখল করে ফেলে। সৈয়দবাড়ির বাসিন্দাদের চৌদ্দ পুকুরের ভিটেমাটি ছেড়ে গ্রামের পথে বেরিয়ে পড়তে হয়। আনোয়ারা থানার হাইলধরে ছিলো সৈয়দবাড়ির কর্তা সৈয়দ আবু সিদ্দিকের শ্বশুরবাড়ি। পুরো পরিবার নিয়ে তিনি সেখানেই আশ্রয় নিলেন।
এপ্রিলের ১৩/১৪ তারিখের দিকে হাইলধর থেকে গণি শহরে আসেন। এ সময় তিনি জানতে পারেন পানওয়ালাপাড়ায় আবদুল হাই সরদারের ‘সবুজবাগ’ নামাঙ্কিত বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধের জন্য কাজ হচ্ছে, স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। গণি সেখানে গিয়ে সৈয়দ ভাই’র দেখা পান। সৈয়দ ভাই তাঁকে ভারতে না গিয়ে শহরে থেকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি ও সংগঠিত হওয়ার পরামর্শ দেন। সৈয়দ ভাই একটা ট্রেনিং সেন্টার খোলেন, গণিও সেখানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ইপিআর-আর কোন হাবিলদার কিংবা কোন প্রাক্তন সৈনিক তাদের প্রশিক্ষণ দেন তা এখন আর মনে করতে পারছেন না গণি।
এরপর সৈয়দ ভাই কিছু প্রচারণামূলক কাজ শুরু করেন। এর মধ্যে ছিলো সাইক্লোস্টাইল মেশিনে ছাপিয়ে লিফলেট বিবরণ। টুকটাক অপারেশনও করেন। জুন-জুলাইর দিকে ভারত থেকে বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ একসঙ্গে শহরে চলে আসে এবং মৌলভী সৈয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ফলে মৌলভী সৈয়দকে কেন্দ্র করে বিশাল এক মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ গড়ে ওঠে। তিনি রাজনৈতিক নেতা-পলিটিক্যাল কমিশনার, অপারেশনের দায়িত্ব নেন হারুন ভাই-ইঞ্জিনিয়ার আবদুল্লাহ আল হারুন। পরে ইঞ্জিনিয়ার আফছারউদ্দিন যখন সিটি কমান্ডার হয়ে আসেন, তখন হারুন ভাই সেকেন্ড-ইন-কমান্ডার বা ডেপুটি কমান্ডার হন।
শহরের ছেলে হওয়ায় সৈয়দ আবদুল গণিকে রেকির কাজই বেশি করতে হতো। তবে অপারেশনেও অংশগ্রহণ করতেন না তা’ নয়। ফায়ার ব্রিগেড অপারেশনের কথা উল্লেখ করে বললেন তাঁদের বাড়ির সম্মুখেই ঐ অপারেশন হয়েছিলো, তাতে তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয়েছিলো।
সেদিন রাত ১২টার দিকে সাত/আটটি মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ অপারেশনটির জন্য তাদের বাড়িতে এসে অবস্থান নিয়েছিলো। অপারেশনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে যাঁদের নামগুলি মনে করতে পারলেন গণি, তাঁরা হলেন হারুন ভাই, দানু ভাই, ডা. জাফরুল্লাহ, আবু সাঈদ সর্দার, সিদ্দিক, মুকুল এবং গনি নিজে।
ওদিকে হাইলধরে থাকা গণি ও মাহমুদুল হকের পিতা সৈয়দ আবু সিদ্দিক এবং মা সৈয়দা রেজোয়ানা বেগম হাইলধরে গিয়েছিলেন নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের তৎপরতা লক্ষ করে তারা তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলেন। তারা যে বাড়িতে ছিলেন সেখানে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় প্রদান থেকে শুরু করে তাদের রান্না করে খাওয়ানো পর্যন্ত সব কাজ তারা করলেন। বিশেষ করে তাদের মায়ের মাতৃসুলভ মমতার কথা অনেক মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীনতার পর তাদের কাছে বলেছেন। তাঁরা মাঝে মধ্যে শহরে এসেও বাসায় কিছুদিন থেকে যেতেন। এসময় মুক্তিযোদ্ধাদের তাদের বাসায় আশ্রয় দিতেন এবং তাদের যত প্রয়োজন তা মেটাতেন।
৭৫’র প্রতিরোধ যুদ্ধে সৈয়দবাড়ি
পঁচাত্তরের প্রতিরোধ যুদ্ধে ‘সৈয়দবাড়ি’ই ছিলো কেন্দ্রস্থল। মৌলভী সৈয়দ এবার সৈয়দবাড়িতে অবস্থান করেই বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে চট্টগ্রাম থেকে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। তাঁর যুদ্ধকৌশল সৈয়দবাড়িতে বসেই স্থির হয় এবং সেখানে বসেই তিনি বিভিন্ন স্থানে অপারেশন চালিয়েছিলেন।
১৫ আগস্টের কথা বলতে যেয়ে সৈয়দ আবদুল গণি আমাকে বলেন, তিনি ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে শাহাদাত বরণ করেছেন এ খবর জানতেন না। তখন শুক্রবার অফিস খোলা, রবিবার ছিল ছুটি। ১৫ আগস্ট ছিল শুক্রবার, গণি তাঁদের বাসা থেকে ব্যাংকে যান একটা কাজে। তিনি আগ্রাবাদ হোটেল এলাকায় ঐ ব্যাংকে গিয়ে দেখেন কোন লোকজন নেই। সুনশান নীরবতা। রাস্তায় বের হয়ে দেখেন গাড়িঘোড়াও তেমন চলছে না। আগ্রাবাদ মোড়ে একজন পরিচিত লোকের দেখা পেলেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন কি ব্যাপার চারিদিকে এমন নিরবতা কেন, লোকজনও কেন নেই। তখন ঐ ভদ্রলোক বললেন, আপনি জানেন না বঙ্গবন্ধু মারা গেছেন ? গণি তখন বাকরুদ্ধ হয়ে তাঁদের বাসার দিকে ছুটে যান।
মৌলভী সৈয়দ গিয়েছিলেন ঢাকায়। পরদিন ১৬ তারিখ তিনি লুঙ্গি পড়ে ঢাকা থেকে সৈয়দবাড়িতে আসেন এবং গণিকে বলেন সব মুক্তিযোদ্ধাকে খবর দাও। বিশেষ করে দানু ভাই, আবু সাঈদ সরদার, লতিফ, অমল, শফি, ইউনুস, ফকির, জামালকে খবর দিতে বললেন। সবাই আসলে তাঁদেরকে নিয়ে সৈয়দ ভাই ‘সৈয়দবাড়ি’র দোতলার চিলেকোঠায় বৈঠকে বসেন। সেই বৈঠকে তারা সিদ্ধান্ত নেন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকে মেনে নেওয়া যায় না। এটা স্বাধীনতা বিরোধীদের চক্রান্ত, তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিয়েছে। তাই এই কুদেতা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম থেকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। তাঁরা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার এবং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারণার জন্য প্রথমে লিফলেট বিতরণ করা হয়। এরপর বিভিন্ন স্থানে গ্রেনেড ফাটিয়ে ও বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি চেষ্টা করা হয়। পরবর্তীকালে সরকারের পদলেহী কুকুরদের হত্যা করে তাদের মনোবল ভেঙ্গে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। একবার নিউ মার্কেট, কাজীর দেউড়ি, আলমাস, আগ্রাবাদ, দেওয়ানহাট, কোর্টবিল্ডিংসহ ১৪টি স্থানে একই সঙ্গে গ্রেনেড ফাটানো হয়।
১৯৭৬-এর আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে সৈয়দ মাহমুদুল হক ও সৈয়দ জাকারিয়াকে আগরতলায় যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেন মৌলভী সৈয়দ। তারা সেখানে গিয়ে মৌলভী সৈয়দের সঙ্গে দেখা করলে তিনি তাদের বলেন, তোমরা দেশে গিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধের জন্য সবাইকে অর্গানাইজ করো। যুবলীগ ও ছাত্রলীগ কর্মিদেরকে আমাদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর। তারা চট্টগ্রামে ফিরে এসে মৌলভী সৈয়দের নির্দেশ মত সবার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন।
চট্টগ্রামের রাজনৈতিক নেতা এবং অন্যান্য জেলার নেতৃবৃন্দের সঙ্গেও যোগাযোগ করে সৈয়দ ভাই বৃহত্তর পরিসরে আন্দোলন ছড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ইতিমধ্যে ৩ নভেম্বর জেলে জাতীয় চারনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানকে হত্যা করা হলে সৈয়দ ভাই প্রচণ্ড ক্রোধ ও প্রতিশোধ স্পৃহায় বারুদের ন্যায় জ্বলে উঠেন। তাঁর সহযোদ্ধাদের মধ্যে দাউ দাউ করে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে ওঠে।
ওদিকে প্রশাসন মৌলভী সৈয়দকে ধরার জন্য হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে। অন্যদিকে ভারতে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদকারিদের জন্য ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে খবর আসে। ভারত সরকার ৭১’র মুক্তিযুদ্ধের ন্যায় বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদকারীদের সেদেশে আশ্রয়, ট্রেনিং ও অস্ত্র সরবরাহ শুরু করে। এ পরিস্থিতিতে মৌলভী সৈয়দ ৭৬-এর মার্চে ভারতে চলে যান। তিনি সেখানে ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপন করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন।
কর্ণফুলী মার্কেটে শাপলা টেইলার্স নামে গণিদের একটি দোকান ছিলো। সেই দোকান হয়ে ওঠে যোগাযোগ কেন্দ্র। লিফলেট, চিঠিপত্র গণির কাছে আসতো। তিনি সেগুলি পৌঁছে দিতেন। ভারত থেকে যারা আসতো, তারা গণির দোকানেই আসতো। ভারতে যাওয়ার সময়ও তাঁর দোকান হয়ে যেতো।
৭৭-এর ৭ নভেম্বর এফআইও মেজর রবের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি টিম কর্ণফুলী মার্কেটে হানা দেয়। তারা পুরো মার্কেট এবং গণির দোকান ঘেরাও করে। গণিকে শাপলা টেইলার্স থেকে চিলের মত ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যায় ডবলমুরিং থানায়। সেখানে গণির ওপর বৈদ্যুতিক শকের নানা ট্রিটমেন্ট দেয়া হয়। এরপর তাকে কোতোয়ালি থানায় চালান দেওয়া হয়। সেখানে চলে আরো দু’ঘণ্টা ধোলাই, দলাই-মালাই। তারপর গণিকে নেওয়া হয় ক্যান্টনমেন্টে।
একইদিন সকালে সৈয়দবাড়ি ঘেরাও করে সৈয়দ আবদুল গণি ও সৈয়দ মাহমুদুল হকের পিতা সৈয়দ আবু সিদ্দিক, সৈয়দ মাহমুদুল হক এবং ওয়াপদা কলোনীর পাশে দীপালী সাইকেল স্টোর নামে মৌলভী সৈয়দের একটি দোকান ছিল, সেই দোকানে থাকতো জাকারিয়া, দোকান ঘেরাও করে তাঁকেও আটক করা হয় এবং সবাইকে ডবলমুরিং থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কিছু উত্তম-মধ্যমের পর সবাইকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে চালান দেওয়া হয়। সেনানিবাসে আটদিন ধরে তাদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হয়। তাদের কানে এবং পুরুষাঙ্গে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়। এরপর কোতোয়ালী থানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে মাহমুদুল হক অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আসলে মাহমুদুল হক অসুস্থতার ভান করে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটা সম্ভব হয় নি। তাঁর প্রহরায় সার্বক্ষণিক রক্ষী মোতায়েন করে তাকে চোখে চোখে রাখা হয়েছিলো। কয়েকদিন পর চট্টগ্রাম জেলে চালান দেওয়া হয়। মাসখানেক পর তাদেরকে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একটি আন্ডার গ্রাউন্ড সেলে নিয়ে জয়েন্ট ইন্টারোগেশনের মুখোমুখি করা হয়। সেখানে ১৫দিন ধরে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। এরপর তাদের হাতে অস্ত্র নিয়ে ভারতীয় দুষ্কৃতকারী আখ্যা দিয়ে ছবি তুলে টেলিভিশনে দেখানো হয়। পত্র-পত্রিকায়ও তাদের সচিত্র সংবাদ প্রকাশ করা হয়।
ওদিকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে কথা বের করার জন্য সৈয়দ আবদুল গণির ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে নিয়েও নানা রকম নির্যাতন চালিয়ে তার কাছ থেকে তথ্য আদায় করার জন্য সেনাবাহিনী আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। অত্যাচারের পাশাপাশি তাকে প্রলোভন, কখনও বা হুমকিও দেয়া হয়। বাড়ির সবাই জানতো তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছে। জয়েন্ট ইন্টারোগেশনের পর তাঁকে কোতোয়ালীতে চালান দেয়া হয়। ২১ দিন কোতোয়ালীতে রেখে তারপর জেলখানায় পাঠানো হয়। সেখানে শুনলেন তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দেয়া হয়েছে। মামলার নাম ‘রাষ্ট্র নাম মৌলভী সৈয়দ গং’, মামলা নং ৭/১১/৭৬, ৮/১১/৭৬, ৯/১১/৭৬। তবে মামলাটি ‘চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে পরিচিতি পেয়ে যায়। মামলায় মোট ১৭ জনকে আসামী করা হয়, তাঁরা হলেন-মৌলভী সৈয়দ (বাঁশখালী-চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বাকশালের সাধারণ সম্পাদক), এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী (সাবেক চসিক মেয়র ও সাবেক মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি), সৈয়দ আবদুস সাত্তার (আগ্রাবাদ), সৈয়দ আবুল গণি (আগ্রাবাদ), সৈয়দ মাহমুদুল হক (আগ্রাবাদ), অ্যাডভোকেট শ্যামল সেন (আনোয়ারা), সৈয়দ মোহাম্মদ জাকারিয়া (আগ্রাবাদ), অ্যাডভোকেট সালাউদ্দিন হারুন (সীতাকুণ্ড), নায়েক শফিউল আলম (সীতাকুণ্ড পৌরসভার সাবেক মেয়র), সুভাষ আচার্য (বাঁশখালী), শফিকুল ইসলাম (বাঁশখালী), ফকির জামাল (বাকলিয়া), ইঞ্জিনিয়ার দীপেশ চৌধুরী (পটিয়া), পীযুষ রক্ষিত (বোয়ালখালী), কেশব সেন (খিতাপচর, বোয়ালখালী), মোহাম্মদ ইউনুস (হাটহাজারী) ও মোজাম্মেল হক।
৭৭-এর জানুয়ারিতে গণির পিতা সৈয়দ আবু সিদ্দিক, সৈয়দ মাহমুদুল হক, মামাতো ভাই সৈয়দ জাকারিয়াকে ৭/৮ দিন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে রেখে ঢাকা ডিএসবিতে চালান দেয়া হয়। একদিন পর চিটাগাং জেলে পাঠানো হয়। তার আগে তাদের ছবি তুলে টিভিতে দেখানো হয়। বিবিসি, ভোয়া ও আকাশবাণী থেকে তার সংবাদ প্রচার করা হয়।
ততদিনে ভারতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়ে যায় এবং ইন্দিরার কংগ্রেস সরকারের পতন ঘটিয়ে মোরারজি দেশাইর জনতা সরকার ক্ষমতায় আসে। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদকারীদের এতদিন কংগ্রেস সরকার যে সাহায্য করে আসছিলো, এবার দেশাই সরকার সে ব্যাপারে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে। তারা সেদেশে প্রতিবাদকারীদের জন্য যে ট্রেনিং সেন্টার খোলা হয়েছিলো তা বন্ধ করে দেওয়ার এবং বাংলাদেশের বিদ্রোহীদের স্বদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। দেশাই সরকার বাংলাদেশের সামরিক শাসক জিয়ার সঙ্গে বিদ্রোহীদের স্বদেশে পাঠানোর ব্যাপারে এক চুক্তিতে উপনীত হয়। চুক্তি অনুযায়ী জিয়া সরকার বিদ্রোহীদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে নিয়ে তাদেরকে পুনর্বাসিত করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। অতঃপর ভারত থেকে বাংলাদেশের বিদ্রোহীদের পুশব্যাক শুরু হয়। বিদ্রোহীদের স্বাগত জানানোর জন্য বিভিন্ন সীমান্তে অভ্যর্থনা কেন্দ্র খোলা হয়। মৌলভী সৈয়দকে ময়মনসিংহের একটি সীমান্ত দিয়ে পাঠানো হচ্ছিলো। কিন্তু দেশে প্রবেশ করার পর সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হলেও মৌলভী সৈয়দকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। কারণ মৌলভী সৈয়দের ব্যাপারে সেনাবাহিনী ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলো। সে কারণে সেনাবাহিনী মৌলভী সৈয়দকে গোপন খবরের ভিত্তিতে ময়মনসিংহ সীমান্ত থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। যদিও তারা সুনির্দিষ্ট খবর পেয়েই মৌলভী সৈয়দকে গ্রেফতার করেছিলো, তথাপি তারা নিশ্চিত হতে পারছিলো না। সেজন্য ৭৭-এর ৬ বা ৭ আগস্ট সেনাবাহিনীর ২/৩ জন অফিসার ঢাকা জেলখানায় গিয়ে মৌলভী সৈয়দের আত্মীয় চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলায় আটক সৈয়দ আবদুল গণির সঙ্গে দেখা করে তাঁর কাছ থেকে মৌলভী সৈয়দের বাড়ির ঠিকানা জেনে নেন। মৌলভী সৈয়দের বাড়ির ঠিকানা জেনে নিয়ে সেনাবাহিনীর লোকেরা বাঁশখালী যায় এবং মৌলভী সৈয়দের পিতাকে ঢাকায় নিয়ে তাঁর সন্তানকে শনাক্ত করায়। অতঃপর মৌলভী সৈয়দের পিতাকে বাঁশখালী পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আর সেনাবাহিনীর লোকেরা মৌলভী সৈয়দকে হত্যা করে সেনা ও পুলিশের কঠোর প্রহরায় বাঁশখালী নিয়ে গিয়ে দাফন করে। সেখানে কোন মানুষকে কাছে ঘেঁষতে দেওয়া হয় নি। চারদিন পর্যন্ত কবরস্থানে সেনা প্রহরা রেখে পরে পুলিশ মোতায়েন করে আরো বেশ কিছুদিন পাহারা দেওয়া হয়।
এদিকে সৈয়দ আবদুল গণি’র মা সৈয়দা রেজোয়ানা বেগম, যিনি মৌলভী সৈয়দকে সন্তানের ন্যায় স্নেহ করতেন, তাঁকে দেশে পাঠানোর জন্য ময়মনসিংহ সীমান্তে আনা হয়েছে এ খবর পেয়ে ময়মনসিংহ সীমান্তে ছুটে যান। কিন্তু তিনি সেখানে পৌঁছার আগেই মৌলভী সৈয়দকে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি সেনানিবাসেও যান, কিন্তু তাকে দেখা করতে দেওয়া হয়নি।
স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে চট্টগ্রাম বিদ্রোহের মামলা চলেছিলো। একজন জজ, একজন কর্ণেল, একজন মেজর, একজন ক্যাপ্টেন এবং একজন ম্যাজিস্ট্রেট ট্রাইব্যুনালে শুনানী চলাকালে উপস্থিত থাকতেন। গণির মা চন্দনাইশের ব্যারিস্টার মাহবুবুল কবির চৌধুরীকে তাঁর স্বামী ও সন্তানদের জন্য আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ করেন। ব্যারিস্টার মাহবুবুল কবির চৌধুরী, অ্যাডভোকেট বদিউল আলম, অ্যাডভোকেট স্বভু প্রসাদ বিশ্বাস সহ আরো অনেকে বিদ্রোহীদের পক্ষে মামলা লড়েন। মার্শাল ল প্রত্যাহারের পর মামলা সিভিল কোর্টে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৮০ সালের ৩০ মার্চ আদালত সব আসামীকে বেকসুর খালাস দেন।
প্রতিরোধ যুদ্ধে আরো অনেকেই অংশ নিয়েছিলেন। তন্মধ্যে এসএম ইউসুফ, মহিউদ্দিন চৌধুরী, গোলাম রব্বান, কাজী ইনামুল হক দানু, আনোয়ারুল আজিম, আ.জ.ম. শামসুজ্জামান, শফিকুল আহসান, বাঁশবাড়িয়ার সাবেক চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর যিনি আগ্রাবাদ হোটেলের সামনে গ্রেনেড ফাটিয়েছিলেন প্রমুখের কথা স্মরণ করতে পারলেন সৈয়দ মাহমুদুল হক। তবে আরো বহু লোক এই বিশাল গোপন প্রতিবাদী কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়েছিলেন। যেহেতু এক সময় এসব কথা ঝুঁকির ব্যাপার ছিল তাই গোপনেই অনেকের নাম হারিয়ে গেছে।
সৈয়দ আবদুল গণি ও সৈয়দ মাহমুদুল হকের পিতা সৈয়দ আবু সিদ্দিক প্রথমে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কাজ করেন, পরে সেনাবাহিনী থেকে বেরিয়ে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের চাকরি নেন। ১৯৭২ সালে স্বেচ্ছায় অবসরগ্রহণ করেন।
সৈয়দ আবু সিদ্দিক আরব থেকে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামে আগত সৈয়দ হাসান আলীর বংশধর, যিনি আগ্রাবাদের মীর বাড়ি থেকে বিয়ে করে আগ্রাবাদেই মীর বাড়ির বিপরীতে বসতি স্থাপন করেন যা, ‘সৈয়দবাড়ি’ নামে খ্যাত হয়।
চার বছর জেল খেটে চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বেকসুর খালাস পাওয়ার পর সৈয়দ মাহমুদুল হক যখন শারারিক ও মানসিক ধকল কাটিয়ে ওঠে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনের ছন্দ খুঁজে পেলেন, তখন তিনি এক অন্য মানুষ। এবার তিনি একজন পুরোদস্তুর রাজনীতিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন। অন্যদিকে বড় ভাই সৈয়দ আবদুল গণি ব্যবসা-বাণিজ্যে মনোবিবেশ করে প্রতিরোধ যুদ্ধ ও মামলায় জড়িয়ে যে ক্ষতি হয়েছে তা’ পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলেন।
মৌলভী সৈয়দে’র স্মৃতি চট্টগ্রাম যুবলীগ, সৈয়দ মাহমুদুল হক নবোদ্যামে রাজনীতিতে নেমে খালাতো ভাইয়ের যুবলীগকেই বেছে নিলেন তাঁর রাজনীতির কর্মক্ষেত্র হিসেবে। তবে তার আগে তিনি ১৯৭৯ সালে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক, ১৯৮৬-১৯৯৬ পর দুই বছর মেয়াদে ২৪নং উত্তর আগ্রাবাদ ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং ২০০৪ সালে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ইতিমধ্যে মাহমুদুল হক এবং তাঁর বন্ধুরা যুবলীগকে পুনর্গঠিত করে সংগঠনে নতুন প্রাণের সঞ্চার করলেন। দীর্ঘদিন (১৯৯৬-২০০৩) তিনি মহানগর যুবলীগের আহবায়ক ছিলেন। বর্তমানে আওয়ামী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য পদে অধিষ্ঠিত আছেন।
আশির দশকে সৈয়দ মাহমুদুল হক স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে মামলার শিকার হন। ১৫ দলীয় জোটের আন্দোলনে তিনি জোটের ডবলমুরিং শাখা কমিটির সমন্বকারীর দায়িত্ব পালন করেন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বিরোধী আন্দোলনের সময় ২০০৫ সালে ডবলমুরিং ও পাহাড়তলী দু’থানায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে তাকে হয়রানি করা হয়।
যুদ্ধে যুদ্ধে সৈয়দ মাহমুদুল হকেরও অনেক বয়স হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে হাফ সেঞ্চুরি করে ফেলেছেন। ১৯৫৭ সালের ১ জানুয়ারি তাঁর জন্ম। ৪ কন্যা সন্তানের গর্বিত পিতা মাহমুদুল হক। স্ত্রী সৈয়দা সালেহা বেগম। তাদের প্রথম কন্যা সৈয়দা আমেনা সিদ্দিকা এনায়েত বাজার মহিলা কলেজে অধ্যাপনা করেন। তাঁর স্বামী মোশাররফ হোসেন ব্যবসায়ী। দ্বিতীয় কন্যা তাহমিনা সিদ্দিকা গৃহিনী, তাঁর স্বামী মোসাদ্দেক চৌধুরী একটি প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকরি করেন। তৃতীয় কন্যা সৈয়দা জারিন তাসনিম-সুইডেনে পড়াশোনা করছেন, তাঁর স্বামী সাকিব বিন আকতারও তাঁর সঙ্গে সেখানে অধ্যয়নরত। চতুর্থ কন্যা সৈয়দা নুসহাত তাবাসসুম চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যয়নরত।
সৈয়দ মাহমুদুল হক একজন ব্যবসায়ী। তিনি বাংলাদেশ খাদ্য পরিবহন ঠিকাদার সমিতির সভাপতি, আঞ্জুমানে মোত্তাবেয়ীনে গাউছে মাইজভাÐারী কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের মহাসচিব, দেওয়ানহাট সিটি কর্পোরেশন কলেজের গভর্ণিং বডির সদস্য, দেওয়ানহাট সিএসডি কলোনী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় স্কুল পরিচালনা কমিটির সহ-সভাপতি, সৈয়দ হাসান আলী মসজিদের মোতোয়াল্লী, মীর ও সৈয়দবাড়ি মহল্লা সমাজের প্রধান উপদেষ্টা, দেওয়ানহাট ও হালিশহর সিএসডি শ্রমিক ইউনিয়নের উপদেষ্টা, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক গোষ্ঠির উপদেষ্টা, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন চট্টগ্রাম মহানগরের সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম কোস্টার হেজ ঠিকাদার শ্রমিক ইউনিয়নের উপদেষ্টা, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির আজীবন সদস্য, মা ও শিশু হাসপাতাল, চট্টগ্রামের আজীবন সদস্য, সিদ্দিক রেজোয়ানা ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন, চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের আজীবন সদস্য এবং খুলশী ক্লাব, চট্টগ্রামের আজীবন সদস্য।
সৈয়দ মাহমুদুল হকের স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ এবং প্রতিরোধ যুদ্ধ সবসময় জীবন্ত হয়ে আছে। চার বছর কারা নির্যাতনের দগদগে স্মৃতি তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। তথাপি তাঁর কোন অনুতাপ নেই, অনুশোচনা নেই। তিনি মনে করেন দেশের জন্য, জাতির জন্য কিছু করতে পারার চেয়ে গৌরবের আর কিছু হতে পারে না। শুধু একটাই আফসোস বঙ্গবন্ধু হত্যা প্রতিবাদ করতে গিয়ে অপরিসীম অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হলেও তার কোন স্বীকৃতি নেয়। এই লেখক তাঁকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমরা যখন পরিবারের সবাই দীর্ঘ চার বছর কারাগারে ছিলাম আমার মা আমাদেরকে মুক্ত করার জন্য একাই অনেক পরিশ্রম করেছেন। এই জন্য আমাদের পরিবারের সহায় সম্পত্তি ও আমার মায়ের, আমার ভাবির গহনাপত্র বিক্রয় করতে হয়েছে। আমরা খুব অসহায় অবস্থায় পড়ে গিয়েছিলাম। তখন কিন্তু আমাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ ছিল না। এই অবস্থায় আমার মা একাই তিনটি মামলা (চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলা ১, ২, ৩) পরিচালনা করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে যে সকল নারী কষ্ট করে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন, আমি মনে করি আমার মাও সেই রকম কষ্ট করেছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ আমরা যেমন করেছি, আমার মাও সে রকম প্রতিবাদ করেছে। এই মামলার পরিচালনা করতে। গিয়ে আমাদের পরিবারের সর্বস্ব হারাতে হয়েছে। এই সব হারানোর জন্য আমাদের কোনো বেদনা নেই। আমাদের বেদনা এখানেই জাতির পিতা। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাÐের যারা প্রতিবাদ করেছি, এই প্রতিবাদ করতে গিয়ে জেল-জুলুম শিকার হয়েছি, সেই স্বীকৃতিটুকু আজও আমরা পাইনি আমরা। গর্ববোধ করি যে, জাতির পিতা হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করতে আমরা অস্ত্রহাতে তুলে নিয়েছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা, আজকে দেশে মুক্তিযুদ্ধাদের যেভাবে মূল্যায়ন করছেন। সেভাবে যদি জাতির জনক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদকারীদের মূল্যায়ন করতেন, তাহলে দেশ ও জাতির কাছে আমাদের বড় অর্জন বলে মনে হতো। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদকারীরা যারা অংশগ্রহণ করেছেন তারা সবাই স্বীকৃতি চায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেনো আমাদের দিকে সুদৃষ্টি দেবেন।
সৈয়দ মাহমুদুল হক আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইচ্ছা পোষণ করেন। সে উদ্দেশ্যে তিনি তার দল আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চাইবেন। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি দলীয় মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছিলেন।
তাঁর বড় ভাই মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আবদুল গণির জন্ম ১৯৫৩ সালের ৭ মার্চ। তিনি ১৯৬৮ সালে গোসাইলডাঙ্গা আর কে হাইস্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৭০ সালে সিটি কলেজ থেকে আই.এসসি ও ১৯৭২ সালে একই কলেজ থেকে বিএসসি পাস করেন। সৈয়দ আবদুল গণি পেশায় একজন ব্যবসায়ী। তিনি লায়ন্স ইন্টারন্যাশনালের আজীবন সদস্য, রেড ক্রিসেন্টের আজীবন সদস্য, মা ও শিশু হাসপাতালের আজীবন সদস্য, মিরেরসরাই “বিশ্ব দরবার” হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ডোনার সদস্য ও আজীবন সদস্য, আলেকজান বিবি শিশু সদনের জীবনের সদস্য।
সৈয়দ আবদুল গণির স্ত্রীর নাম সৈয়দা জারিয়া বেগম। তাঁদের দুই মেয়ে দুই ছেলে। ১ম কন্যা ডা. সৈয়দা শিরিন আখতার, সীতাকুণ্ড উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত। তাঁর স্বামী মোহাম্মদ ইমরান আহমদ সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার; ২য় কন্যা সৈয়দা পারভীন আখতার, তিনি এমবিএ পাস, কেডিএস এক্সেসরিজের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ। ছেলে সৈয়দ ফরহাদ আলাউদ্দীন, তিনি নর্থ সাউথ ও অস্ট্রেলিয়া থেকে একাউন্টিং-এ দু’বার মাস্টার্স করেছেন। তার স্ত্রী একজন ডাক্তার, নাম বিবি সখিনা-ইউএসটিসিতে ইন্টার্নি করছেন; সৈয়দ আরাফাত মহিউদ্দিন-পিজিতে এমডি কোর্সে অধ্যয়নরত।