শব্দদূষণ: সচেতনতা জরুরি

47

মুফিদুল আলম

বাংলা ব্যাকরণ পাঠে শব্দ কাকে বলে, কত প্রকার ও কি কি- এ সম্পর্কে প্রচুর আলোচনা রয়েছে। তাছাড়া শব্দের উৎপত্তিস্থল, ধ্বনি, প্রকরণ নিয়েও কম আলোচনা ব্যাকরণ শাস্ত্রে নেই। কোনটি দেশি-বিদেশি, তৎসম, অর্ধতৎসম তা নিয়ে ও শিক্ষার্থীদের থাকে প্রচÐ মাথাব্যথা। কিন্তু যে বিষয়টি অবাক করার মতো তাহলো শব্দ গঠন কম-বেশি সকলের জানা আছে, শব্দদূষণ কি তা আমরা অনেকে জানিনা। এই নিবন্ধের আলোচ্য বিষয়- শব্দ দূষণ ও এর প্রতিকার নিয়ে একগুচ্ছ ভাবনা তুলে ধরা।
কয়েকটি বর্ণ মিলে একটি শব্দ। বাক্য হলো দুই বা ততোধিক শব্দের সমষ্টি। মনের ভাব প্রকাশের বাহন। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে পরিমিতভাবে সৃষ্টি করেছেন। পঞ্চ ইন্দ্রিয় উপহার দিয়ে এর ব্যবহার ও বলে দিয়েছেন। যথেচ্ছা ব্যবহারে শাস্তির কথা বলেছেন। পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মধ্যে অন্যতম হলো জিহবা। জিহবার যথাযথ ব্যবহারে পরকালে জান্নাতের গ্যারান্টির কথা উল্লেখ আছে। আবার এর অপব্যবহারে কঠোর শাস্তির বিধান বর্ণিত রয়েছে। অপ্রয়োজনীয় শব্দাবলির জোরে জোরে উচ্চারণ যখন সহনশীল মাত্রা ছেড়ে মানুষের বিরক্তি ও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাকে শব্দ দূষণ বলা হয়। শব্দ দূষণকে অনেকে ‘শব্দ সন্ত্রাস’ নামেও অভিহিত করেন। এখানে মুখ্য বিষয় তিনটি যথা-জোরে জোরে উচ্চারণ, অসহনশীল মাত্রা ও মানুষের ক্ষতি। এ তিনটি বিষয় কোন বিবেচনায় গ্রহণযোগ্য নয়।
মানুষের জ্ঞান এবং ক্ষমতা সসীম। প্রকৃতি নির্ধারিত। মানুষ কিছু ক্ষেত্রে প্রাণির চেয়েও দূর্বল। শক্তিমত্তা, দৃষ্টিশক্তি, ক্ষিপ্রতা এসব বিবেচনায় প্রাণিকুল এর অবস্থান মানুষের অবস্থানের ঊর্ধ্বে। বাদুর প্রায় ১ (এক) লক্ষ হার্জ কম্পাংকের শব্দ তৈরি ও শুনতে পায়। অপরদিকে মানুষের সীমা ২০-২০,০০০ হার্জ। অতএব মানুষের অহংকারের জায়গা খুবই সীমিত। বিবেক-বুদ্ধি আর উন্নত চরিত্র ছাড়া খুব একটা দেখিনা। পবিত্র কুরআনের সূরা হুজরাতের ২ নং আয়াতে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সাথে সাহাবিদের শব্দচয়ন কেমন হবে তার ইংগিত পাওয়া যায়। ‘হে মুমিনগণ! নিজেদের আওয়ায রসূলের আওয়াজের চেয়ে উঁচু করো না এবং উচ্চস্বরে নবীর সাথে কথা বলো না, যেমন তোমরা নিজেরা পরস্পর বলে থাকো। এমন যেন না হয় যে, তোমাদের অজান্তেই তোমাদের সব কাজ-কর্ম ধ্বংস হয়ে যায়’। একইভাবে বাজে কথা, অনর্থক কথা এসব বিষয় পরিহার করার জন্য মহান আল্লাহ ইমানদারদের প্রেরণা দিয়েছেন (সূরা-আল মুমিনুন-৩)। সুতরাং অপ্রয়োজনীয় কার্যক্রম থেকে সৃষ্ট শব্দ দূষণ এর স্থান ইসলামে খুব বেশি আছে বলে মনে হয়না।
পৃথিবীতে সবকিছু পরিমাপের একটি একক রয়েছে। স্ট্যান্ডার্ড আছে। এটি বৈজ্ঞানিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত। স্থানভেদে শব্দ প্রয়োগ পাঁচটি ক্যাটাগরিতে বিভক্ত। সকল ক্যাটাগরিতে গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৪০-৭০ ডেসিবল। জাতিসংঘের মতে মানুষের সহ্য সীমা ৪৫ ডেসিবল। প্রতিদিন একজন মানুষ ১৩০ ডেসিবল শব্দের মধ্যে ১ সেকেন্ডের কম এবং ৮৫ ডেসিবল শব্দের মধ্যে সর্বোচ্চ ৮ ঘন্টা সময় অবস্থান করতে পারে। এর কম বা বেশির মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। আবাসিক এলাকা ও বাণিজ্যিক এলাকার মধ্যে প্রভেদ রয়েছে। আবার বাণিজ্যিক এলাকা ও হাসপাতাল এলাকার মধ্যে তফাৎ আছে। এ তফাতের কারণ মানুষের অবস্থান, পেশা ও প্রয়োজনের ভিন্নতা ছাড়া আর কিছু নয়। এসব জায়গায় শব্দের ভিন্ন ভিন্ন গ্রহণযোগ্য মাত্রা রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, আবাসিক এলাকায় গ্রহণযোগ্য মাত্রা দিনে ও রাতে ৫৫:৪৫, বাণিজ্যিক এলাকায় ৬৫:৫৫, হাসপাতাল এলাকায় ৫০:৪০, শিল্প এলাকায় ৭৫:৬৫। নির্ধারিত মাত্রার অতিরিক্ত শব্দের প্রয়োগ কোন অবস্থাতেই কাম্য নয়।
বাংলাদেশের শব্দ দূষণের কী অবস্থা? একবাক্যে বললে বলা যায়, অবস্থা মোটেও সুখকর নয়। দা ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজ্যান্স এর তালিকায় বিশ্বের অনুপযোগী দেশের তালিকায় বাংলাদেশ অন্যতম। এর কারণ হিসেবে তারা শব্দ দূষণকে চিহ্নিত করেছেন। সারা বিশ্বে শতকরা ৫ ভাগ লোক শ্রবণজনিত সমস্যায় ভোগে তার বিপরীতে বাংলাদেশে ১২% লোক শ্রবণ সমস্যায় ভুগছে। তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায় বাংলাদেশে কোন কোন স্থানে বিশেষ করে ঢাকা শহরে শব্দের দূষণ নির্ধারিত মাত্রার দেড় গুণ। পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক ২০১৬-১৭ সালে আটটি বিভাগীয় শহরে শব্দ দূষণের উপর জরিপ পরিচালনা করা হয়। জরিপে দেখা যায় শব্দ দূষণ সবচেয়ে বেশি ঢাকায় আর কম হলো রাজশাহীতে। ঢাকার শ্যামলীতে ১০ মিনিটে শব্দ দূষণ হয় ৬০০ বার। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ এর নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ জনাব ডা. মনি লাল এর মতে ঢাকার মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ কানে কম শোনেন। এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি অশনিসংকেত।
শব্দ দূষণের কারণগুলোকে মোটাদাগে তিনভাগে ভাগ করা যায়। ১। ব্যক্তিগত ২। সামাজিক ও ৩। রাজনৈতিক কারণ। ব্যক্তিগত কারণ হিসেবে মোবাইল ফোনে চিৎকার করে কথা বলা, হাই সাউন্ডে গান শোনা, বাড়ির টাইলস লাগাতে গিয়ে খটমট আওয়াজ সৃষ্টি, ড্রিল মেশিনের ব্যবহার, গাড়িতে হর্নের যথেচ্ছ ব্যবহার (পরিবেশ অধিদপ্তরের মতে সবচেয়ে বেশি শব্দ দূষণ হয় গাড়ির হর্ণ ব্যবহারে) ইত্যাদির বর্ণনা দেয়া যায়। সামাজিক কারণ হিসেবে বিয়ে, পূজা পার্বণ, ওয়াজ মাহফিল, বিভিন্ন উৎসব, মেলায় শব্দ দ‚ষণের সম্ভাবনা বেশি। সভা, সমাবেশ, মিছিল, মিটিং ইত্যাদি রাজনৈতিক কর্মসূচিও মারাত্মক শব্দ দূষণ করে।
শব্দ দূষণ এর প্রভাব মানুষ খালিচোখে সহজে অনুমান করতে পারেনা। এটি দৃশ্যমান অপরাধ হলেও কিন্তু অনেকের নিকট অপরাধ হিসেবে বিবেচিত নয়। তাছাড়া ৯০ এর দশকের পর হতে এদেশে শব্দ দ‚ষণ নিয়ে কাজ হচ্ছে। এর পূর্বে এটিকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ইতিমধ্যে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। বিশেষ করে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি বেশি। শারীরিক ক্ষতির মধ্যে বধির হয়ে যাওয়া, স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া, মাতৃগর্ভের সন্তান নষ্ট হয়ে যাওয়া, ভালো ঘুমের সংকট হওয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এক গবেষণায় দেখা গেছে ট্রাফিক পুলিশদের প্রায় ১১% শ্রবণ সমস্যায় ভুগেন। আমেরিকান হার্ট এসোসিয়েশন এর মতে শব্দের মাত্রা ১০ ডেসিবল বৃদ্ধি পেলে স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায় ১৪ ভাগ। ৬৫ বছরের অধিক বয়স্কদের ক্ষেত্রে এ হার ২৭%। মানসিক সমস্যা ও একেবারে কম লক্ষণীয় নয়। এক রিপোর্টের তথ্য মতে, ঢাকা শহরের ৬১% মানুষ শব্দ দূষণের জন্য হতাশা ও উদ্বেগের মতো মানসিক সমস্যায় ভুগছেন।মেজাজ খিটখিটে হওয়া, আচরণে অস্বাভাবিকতা, কাজের প্রতি অমনোযোগিতা, কর্মস্পৃহা কমে যাওয়া ইত্যাদি সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার ক্ষতি, অন্যান্য প্রাণিদের প্রজনন ক্ষমতার হ্রাস,সর্বোপরি রাষ্ট্রের বিশাল অংকের ক্ষতি গবেষণার দাবি রাখে।
শব্দ দূষণ বিভিন্ন উপায়ে হতেই থাকবে। এর কী কোন প্রতিকার নেই? দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইনে এর কি কোন নির্দেশনা নেই? বাংলাদেশ জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ। শিশু অধিকার সনদের ২৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শিশুর সুন্দর স্বাস্থ্য লাভের অধিকারে স্বীকৃতি রয়েছে। ২৭(১) ও ২৭(২) অনুচ্ছেদ মতে শিশুর শারিরীক ও মানসিক বিকাশ এবং শিশুর জীবন যাপনের উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিতকরণের দিক নির্দেশনা রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, শব্দ দূষণে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছে দেশের কোমলমতি শিশুরা। শিশুরা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শিশুদেরকে বিপদের মধ্যে নিমজ্জিত রেখে দেশের সার্বিক উন্নয়ন বাতুলতা মাত্র। অতএব, তাদের রক্ষায় সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
শব্দ দূষণকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিয়েছে। আমেরিকায় মনুষ্য সৃষ্ট শব্দ দূষণ মনিটরিং করার জন্য নিজস্ব সাইট তৈরি করেছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বড় বড় শহরেরে জন্য নয়েজ ম্যাপ প্রস্তুত করেছে। নেদারল্যান্ডে বাড়ি তৈরির কাজে ৫০ ডেসিবল এর বেশি শব্দের প্রয়োগ বৈধ নয়। গ্রেট ব্রিটেন ও ইন্ডিয়াতে রাত্রে শব্দ দূষণ ঠেকাতে স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে যন্ত্রপাতি বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার ও শব্দ দূষণকে একটি সিরিয়াস বিষয় হিসেবে বিবেচনায় নিয়েছেন। এই জন্য বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ এর ক্ষমতাবলে শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ প্রণয়ন করেছেন। উক্ত বিধিমালায় শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ এর জন্য বিভিন্ন মেয়াদে জেল ও জরিমানার ব্যবস্থা রয়েছে। এলাকাকে বিভক্ত করে আবাসিক, নীরব, বাণিজ্যিক, শিল্প ইত্যাদি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে সচিবালয় এলাকাকে ‘নো হর্ণ’ জোন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আবাসিক এলাকায় ৫০০ মি. এর মধ্যে ইট, পাথর ভাঙ্গার যন্ত্র বসানো নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।এছাড়া মটরযান আইনে শব্দ দূষণকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে ধারা সন্নিবেশিত করা হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ আইন, ১৯৭৬ এর ২৫,২৭,২৮ ধারায় শব্দ দূষণ প্রতিরোধ সম্পর্কিত বিধান রয়েছে। মহামান্য হাইকোর্ট ২০০২ সালের ২৭ মার্চ সকল প্রকার যানবাহন থেকে হাইড্রোলিক হর্ণ ও বিরক্তিকর হর্ণ ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। জেল-জরিমানার মেয়াদ, পরিমাণ ও বিধির কার্যকারিতা নিয়ে যদিও অনেকে আপত্তি তুলেন। আপত্তিগুলোও একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়।
শব্দ দ‚ষণ থেকে পরিত্রাণের কোন উপায় কী নেই? অবশ্যই আছে। সবচেয়ে বড় প্রয়োজন জনসচেতনতা। সচেতন করতে হবে শিক্ষক সমাজকে, শিক্ষার্থীদেরকে, গাড়ি ব্যবসায়ী, সাউন্ড যন্ত্র ব্যবসায়ী, ইট ভাটার মালিক, ড্রাইভার, বিজ্ঞাপনী সংস্থা, অডিও বা ভিডিও মেকার ব্যবসায়ীসহ সর্বোপরি রাজনৈতিক দলের নেতা নেত্রীদেরকে। সচেতনতা সৃষ্টির নামে বিদ্যমান কাঠামোতে যা করা হয়- একটি ব্যানার, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সামনে গণলেকচার, আপ্যায়ন, ফেইসবুকে দু’একটা ছবি পোস্ট ইত্যাদি। এভাবে গণসচেতনতা সৃষ্টি হয় বলে মনে হয়না। গণসচেতনতা তৈরির কাজে যদি জনগণকে সম্পৃক্ত করা না যায় এবং সাধারণ জনগণের নিকট থেকে কমিটমেন্ট আদায় করা না যায় তাহলে গণসচেতনতা বলা প্রহসনের নামান্তর। দ্বিতীয়ত যে বিষয়টি তাৎপর্যপূণ তা হলো আইনের যথাযথ প্রয়োগ। আইন প্রয়োগে সাদা, কালো, ধনী, গরিব, উঁচু, নিচু নির্বিশেষে সমান আচরণ জরুরি। তাহলেই হয়তো শব্দ দ‚ষণের মাত্রা কিছুটা কমবে বলে আশা করা যায়।
লেখক: পরিচালক- পরিবেশ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম অঞ্চল