শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’- বিরহকাতর চিরায়ত প্রেমিকের ধ্রূপদী নিদর্শন

149

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কথাসাহিত্যের ইতিহাসে একজন কিংবদন্তির নাম, যার প্রতিটি উপন্যাস জীবনধর্মী এবং সমাজের সাধারণ মানুষের কথা বলে। অত্যন্ত সহজসরল ভাষায় সাহিত্য চর্চায় অভ্যস্ত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখে গেছেন সমাজের সকল স্তরের মানুষের জন্য। তার উপন্যাসগুলো যেকোনো শ্রেণি এবং পেশার মানুষ সহজেই পড়ে তার সারমর্ম অনুধাবন করতে পারেন ফলে, সাহিত্যে তিনি পেয়েছেন ব্যাপক জনপ্রিয়তা। খুব সম্ভবতঃ সাহিত্যে এতো সহজ সরল ভাষায় সাহিত্য রচনা করে এতো জনপ্রিয়তা খুব কম সাহিত্যিকই পেয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে জীবনের বিভিন্ন চড়াই উৎরাই থেকে এবং সমাজ অনুবিক্ষণের মাধ্যমে শরৎচন্দ্র গভীর জ্ঞান অর্জন করেই তা তার প্রতিটি উপন্যাসে প্রয়োগ করতে পেরেছিলেন বলেই মৃত্যুর এতবছর পরও তিনি উপন্যাসের জন্য উপমহাদেশে এখনও সমান জনপ্রিয়। মূলতঃ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্যেকর্মগুলো অধ্যয়ন করতে তেমন একটা বোদ্ধা পাঠক হতে হয়না। সাহিত্যে তার সহজীকরণ ভাষার প্রয়োগ একজন অল্পশিক্ষিত মানুষকেও তার সাহিত্যকর্মগুলো পড়তে উৎসাহিত করে।
উপন্যাস রচনায় অত্যন্ত সিদ্ধহস্ত এই সাহিত্যিক জীবনের শেষদিন পর্যন্ত লিখে গেছেন। শরৎচন্দ্রের অনেকগুলো সৃষ্টিশীল উপন্যাসের মধ্যে “দেবদাস” উপন্যাসটি তাকে খুববেশি খ্যাতি এনে দিয়েছিল।
“দেবদাস” শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত একটি প্রণয়ধর্মী বাংলা উপন্যাস। দেবদাস শরৎচন্দ্রের প্রথমদিককার উপন্যাস। রচনার সমাপ্তিকাল সেপ্টেম্বর ১৯০০, কিন্তু প্রকাশনার বছর ১৯১৭। উপন্যাসটি নিয়ে শরৎচন্দ্রের দ্বিধা ছিল বলে দীর্ঘ ১৭ বছর প্রকাশ করা থেকে বিরত ছিলেন। উপন্যাসটি তিনি রচনা করেছিলেন মাতাল হয়ে এবং বন্ধু প্রমথনাথ ভট্টাচার্যকে ১৯১৩-তে লেখা এক চিঠিতে শরৎচন্দ্র লিখেছেন, ‘ওই বইটা (দেবদাস)একেবারে মাতাল হইয়া বোতল খাইয়া লেখা।ভারতীয় উপমহাদেশের প্রধান প্রধান ভাষায় উপন্যাসটি অনূদিত হয়েছে। পারুর জন্য দেবদাসের বিরহ উপজীব্য করে রচিত এই উপন্যাস অবলম্বনে ভারতীয় উপমহাদেশে ১৯টি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। দেবদাস বিরহকাতর চিরায়ত প্রেমিকের ধ্রæপদি নিদর্শন হিসেবে গণ্য।
উপন্যাসে দেবদাস (সম্পুর্ন নাম দেবদাস মুখার্জি) বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে তৎকালীন ব্রাহ্মন জমিদার বংশের সন্তান, পার্বতী (পারো) এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে? বাংলার তালসোনাপুর গ্রামে এই দুই পরিবারের পাশাপাশি বাস। ছোটবেলা থেকেই দেবদাস ও পার্বতীর অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব যা পরবর্তীতে প্রেমের রূপ নেয়। দেবদাস বয়সে পার্বতীর চেয়ে কিছু বড়ো। দেবদাস ও পার্বতী একে অপরকে ‘পারো’ ও ‘দেবদা’ বলে ডাকে। বিদ্যালয়ে পড়াশোনা থেকে পুকুরে মাছ ধরা পর্যন্ত প্রত্যেকটি কাজই তারা এক সঙ্গে করত? পার্বতী কিছু ভুল করলে দেবদাস তাকে মারতো, তবুও এদের সম্পর্ক বন্ধুর মতই ছিল?
ঘটনা পরম্পরায় দেবদাসকে কলকাতা শহরে পাঠানো হয় পড়াশোনা করার জন্য। কয়েক বছর পর ছুটির সময় সে তার গ্রামে ফিরে আসে। কৈশোরে উত্তীর্ণ দুজন হঠাৎই অনুভব করে, তাদের বাল্যকালের বন্ধুত্ত্ব আরও গভীর কিছুতে উত্তীর্ণ হয়েছে। দেবদাস দেখে যে তার ছোটবেলার পারো বদলে গেছে। পার্বতী তাদের কৈশোরের প্রেম বিবাহবন্ধনে পরিস্ফুটনের কথা ভাবে। প্রচলিত সামাজিক রীতি অনুযায়ী, পার্বতীর বাবা-মাকে দেবদাসের বাবা-মায়ের কাছে তাদের বিবাহের প্রস্তাব আনতে হবে।
পার্বতীর মা দেবদাসের মা হরিমতির কাছে বিয়ের প্রস্তাব আনলে তিনি আনন্দিত হলেও পাশের বাড়ির সাথে এই সম্পর্ক রাখতে তিনি বিশেষ উৎসাহী হননা। তাছাড়া পার্বতীর পরিবারে দির্ঘকাল থেকে বরের পরিবার থেকে ‘পণ’ গ্রহনের প্রথা চলে আসছে। দেবদাসের মা তাই পার্বতীর পরিবারকে “বেচা-কেনা ছোটঘর” মনে করে এই সম্পর্কে অসম্মত হন। দেবদাসের বাবা, নারায়ণ মুখার্জিও এই যুক্তি সমর্থন করেন। এতে পার্বতীর পিতা নীলকন্ঠ চক্রবর্তী অপমানিত বোধ করেন ও পার্বতীর জন্য আরও ধনী গৃহে বিয়ে ঠিক করেন।
পার্বতী একথা জানলে দেবদাস অন্তত তাকে গ্রহন করবে এই আশায় রাতের অন্ধকারে তার সাথে দেখা করে। দেবদাস মনস্থির করে তার বাবাকে বললে, তিনি অরাজি হন।
বিভ্রান্ত অবস্থায়, দেবদাস বাড়ি থেকে কলকাতায় পালিয়ে যায়। সে চিঠি লিখে পার্বতীকে জানায় যে সে এই সম্পর্ক আর রাখতে চায় না।
পার্বতী বিয়ের জন্য প্রস্তুত হয়। এরপর দেবদাস বললেও আর সে ফিরে যেতে চায় না ও কাপুরুষতার জন্য তাকে ধিক্কার জানায়। তবুও, সে দেবদাসকে বলে যে তার মৃত্যুর আগে যেন সে দেবদাসকে অন্তত একবার দেখতে পায়। দেবদাস এই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়।
দেবদাস কলকাতায় ফিরে যায় ও পার্বতীর হাতিপোতা গ্রামে ভুবন চৌধুরী নামে এক জমিদারের সাথে বিয়ে হয়। ভুবন চৌধুরীর পূর্বের স্ত্রী মারা গেছেন ও তার তিনজন সন্তান রয়েছে, যারা পার্বতীর প্রায় সমবয়সী বা তার চেয়ে বড়ো।
কলকাতায় গিয়ে দেবদাসের চুনীলালের সাথে বন্ধুত্ব হয় ও তার মাধ্যমে সে চন্দ্রমুখী নামে এক বাঈজীর সাথে পরিচিত হয়। সে দেবদাসের প্রেমে পড়ে, যদিও দেবদাস তাকে ঘৃণা করতে থাকে। হতাশাগ্রস্ত দেবদাস অত্যধিক মদ্যপান শুরু করলে তার শরীর ক্রমশ ভেঙে পড়ে। চন্দ্রমুখী তার দেখভাল করতে থাকে। দেবদাস তার মনে প্রতিনিয়ত পার্বতী ও চন্দ্রমুখীর তুলনা করতে থাকে ও চন্দ্রমুখীকে সে পারোর কথা বলে। দুঃখ ভুলতে দেবদাস ক্রমশ মদ্যপানের মাত্রা বাড়াতে থাকে ও তাতে তার স্বাস্থ্যের চরম অবনতি ঘটে। চন্দ্রমুখী বুঝতে পারে যে দেবদাসের ভিতরের আসল মানুষটির আজ পতন ঘটেছে। লক্ষ্যশূন্য দেবদাস শেষপর্যন্ত চন্দ্রমুখীর প্রেমে পড়তে বাধ্য হয়।
শীঘ্র আসন্ন মৃত্যুর কথা অনুভব করতে পেরে দেবদাস, পারোকে দেওয়া তার পূর্বের প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করতে হাতিপোতা গ্রামে পার্বতীর কাছে রওনা হয়। পার্বতীর বাড়ির সামনে পৌঁছে, এক অন্ধকার শীতের রাতে দেবদাসের মৃত্যু হয়। দেবদাসের মৃত্যুর খবর শুনে পার্বতী সেখানে ছুটে যায়, কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর আগেই, বাড়ির লোকজন তাকে বাড়ির চৌকাঠ অতিক্রম করতে দেয়না।
শরৎচন্দ্র তার অন্যান্য অনেক উপন্যাসগুলির মতো এটিতেও তৎকালীন বঙ্গসমাজের নিষ্ঠুরতার চিত্র কঠোরভাবে তুলে ধরেছেন, যে সমাজব্যবস্থা এক সত্যিকারের প্রেমের শুভ পরিনতির এক বৃহৎ বাধা হয়ে দাঁড়ায়। প্রকৃতপক্ষে দেবদাস উপন্যাসটি শরৎচন্দ্রের প্রথম দিককার রচনা হলেও এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার পরপরই তিনি বাজিমাত করেছিলেন। এই উপন্যাসটি লিখার সময় তিনি ব্যাপক কাটাছেড়া করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত এই উপন্যাসটি প্রকাশের জন্য সময়ও নিয়েছিলেন বিস্তর কিন্ত একেবারের শেষের দিকে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন উপন্যাসটি তিনি প্রকাশ করবেন এবং প্রকাশও করেছিলেন। দেবদাস উপন্যাসটির ঘটনা মূলতঃ প্রণয় সম্পর্কিত হলেও শরৎচন্দ্র তার লিখনিতে এমনকিছু ঘটনা যুক্ত করেছিলেন যা তৎকালিন সমাজব্যবস্থার বাস্তব চিত্র ফুটে ওঠেছে আর তাই সাহিত্যপ্রেমিরা উপন্যাসটি গিলেছেন একেবারে গোগ্রাসে।
বাস্তব জীবনে শরৎচন্দ্র এমন প্রেমে পড়েছিলেন কীনা তা জানা যায়নি কিংবা হয়ত তিনি প্রেমে পড়েছিলেন সমাপ্তিটা অন্যরকম ছিল।
উপন্যাটিতে শরৎচন্দ্র প্রণয়ের কারণে দেবদাসের করুণ পরিণতি চিত্র সিদ্ধ হস্তে ফুটিয়ে তুললেও অনেক সাধারণ পাঠক দেবদাসের মৃত্যুকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। প্রকৃতপক্ষে এখানেই লেখকের স্বার্থকতা। শরৎচন্দ্র যে তার দেবদাস উপন্যাসটির ঘটনা দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের সকল প্রেমিকদের হৃদয়ে নাড়া দিতে পেরেছিলেন তা উপন্যাসটি পড়লেই বোঝা যায়। শরৎচন্দ্রের এই উপন্যাসটি প্রেম-বিরহে মানুষকে এতোবেশি নাড়া দিয়েছিল যে, এখনও কোনো প্রেমিক তার প্রেমিকাকে পেতে ব্যর্থ হলে “দেবদাস” শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন যা উপন্যাসটির শতভাগ স্বার্থকতাই নির্দেশ করে।
একটি প্রেমের নিদারুণ করুন পরিণতির কাহিনী “দেবদাস” উপন্যাসটিতে উপস্থাপিত হলেও শরৎচন্দ্রের বলিষ্ঠ লেখনিতে তা আজ পাঠকের কাছে এক কিংবদন্তির উপন্যাস হিসেবে পরিগণিত।
“দেবদাস” উপন্যাসটির ঘটনা প্রবাহ যেভাবে আবর্তিত হয়েছে এবং এটি শেষ পর্যন্ত যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে তা পাঠক উপন্যাসটি শেষ অবধি না পড়া পর্যন্ত বুঝতে পারেনি আর তাই পাঠক উপন্যাসটি পড়েছে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে। পাঠককে উপন্যাস কিংবা গল্পের মধ্যে নিমজ্জিত করে রাখার দক্ষতা বাংলা সাহিত্যে গুটিকয়েক সাহিত্যিকেরই ছিল, তারমধ্যে অন্যতম ছিল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
প্রকৃতপক্ষে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যে উপন্যাস বিপ্লব শুরু করেছিলেন
সে বিপ্লব তিনি ধরে রাখতে পেরেছিলেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এমনকী তার মৃত্যুর এতবছর পরও তিনি সাহিত্যে অপরাজেয় কথাশিল্পীর মুকুটই পড়ে আছেব, যে মুকুট,এখনও পর্যন্ত কেউ ছিনিয়ে নিতে পারেনি। সত্যই বাংলা সাহিত্যে এক বিরলপ্রজ প্রতিভার অধিকারি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।