শবে বরাত শান্তি ও সৌভাগ্যের অন্বেষা

68

আ ব ম খোরশিদ আলম খান

বৈশ্বিক আপদ করোনা মহামারির ক্রান্তিকালে বিশ্বের শান্তি ও মুক্তিকামী মুসলমানদের জীবনে একটু শান্তির পরশ বুলিয়ে দিতে বছর ঘুরে এলো পবিত্র শবে বরাত। শবে বরাত মানেই হল মুক্তির রজনী বা সৌভাগ্য রজনী। ফার্সি ভাষায় শব মানে রাত, বরাত মানে সৌভাগ্য। এজন্যই শবে বরাতকে সৌভাগ্য রজনী বলা হয়। আরবিতে যাকে লাইলাতুল বরাতও বলা হয়ে থাকে। আজকের দিনগত রাতটি অন্য রাতের চেয়ে ভিন্ন। শবেবরাতকে বলা হয় মুক্তির রজনী। মানবজীবন নানা পাপ পংকিলতার আবর্তে ঘেরা। মানুষের যেমন গুণ আছে, তেমনি দোষও কম নয়। ঈর্ষা, আত্মপ্রবঞ্চনা, অন্যের প্রতি অবিচার, সত্য পথ বিচ্যুত হয়ে লাগামহীন জীবনাচারে গা ভাসিয়ে দেওয়া মানুষের সংখ্যা আমাদের চারপাশে নিতান্ত কম নয়। মনুষ্যত্ববোধ ও সুবিচার নীতি বিসর্জন দিয়ে অমানবিকতার পথে হাঁটা মানুষের সংখ্যাও অনেক। অন্যদিকে মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টি জগতের সেরা অভিধায় ভূষিত। তবুও প্রবৃত্তির তাড়নায় আল্লাহর প্রতি কর্তব্য পালন তথা আবশ্যকীয় ইবাদত বন্দেগিতে পুরোপুরি নিবেদিত হওয়া অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না। একজন মুসলমানকে খাঁটি ঈমানদার ও সাচ্চা ব্যক্তি হতে হলে মহান আল্লাহর হক যেমন নামাজ রোজা হজ্ব ইত্যাদি আদায়ে মনোনিবেশ করতে হবে, ঠিক তেমনি মানুষের প্রতিও হতে হবে দায়িত্বশীল ও কর্তব্যনিষ্ঠ। মানুষ কতোটা আল্লাহর আদেশ নিষেধ পালনে যতœবান, আর কতোটা মানুষের সেবায় অগ্রণী মাঝে মধ্যে নিজের ভেতর এই প্রশ্ন জাগ্রত হওয়া দরকার। পাপে অন্যায়ে লাগামহীন জীবনাচারে অভ্যস্ত মানুষের জন্য সুসংবাদের বার্তাই নিয়ে আসে শবে বরাত। বছরে যে কয়টি দিন-রাত পুণ্যের ঝলকে উদ্ভাসিত এর অন্যতম শবে বরাত। আজকের রাতটি মুক্তির রাত, ক্ষমা ও অনুগ্রহের রাত। আল্লাহর রহমত ও করুণাধারায় সিক্ত হবার অবারিত সুযোগ শবে বরাত। আল্লাহ পাকের সাথে বান্দাহর দূরত্ব ঘুচে যায় এ মহিমান্বিত রাতে।
মানবজীবন নানামুখী পঙ্কিলতায় ভরা। নানা অনাচারে নিমজ্জিত হয়ে মানুষের জীবন হয়ে ওঠে ক্লেদাক্ত। মানুষ পাপাচারে নিমগ্ন হবে, সত্যের ওপর অটল থাকা অনেকের জন্য দুরূহ হয়ে দাঁড়াবে, আল্লাহর হক আদায়ে শৈথিল্য দেখাবে তা মহান আল্লাহ পাক ভালোভাবেই জানেন। নিজের সেরা সৃষ্টি মানুষকে পাপের পাহাড় ও দগ্ধতা থেকে বাঁচানোর জন্যই আল্লাহ পাক কিছু দিন ও রাতকে বিশিষ্টতর ও মহিমান্বিত করেছেন। এর মধ্যে শবে বরাত অন্যতম। নফল নামাজ আদায়, কুরআন মজিদ তেলাওয়াত, দুরূদ শরিফ পাঠ, মা-বাবা-আত্মীয়-স্বজনসহ ওলী বুজুর্গের মাজার জিয়ারত ইত্যাদি পুণ্যময় আমলে শবে বরাত অতিবাহিত করা অতীব জরুরি। এই পুণ্যময় রজনীকে ঘিরে বিশেষ খানাপিনা আয়োজন করে ফাতেহা পাঠ করে গরিব-দুঃখী মানুষকে খাওয়ানো এবং দু’হাতে গরিব-অসহায় মানুষকে দান সদকাহ টাকা পয়সা প্রদান ইত্যাদি শবে বরাতের মুখ্য করণীয়। এসব পুণ্যময় আমলের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ দিক নির্দেশনা রয়েছে পবিত্র কুরআন-হাদিসে। ইসলামী মনীষীদের জীবনাচারেও আমরা দেখি শবে বরাত তাঁরা অতিবাহিত করেছেন ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে এবং মানবকল্যাণের দ্বারা। শবে বরাতে যতো ধরনের পুণ্যময় কাজ রয়েছে সবই অসংকোচে করা যাবে। এ রাতে পুণ্য কাজের তালিকা আরো অনেক দীর্ঘ হতে পারে। ইবাদত বন্দেগিতে কাটিয়ে এবং মানব সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করে পুণ্যময় জীবন গঠনের বড় সুযোগ শবে বরাত।
পবিত্র কুরআন-হাদিস শরিফে শবে বরাতের ফজিলত ও মাহাত্ম্যের কথা বর্ণনা রয়েছে। কুরআন মজিদের সুরা দুখানের ৩-৪ নং আয়াতে শবে বরাতের উল্লেখ পাওয়া যায়। আল্লাহ পাক বলছেন ‘ইন্না আঞ্জালনা হু ফী লাইলাতিম মুবারাকাতিন ইন্না কুন্না মুঞ্জিরীন, ফী হা ইউফরাকু কুল্লু আমরিন হাকীম’ অর্থ্যাৎ আমি এই কল্যাণময় রজনীতে পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ করেছি। আমিই সতর্ককারী। এতে আমার আদেশে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা ও বিষয়াদি মীমাংসিত হয়। অলি বুজুর্গ ও মুফাসসিরগণ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় শবে বরাত বা শবে কদরকেই বুঝিয়েছেন। ১৪ শাবান দিবাগত রাতই হচ্ছে শবে বরাত। খাঁটি অন্তরে অনুশোচনার মাধ্যমে অতীতের পাপাচারের নিষ্কৃতির জন্য এই পুণ্যময় রজনীতে ফরিয়াদ জানালে আল্লাহ পাক কবুল করবেন এ আশা করা যায়। এ রাতে বান্দাহর রিজিক, জীবন মৃত্যু ভাগ্য লিপিবদ্ধ হয় বলে শবে বরাতের তাৎপর্য অনেক গভীর।
তবে এখানে একটি প্রসঙ্গ বিশেষভাবে বলা জরুরি। শবে বরাতে গরিব-দুঃখী অভাবী নিরন্ন মানুষকে দান-সদকাহ করা অতীব পুণ্যময় কাজ সন্দেহ নেই। যারা সারা বছর সুন্দরভাবে খেতে পারে না, মাছ-মাংসসহ নানা সুস্বাদু খাবার যাদের কপালে জুটেনা এই গরিব ক্ষুধার্ত মানুষদেরকে নিজ ঘরে বা আঙিনায় ডেকে নিয়ে ভাল উন্নত মানের খানাপিনা পরিবেশন করা সবচেয়ে উত্তম কাজ। কিন্তু আমরা ভেবে দেখিনা যারা গরিব অসহায় মানুষ আমাদের চারপাশে অবস্থান করে থাকে, তাদের শুধু বছরের এই কয়েকটি দিন দান-সদকাহ বা আদর আপ্যায়নের ব্যবস্থা করাই যথেষ্ট নয়। এই অসহায় নিরন্ন অধিকার বঞ্চিত মানুষের জীবন বদলানোর প্রয়াসে সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্বশীল ও কর্তব্যনিষ্ঠ হতে হবে। শুধু দান সদকাহ দিয়ে গরিবদেরকে শবে বরাত, শবে কদর বা ঈদের দিনে হাসি-খুশিতে রাখা যথেষ্ট ভাবলে হবে না। এই অসহায় মানুষগুলো যাতে সারা বছর অভাবমুক্ত সচ্ছল জীবনের দিশা খুঁজে পায় তার ব্যবস্থাও আপনাকে করতে হবে, যদি আপনার সেই সক্ষমতা ও সুযোগ থাকে। গরিবদেরকে বছরের মাত্র কয়েকটি দিন খুশিতে রেখে দায়িত্ব সারলে হবে না। ধনী, বিত্তবান ও সরকার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে দেশ ও সমাজ থেকে দারিদ্র্য হটাতে হবে। বিক্ষিপ্তভাবে দানসদকা করলে গরিবদের স্থায়ী কোনো ফায়দা হয় না। বরং এতে গরিবি জিইয়ে থাকে মাত্র। কেবল শবে বরাত শবে কদর ইত্যাদি বিশেষ দিনগুলোতে গরিব দুখীদের সামান্য দানসদকা না করে তাদেরকে স্থায়ীভাবে সচ্ছল করে দিতে হবে। অসহায় গরিবদেরকে স্থায়ী পুনর্বাসনের কথা সবাইকে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। মনে রাখতে হবে, দান সদকাহ যাকাত ফিতরা ইত্যাদি ইসলাম নির্দেশিত ইবাদত হলেও অপরিকল্পিতভাবে মাঝে মধ্যে গরিবদেরকে ২০/৪০ টাকা করে গছিয়ে দিয়ে চিরকালের জন্য তাদের গরিব করে রাখা ইসলামের শিক্ষা নয়। দান সদকাহ যাকাত ফিতরা এমনভাবে দিতে হবে যাতে সমাজ থেকে দারিদ্র্য চিরতরে নির্মূল হয়। সামান্য দানসদকা দিয়ে গরিবদের দারিদ্র্য জিইয়ে রাখা ইসলামের উদ্দেশ্য নয় এই উপলব্ধি সবার মাঝে থাকা উচিত। বরং গরিবদেরকে স্থায়ীভাবে সচ্ছল করার মানবিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসাই ইসলামের শাশ্বত নির্দেশনা এবং মহানবীর (দ.) শিক্ষা।
সামনে আসছে রমজান মাস। রমজান মাসের শেষ দিকে পালিত হয় শবে কদর। তারপর আসে ঈদুল ফিতর। রমজান মাসে সাধারণত আমাদের দেশের কিছু ধনী গরিবদেরকে দান সদকাহ যাকাত ফিতরা প্রদানে মনোযোগী হন। এটি ইতিবাচক দিক হলেও একে আবার পরিকল্পিত পন্থাও বলা যায় না। অতি অল্প টাকা গরিবদের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে ধনীরা আত্মতুষ্টিতে ভুগলেও এতে গরিবদের স্থায়ী কোনো কল্যাণ হয় না। অন্যদিকে প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজের সময় গরিব নারী-পুরুষেরা প্রতিটি মসজিদের আঙিনায় সামান্য টাকা পয়সার আশায় জড়ো হয়। অথচ দুর্ভাগ্যজনক যে, একটি মসজিদ থেকে যদি পাঁচশত জন মুসল্লি নামাজ শেষে বের হন, দেখা যায় মাত্র ১৫/২০ জন মুসল্লি ছাড়া আর কেউ গরিবদেরকে ৫টি টাকা দেওয়ার মতো গরজবোধও করেন না। মসজিদের বাইরে মাত্র ১৫/২০ জন গরিব মানুষ সাহায্যের অপেক্ষায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকেন। জুমার নামাজের সময় মুসল্লি কর্তৃক আর্থিক সাহায্যের আশায় গরিবেরা সমবেত হয়, অথচ শত শত মুসল্লির ওদের দিকে কোনো ভ্রƒক্ষেপ নেই। মুসল্লিদের পকেটে অনেক টাকা থাকলেও গরিবের জন্য এক টাকাও বের হয় না। ধরুন, ৫০০ জন মুসল্লির মধ্যে অন্তত তিনশত জন মুসল্লি প্রতিটি জুমার দিনে বা শবে বরাতের মতো বিশেষ দিনগুলোতে গরিব ভিক্ষুকদেরকে জনপ্রতি ৫/১০ টাকা করে দেন, তাহলে এই গরিব মানুষগুলো অন্তত এক সপ্তাহ সুখে শান্তিতে সচ্ছলতার সাথে দিন কাটাতে পারবেন। কিন্তু না, লক্ষ-কোটি টাকার মালিক অনেক বিত্তবান মুসল্লিরা গরিবদেরকে ‘উৎপাত’ ও ‘ঝামেলা’ মনে করে দ্রুত নামাজ শেষে বেরিয়ে যান। এমনকি শবে বরাত, শবে কদর এবং দুই ঈদেও অনেক মুসল্লি গরিবদের দিকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকান না। তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন না। এটি অমানবিক। এটি গরিবদের প্রতি চরম নিষ্ঠুরতার শামিল। তা যেন আমরা পরিহার করি।
করোনা মহামারি নিশ্চয়ই বিশ্ববাসীর জন্য বড় আপদ ও আজাব সন্দেহ নেই। মানুষের ওপর মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহপাক অসন্তুষ্ট বলেই হয়ত নানা সময়ে বিপদ-মুসিবত নেমে আসছে। আজকের শবে বরাত রজনীতে অশ্রæসিক্ত আকুল ফরিয়াদ জানাতে হবে আল্লাহ পাকের দরবারে। যেন যাবতীয় বিপদ-মুসিবত দ্রæত কেটে যায়। আবারও বিশ্বে নেমে আসে শান্তির ফল্গুধারা। আমরা মহান শবে বরাতে বিশ্ব মুসলিমসহ সমগ্র মানবজাতির জীবনে শান্তি ও মুক্তির জন্য আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ জানাবো এই হোক আমাদের দৃঢ় প্রত্যয়। আমরা শান্তি ও পরিত্রাণের অন্বেষায় রজনীটি যেন পার করে দিই। শবে বরাত আমাদের সৌভাগ্যের দুয়ার উন্মোচিত করুক। আল্লাহপাক আমাদের তৌফিক দান করুন।

লেখক: সাংবাদিক ও ইসলামী চিন্তাবিদ