শব্দদূষণে বিপন্ন পরিবেশ

23

ওয়াসিম আহমেদ

উচ্চশব্দ সৃষ্টিকারী হাউড্রোলিক হর্নের সাথে যোগ হয়েছে ভিআইপি হর্ন বা ইলেকট্রিক হর্নের উৎপাত। সড়কে দাপুটে চলাচলে সরকারি আমলা, ব্যক্তিগত থেকে প্রভাবশালীদের বাহনে বাজে ভিআইপি হর্নের সাইরেন। যা অতিমাত্রায় শব্দদূষণ করে। পরিবেশ আইনে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও উৎপাত বন্ধে উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগের দেখা মেলেনি। এ ছাড়া গাড়িতে হাইড্রোলিক হর্ন, নির্মাণ কাজ আর মাইকের অনিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবহার হচ্ছে। ফলে হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আবাসিক বা বাণিজ্যিক এলাকা সবখানে সহনীয় মাত্রার চেয়ে প্রায় ৩০ থেকে ৫০ ডেসিবল বেশি মাত্রার শব্দের তীব্রতায় বিপন্ন হয়ে পড়েছে নগরীর পরিবেশ।
গতকাল শব্দদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহানগর ও চট্টগ্রাম অঞ্চল একযোগে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে। মহানগর কার্যালয়ের পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত ৩২টি মামলায় ৫৫ হাজার ৫শ টাকা জরিমানা আদায় এবং ৫১টি হাইড্রোলিক হর্ন জব্দপূর্বক ধ্বংস করে। চট্টগ্রাম অঞ্চল কার্যালয়ের পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত ৪টি মামলায় ১১ হাজার টাকা জরিমানা আদায় এবং ১৭৫টি হাইড্রোলিক হর্ন জব্দপূর্বক ধ্বংস করে।
গত আগস্টে নগরীর ৩০টি স্পটে শব্দের মাত্রা পরীক্ষা করে ‘নীরব এলাকা’ শ্রেণিভুক্ত ১৪টি স্পটে শব্দের মাত্রা পাওয়া গেছে ৬৭ দশমিক ৫০ থেকে ৭৭ দশমিক ৫০ ডেসিবল পর্যন্ত। পরিবশে অধিদপ্তরের গবেষণাগারের এ জরিপে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ গেট এবং জাকির হোসাইন রোডের ইউএসটিসি হাসপাতালের সামনে শব্দের মাত্রা পাওয়া গেছে ৭৬ দশমিক ৫০ ডেসিবল। আন্দরকিল্লা জেমিসন রেডক্রিসেন্ট হাসপাতাল এলাকায় ৬৯ দশমিক ৫০, পাঁচলাইশ সার্জিস্কোপ হাসাপাতাল, লালখান বাজার মমতা ক্লিনিকের কাছে ৬৭ দশমিক ৫০ এবং আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালের সামনে পাওয়া গেছে ৭৩ দশমিক ৫০ ডেসিবল। অথচ শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা অনুযায়ী এসব এলাকায় শব্দের গ্রহণযোগ্য মাত্রা হওয়ার কথা সর্বোচ্চ ৪৫ ডেসিবল। চিকিৎসকরা বলেছেন, এ ধরনের শব্দদূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য চরম হুমকি। তাদের ভাষ্যমতে, শব্দদূষণের ফলে মানবদেহে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এমনকি সেটার প্রভাব পড়তে পারে মায়ের গর্ভে থাকা শিশুদেরও। অতিরিক্ত শব্দদূষণের কারণে মানুষ অনেক সময় স্থায়ীভাবে শ্রবণ শক্তি হারিয়ে ফেলে। যেটা চিকিৎসা করেও আর ফিরিয়ে আনা যায় না। এছাড়া রক্তচাপ, অস্থিরতা, নিদ্রাহীনতা ও মানসিক দুশ্চিন্তার মতো রোগও শব্দদূষণের কারণে হয়ে থাকে বলে জানান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক চিকিৎসক।
চট্টগ্রাম মহানগরীর আবাসিক এলাকাগুলোতেও নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি শব্দের তীব্রতা পাওয়ার তথ্য উঠে এসেছে পরিবেশ অধিদপ্তরের জরিপে। আবাসিক এলাকার সাতটি স্পটে করা জরিপে দক্ষিণ খুলশী এলাকায় শব্দের মাত্রা পাওয়া গেছে সর্বোচ্চ ৭৭ ডেসিবল ও চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার সামনে সর্বনি¤œ ৬৪ দশমিক ৫ ডেসিবল। জরিপে বাণিজ্যিক এলাকার ছয়টি স্পটের মধ্যে নগরীর জিইসি মোড়ে শব্দের সর্বোচ্চ মাত্রা ছিল ৮৩ ডেসিবল আর সর্বনিম্ন ছিল সিপিইজেড মোড়ে ৭৭ দশমিক ৫০ ডেসিবল। এছাড়া অক্সিজেন মোড়ে ৮০ দশমিক ৫০, আগ্রাবাদ মোড়ে ৭৯ দশমিক ৫০, বহদ্দারহাট মোড়ে ৮১ দশমিক ৫০ ও একে খান মোড়ে ৭৯ দশমিক ৫০ ডেসিবল মাত্রার শব্দদূষণ পেয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। পরিবেশ আইনে যেসব এলাকায় আবাসিক ভবনের পাশাপাশি বাণিজ্যিক এবং শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে সেগুলোকে ‘মিশ্র এলাকা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ধরনের দুটি এলাকার মধ্যে মুরাদপুর একুশে হাসপাতালের সামনে ৭৩ দশমিক ৫০ ও মেহেদীবাগ ম্যাক্স হাসপাতালের সামনে ৭৬ ডেসিবল। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ আইনে সকাল ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত আবাসিক এলাকায় ৫০ ডেসিবল, মিশ্র এলাকায় ৬০ আর বাণিজ্যিক এলাকায় ৭০ ডেসিবল শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করা আছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মুফিদুল আলম পূর্বদেশকে বলেন, ‘শব্দদূষণের মাত্রা ‘ভয়ংকর’ রূপ নিয়েছে। নিয়ন্ত্রণে আনতে আমরা বিভিন্ন স্পটে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছি। গতকাল হাটহাজারী রোডের নন্দীরহাট এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হয়। এতে উচ্চশব্দ সৃষ্টিকারী হাইড্রোলিক হর্ন জব্দ করে জরিমানা করা হয়। হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করা প্রায় গাড়ি হলো প্রভাবশালীদের। এমনকি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বহনকারী গাড়ির অতি উচ্চমাত্রার হাইড্রোলিক হর্ন জব্দ করে জরিমানা করায় আমার সাথে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও কর্তৃপক্ষ ‘ক্ষমতা’ দেখানোর মত ব্যবহার করেছেন। বিষয়টি দুঃখজনক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা দিবে, প্রজন্মকে সচেতন করবে। সেখানে নিজেরা আইন ভঙ্গ করে উল্টো ক্ষমতা দেখানোর প্রবণতা কষ্টকর। ইচ্ছেকৃত শব্দদূষণ থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সবার সচেতনতা ও সহযোগিতা দরকার বলে মন্তব্য করেন এ কর্মকর্তা।’