শর্তসাপেক্ষে জামিন পেলেন স্ত্রী মিন্নি

41

বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় হাই কোর্ট থেকে শর্তসাপেক্ষে জামিন পেলেন তার স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি। আদালত বলেছে, জামিনে থাকা অবস্থায় ১৯ বছর বয়সী ওই তরুণী তার বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোরের জিম্মায় থাকবেন। আর এই সময়ে মিন্নি গণমাধ্যমের সামনে কোনো কথা বলতে পারবেন না। মিন্নির জামিন প্রশ্নে এক সপ্তাহ আগে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাই কোর্ট বেঞ্চ গতকাল বৃহস্পতিবার এই রায় দেয়। মেয়ের জামিন হওয়ায় আদালতে উপস্থিত মোজাম্মেল হোসেন কিশোর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বলেন, আমি খুব খুশি যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দুষ্কৃতিকারীরা যেগুলো করতেছে, এগুলো সব জনসম্মুখে প্রচার পেয়েছে।
মিন্নির বাবা অভিযোগ করে আসছেন, ‘নির্যাতন করে ও ভয়ভীতি দেখিয়ে’ মিন্নিকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করেছে পুলিশ। এর পেছনে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের হাত আছে বলেও তার দাবি। খবর বিডিনিউজের
মিন্নির আইনজীবী জেডআই খান পান্না রায়ের পর সাংবাদিকদের বলেন, মিন্নির জামিন মঞ্জুর হয়েছে। তবে তার প্রতি একটা নির্দেশনা আছে। সে মিডিয়ার সামনে কথা বলতে পারবে না।
অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সারোয়ার হোসেন বাপ্পি বলেন, এ রায়ে আমরা মর্মাহত। রাষ্ট্রপক্ষ এ রায়ের বিরুদ্ধে নিয়মিত লিভ টু আপিল করবে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, জামিনে আদালত শর্ত দিয়েছেন। সে (মিন্নি) জামিনের অপব্যবহার করলে নিম্ন আদালত তার জামিন বাতিল করতে পারবে।
গত ২৬ জুন রিফাতকে বরগুনার রাস্তায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করার সময় তাকে বাঁচাতে তার স্ত্রী মিন্নির মরিয়া চেষ্টার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সারাদেশে আলোচনার সৃষ্টি হয়। রিফাতের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফের করা মামলায় মিন্নি ছিলেন প্রধান সাক্ষী। কিন্তু মিন্নির শ্বশুরই পরে হত্যাকান্ডে পুত্রবধূর জড়িত থাকার অভিযোগ তোলেন। হত্যাকান্ডের তিন সপ্তাহ পর মিন্নিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, রিফাত হত্যা পরিকল্পনায় তার স্ত্রীও জড়িত ছিলেন।
বরগুনার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালত এবং জেলা ও দয়েরা জজ আদালতে মিন্নির জামিন আবেদন নাকচ হয়ে যাওয়ায় হাই কোর্টে আসেন তার আইনজীবীরা। ২০ আগস্ট আংশিক শুনানি নিয়ে রুল জারি করে আদালত।
সেই রুলের ওপর শুনানি শেষেই বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণা করে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাই কোর্ট বেঞ্চ।
রায়ে জ্যেষ্ঠ বিচারক বলেন :
এজাহারে আসামির নাম উল্লেখ না থাকা; গ্রেপ্তারের আগে দীর্ঘ সময় মিন্নিকে পুলিশ লাইনসে আটক রাখা এবং গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়া; আদালতে হাজির করে রিমান্ড শুনানির সময় তার আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ না পাওয়া; ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক লিপিবদ্ধ করার আগেই আসামির দোষ স্বীকার সম্পর্কিত জেলা পুলিশ সুপারের বক্তব্য; তদন্তকারী কর্মকর্তার মতে মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে, সুতরাং আসামি কর্তৃক তদন্ত প্রভাবিত করার কোনো সুযোগ না থাকায়; সর্বোপরি ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৭ ধারার ব্যতিক্রম, অর্থাৎ আসামি একজন নারী- এ বিষয়গুলো বিবেচনা করে আমরা তাকে জামিন দেওয়া ন্যায়সঙ্গত মনে করছি এবং জারি করা রুলটি আমরা যথাযথ ঘোষণা করলাম। সে তার বাবার জিম্মায় থাকবে এবং মিডিয়ার সামনে কোনো কথা বলতে পারবে না।
রিফাতকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার ঘটনার পর বরগুনার সরকারি কলেজের ডিগ্রি প্রথম বর্ষের ছাত্রী মিন্নি বলেছিলেন, হামলাকারী সবাইকে তিনি চিনতে পারেননি। তবে সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন বন্ড এবং তার সহযোগী দুই সহোদর রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজীর নাম তিনি বলেছিলেন।
রিফাতের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ গত ২৭ জুন যে মামলা করেছিলেন, সেখানেও আসামির তালিকায় প্রথম তিনটি নাম ছিল নয়ন এবং দুই ফরাজী ভাইয়ের। এ মামলার প্রধান আসামি নয়ন গত ২ জুলাই ভোরে পায়রা নদীর তীরে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
বরগুনা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের ভায়রার ছেলে রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজীসহ মোট ১৫ জন এ মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন।
ওই হত্যাকান্ডের পেছনে মাদকের কারবার ও ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী দুই নেতার দ্বন্দ্বের যোগসূত্র নিয়ে আলোচনার মধ্যেই গত ১৬ জুলাই মিন্নিকে বরগুনার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। পরে সেদিন রাতে তাকে রিফাত হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
পরদিন আদালতে হাজির করা হলে বিচারক তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে পাঠান। কিন্তু মিন্নির পক্ষে কোনো আইনজীবী সেদিন আদালতে দাঁড়াননি, যা নতুন আলোচনার জন্ম দেয়। পাঁচ দিনের রিমান্ডের তৃতীয় দিনেই মিন্নিকে আদালতে হাজির করা হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, ওই তরুণী হাকিমের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
তার আগের দিনই পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, মিন্নি হত্যাকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা এবং হত্যা পরিকল্পনাকারীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। মিন্নিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে হত্যা পরিকল্পনার সঙ্গে মিন্নির যুক্ত থাকার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ।
বরগুনা সরকারি কলেজের স্নাতকের এই ছাত্রী পরে জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন করেন জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে। কিন্তু বিচারক সেটি ফেরত দিলে মিন্নির আইনজীবীরা তার জামিনের জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন।
বৃহস্পতিবার হাই কোর্টে মিন্নির জামিন হওয়ার পর তার বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর সাংবাদিকদের বলেন, আমি আন্তরিকভাবে গর্বিত যে, আমি সুন্দর একটা রায় পেয়েছি। এটি আমার বিজয়। সমস্ত চক্রান্তেরও অবসান হবে।
আদালতের পর্যবেক্ষণ :
মিন্নিকে গ্রেপ্তার এবং তার জবানবন্দি নিয়ে পুলিশের ভূমিকা হাই কোর্টে জামিন শুনানিতে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক রায়ের পর্যবেক্ষণেও পুলিশ সুপারের আচরণ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বলেছেন, আসামি আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি রিমান্ডে থাকা অবস্থায় বরগুনা জেলার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন গণমাধ্যমের সম্মুখিন হন। মিন্নি দোষ স্বীকার করেছেন মর্মে যে বক্তব্য তিনি দিয়েছেন, তা শুধু অযাচিত, অনাকাক্সিক্ষত নয় বরং সুষ্ঠ এবং নিরপেক্ষ তদন্তের পরিপন্থি।
পরিস্থিতি ও বাস্তবতা যাই হোক না কেন, পুলিশ সুপারের মত দায়িত্বশীল পদে থেকে মারুফ হোসেন যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে বলে মন্তব্য করেন বিচারক।
তিনি বলেন, একদিকে যেমন জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেন, তেমনি তিনি তার দায়িত্বশীলতা ও পেশাদারিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, তা দুঃখজনক এবং হতাশাজনক। উচ্চ পর্যায়ের একজন পুলিশ কর্মকর্তার নিকট হতে এ ধরনের কাজ প্রত্যশিত বা কাম্য নয়। ভবিষ্যতে দায়িত্ব পালনে তিনি আরও সতর্কতা ও পেশাদারিত্বের পরিচায় দেবেন- আদালতের এটাই কাম্য।
বিচারক বলেন, মামলাটির তদন্ত কাজ যেহেতু এখনও চলছে, সে কারণে এ মুহূর্তে এ বিষয়ে ‘চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত’ নেওয়া থেকে আদালত বিরত থাকছে। তবে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শককে ‘সময়মত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে’ বলেছে আদালত।
পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ইদানিং প্রায়শ লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, সংগঠিত আলোচিত ঘটনার তদন্তকালীন সময়ে পুলিশ, র‌্যাবসহ বিভিন্ন আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গ্রেপ্তারকৃত অভিযুক্তদের বিষয়ে এবং তদন্ত সম্পর্কে প্রেস ব্রিফিং করা হয়ে থাকে। গ্রেপ্তারকৃত সন্দেহভাজন বা অভিযুক্তদের কোনো নিয়মনীতি ছাড়াই গণমাধ্যমের সামনে হাজির করা হয়, যা অনেক প্রশ্নের উদ্রেক করে। যদিওবা এ বিষয়ে অত্র আদালতে একটি রায়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।
অনেক পুলিশ কর্মকর্তাকে তদন্ত বিষয়ে অতি উৎসাহ নিয়ে বিভিন্ন বক্তব্য দিতে দেখা যায়। এ কথা আমাদের সকলকেই মনে রাখতে হবে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো অভিযুক্তের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রমাণের মাধ্যমে অভিযোগ প্রমাণিত না হচ্ছে, ততক্ষণ বলা যাবে না সে অপরাধী বা অপরাধ করেছে।
তদন্ত বা বিচার পর্যায়ে এমনভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করা উচিৎ নয় যেন মনে হয় অভিযুক্ত ব্যক্তি অপরাধী। সে কারণে মামলার তদন্ত পর্যায়ে তদন্তের অগ্রগতি বা গ্রেপ্তারকৃতদের বিষয়ে গণমাধ্যমে কতটুকু বিষয় প্রচার বা প্রকাশ করা যাবে, সে বিষয়ে একটি নীতিমালা করা বাঞ্ছনীয়। এই নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রচারের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের মহাপরিদর্শককে নির্দেশ প্রদান করা হল।