শব্দ দূষণ : আমলে না নেওয়া এক ভয়ংকর ঝুঁকি

14

নিজস্ব প্রতিবেদক

শব্দদূষণকে বলা হয় নীরব ঘাতক। বিশেষ করে নগরে শব্দদূষণের বহু উৎস রয়েছে যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। গাড়ির হর্ন, নির্মাণকাজ, মাইকের ব্যবহার, শিল্পকারখানা কোন ক্ষেত্রেই শব্দদূষণ বিষয়ে যেসব নিয়ম রয়েছে তা মানা হচ্ছে না। কিন্তু বাংলাদেশে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে যে বিধিমালা রয়েছে সেখানে বিস্তারিত বলা আছে কোন এলাকায়, দিনের কোন সময়ে, কোন ধরনের শব্দের মাত্রা কেমন হবে। আর তা না মেনে চললে সাজার বিধানও রয়েছে। এমনকি ঘোষিত ‘নো হর্ন’ জোনেও নির্দেশনা মানার মানসিকতার চর্চার বালায় নেই। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন সচেতন মহল, একইসাথে ভয়ংকর ঝুঁকিময় হয়ে উঠছে পরিবেশ। এমনটাই মনে করছেন পরিবেশবিদরা।
গাড়ির যাচ্ছেতাইভাবে হর্ন, হাইড্রোলিক হর্নের ছড়াছড়ি ছাড়াও নগরজুড়ে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রায়শই দেখা যায় দিন নেই রাত নেই পাইলিং-এর কাজ, ইট ভাঙার যন্ত্র, সিমেন্ট মিক্সারের যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। সময় সম্পর্কে কোন বালাই নেই। বাংলাদেশে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের অধীনে শব্দদ‚ষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা রয়েছে। তাতে বলা আছে সন্ধ্যা সাতটা থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত নির্মাণকাজের এসব যন্ত্র চালানো যাবে না। আবাসিক এলাকার শেষ সীমানা থেকে ৫০০ মিটারের মধ্যে নির্মাণ কাজের জন্য ইট বা পাথর ভাঙার মেশিন ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু শহরে আবাসিক এলাকার শেষ সীমানা বলে আসলে কিছু নেই। কারো ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছে কিনা, শিশুদের পড়াশুনার ক্ষতি, অসুস্থ ও বয়স্ক ব্যক্তিদের কষ্ট কোন কিছুই অসময়ে নির্মাণ কাজ থামাতে পারে না। আবদ্ধ কোন স্থানে শব্দ করলে শব্দ যাতে বাইরে না যায় তা নিশ্চিত করতে হবে। যদিও ভবনে কোন ধরনের নতুন কাজ, ড্রিল মেশিনের, অফিসের ডেকোরেশনে নিয়মিতই ভঙ্গ হচ্ছে এই নিয়ম। হর্নের এমন শব্দ সন্ত্রাসের সময়ে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের (বিএইচআরএফ) উদ্যোগে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সামনে গতকাল সকালে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহারের প্রতিবাদ ও বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন করেছে। হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধসহ চট্টগ্রাম মহানগরীর ২১ স্পটকে নো-হর্ন স্পট ঘোষণার দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।
দূষণমুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষে আয়োজিত এ মানববন্ধন বিএইচআরএফ চট্টগ্রাম জেলা শাখার সভাপতি জিয়া হাবীব আহ্সানের সভাপতিত্বে ও মাহামুদুর রহমান শাওনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত হয়। মানববন্ধনে ‘শব্দ সন্ত্রাস’ বন্ধের পাশাপাশি নগরীর টাইগারপাস, বাটালি হিল, জিলাপি পাহাড়, কোর্ট হিল এলাকা, সিআরবি, ডিসি হিল, সার্সন রোড, জাম্বুরী ফিল্ড, ফয়েজ লেক, বায়েজিদ লিংক রোড, ওমেন ভার্সিটি এলাকা, সি বিচ এলাকা, ঝাউতলা, নাসিরাবাদ সরকারি বালিকা বিদ্যালয়, গোলপাহাড়, প্রবর্তক, চট্টেশ্বরী, মেহেদীবাগ, ওআর নিজাম রোড, এমএম আলী রোড, কে বি ফজলুল কাদের রোড প্রভৃতি এলাকাকে হর্ন মুক্ত ‘নিরব এলাকা’ (নো হর্ন স্পট) ঘোষণার দাবি জানানো হয়। যেসব এলাকায় হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে এর প্রাকৃতিক পরিবেশ ও প্রতিবেশ সুরক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। এজন্য এসব এলাকাকে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণারও দাবি জানানো হয়। সামাজিক এ আন্দোলন বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সবার একান্ত সহযগিতার জন্য আহবান জানানো হয়।
অন্যদিকে শব্দদূষণের কারণে দুশ্চিন্তা, উগ্রতা, উচ্চ রক্তচাপ, টিন্নিটাস, শ্রবণশক্তি হ্রাস, ঘুমের ব্যাঘাতসহ অন্যান্য ক্ষতিকর ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটতে পারে। এছাড়াও, অন্যান্য শারীরিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে স্মরণশক্তি হ্রাস, মানসিক অবসাদে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিনদিন আশঙ্কজনকভাবে বাড়ছে। এমনকি ভুক্তভোগীদের মধ্যেই সচেতনতা বিরাজ করছে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আদর্শমান মতে, আবাসিক এলাকায় রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত শব্দের সহনীয় মাত্রা ৪৫ ডেসিবেল। দিনের বেলা ৫৫ ডেসিবেল। বাণিজ্যিক এলাকায় দিনের বেলা ৭০ এবং রাতের বেলায় ৬০ ডেসিবেল। তাছাড়া হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের আশপাশের ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এখানে রাতে শব্দের সহনীয় মাত্রা ৪০ ও দিনে ৫০ ডেসিবেল। শব্দের এসব সহনীয় মাত্রা কোথাও মানা হয় না। নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি থাকে শব্দের মাত্রা। সর্বত্রই নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ব্যবহার হচ্ছে হাউড্রোলিক হর্ন। দিন-রাত যানবাহনে প্রতিযোগিতা করে বাজানো হয় উৎকট ও বিকট আওয়াজের হাউড্রোলিক হর্ন। স্বাস্থ্যগত ক্ষতির শিকার হচ্ছেন শিশু-কিশোর ও বৃদ্ধরা। পক্ষান্তরে, পরিবেশ অধিদফতর ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন গত বছরের ১৯ আগস্ট নগরের চমেক হাসপাতাল ও ডা. খাস্তগীর বালিকা উচ্চবিদ্যালয় এলাকাকে ‘নো হর্ন জোন’ ঘোষণা করে। কিন্তু কোথাও মানা হয় না এ নির্দেশনা। উল্টো উধাও হয়ে গেছে নির্দেশনার সাইনবোর্ড।