শবেবরাত: আল্লাহর করুণা লাভের সূবর্ণসুযোগ

131

আ ব ম খোরশিদ আলম খান

বিশ্বজুড়ে মানবতার করুণ পরিস্থিতির মাঝে মহানস্রষ্টা আল্লাহ পাকের বিশেষ করুণাসিক্ত হওয়ার শুভ বার্তা নিয়ে এলো মুক্তির রজনী শবেবরাত। আজকের দিনগত রাতটি অন্য রাতের চেয়ে ভিন্ন। শবেবরাতকে বলা হয় মুক্তির রজনী। মানবজীবন নানা পাপ পংকিলতার আবর্তে ঘেরা। মানুষের যেমন গুণ আছে, তেমনি দোষও কম নয়। ঈর্ষা, আত্মপ্রবঞ্চনা, অন্যের প্রতি অবিচার, সত্য পথ বিচ্যুত হয়ে লাগামহীন জীবনাচারে গা ভাসিয়ে দেওয়া মানুষের সংখ্যা আমাদের চারপাশে নিতান্ত কম নয়। অন্যদিকে মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টি জগতের সেরা অভিধায় ভূষিত। তবুও প্রবৃত্তির তাড়নায় আল্লাহর প্রতি কর্তব্য পালন তথা আবশ্যকীয় ইবাদত বন্দেগিতে পুরোপুরি নিবেদিত হওয়া অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না। একজন মুসলমানকে খাঁটি ঈমানদার ও সাচ্চা ব্যক্তি হতে হলে মহান আল্লাহর হক যেমন নামাজ রোজা হজ্ব ইত্যাদি আদায়ে মনোনিবেশ করতে হবে, ঠিক তেমনি মানুষের প্রতিও হতে হবে দায়িত্বশীল ও কর্তব্যনিষ্ঠ। মানুষ কতোটা আল্লাহর আদেশ নিষেধ পালনে যতœবান, আর কতোটা মানুষের সেবায় অগ্রণী মাঝে মধ্যে নিজের ভেতর এই প্রশ্ন জাগ্রত হওয়া দরকার। পাপে অন্যায়ে লাগামহীন জীবনাচারে অভ্যস্ত মানুষের জন্য সুসংবাদের বার্তাই নিয়ে আসে শবে বরাত। বছরে যে কয়টি দিন-রাত পুণ্যের ঝলকে উদ্ভাসিত এর অন্যতম শবে বরাত। আজকের রাতটি মুক্তির রাত, ক্ষমা ও অনুগ্রহের রাত। আল্লাহর রহমত ও করুণাধারায় সিক্ত হবার অবারিত সুযোগ শবে বরাত। আল্লাহ পাকের সাথে বান্দাহর দূরত্ব ঘুচে যায় এ মহিমান্বিত রাতে। তাই, আজকের রাতটি ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে কাটিয়ে আল্লাহ পাকের নৈকট্য অর্জন করতে হবে আমাদেরকে।
নানা অনাচারে নিমজ্জিত হয়ে মানুষের জীবন হয়ে ওঠে ক্লেদাক্ত। মানুষ পাপাচারে নিমগ্ন হবে, সত্যের ওপর অটল থাকা অনেকের জন্য দুরূহ হয়ে দাঁড়াবে, আল্লাহর হক আদায়ে শৈথিল্য দেখাবে তা মহান আল্লাহ পাক ভালোভাবেই জানেন। নিজের সেরা সৃষ্টি মানুষকে পাপের পাহাড় ও দগ্ধতা থেকে বাঁচানোর জন্যই আল্লাহ পাক কিছু দিন ও রাতকে বিশিষ্টতর ও মহিমান্বিত করেছেন। এর মধ্যে শবে বরাত অন্যতম। শবে বরাত ফার্সি শব্দ। যার আরবি হলো ‘লাইলাতুল বরাত’। এর মানে মুক্তি রজনী। নফল নামাজ আদায়, কুরআন মজিদ তেলাওয়াত, দুরুদ শরিফ পাঠ, মা-বাবা-আত্মীয়-স্বজনসহ ওলী বুজুর্গের মাজার জিয়ারত ইত্যাদি পুণ্যময় আমলে শবে বরাত অতিবাহিত করা অতীব জরুরি। এই পুণ্যময় রজনীকে ঘিরে বিশেষ খানাপিনা আয়োজন করে ফাতেহা পাঠ করে গরিব-দুঃখী মানুষকে খাওয়ানো এবং দু’হাতে গরিব-অসহায় মানুষকে দান সদকাহ টাকা পয়সা প্রদান ইত্যাদি শবে বরাতের মুখ্য করণীয়। এসব পুণ্যময় আমলের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ দিক নির্দেশনা রয়েছে পবিত্র কুরআন-হাদিসে। ইসলামী মনীষীদের জীবনাচারেও আমরা দেখি শবে বরাত তাঁরা অতিবাহিত করেছেন ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে এবং মানবকল্যাণের দ্বারা।
পবিত্র কুরআন-হাদিস শরিফে শবে বরাতের ফজিলত ও মাহাত্ম্যের কথা বর্ণনা রয়েছে। কুরআন মজিদের সুরা দুখানের ৩-৪ নং আয়াতে শবে বরাতের উল্লেখ পাওয়া যায়। আল্লাহপাক বলছেন ‘ইন্না আঞ্জালনাহু ফী লাইলাতিম মুবারাকাতিন ইন্না কুন্না মুঞ্জিরীন, ফী হা ইউফরাকু কুল্লু আমরিন হাকীম’ অর্থ্যাৎ আমি এই কল্যাণময় রজনীতে পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ করেছি। আমিই সতর্ককারী। এতে আমার আদেশে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা ও বিষয়াদি মীমাংসিত হয়। অলি বুজুর্গ ও মুফাসসিরগণ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় শবে বরাত বা শবে কদরকেই বুঝিয়েছেন। ১৪ শাবান দিবাগত রাতই হচ্ছে শবে বরাত। খাঁটি অন্তরে অনুশোচনার মাধ্যমে অতীতের পাপাচারের নিষ্কৃতির জন্য এই পুণ্যময় রজনীতে ফরিয়াদ জানালে আল্লাহ পাক কবুল করবেন এ আশা করা যায়। এ রাতে বান্দাহর রিজিক, জীবন মৃত্যু ভাগ্য লিপিবদ্ধ হয় বলে শবে বরাতের তাৎপর্য অনেক গভীর।
তবে এখানে একটি প্রসঙ্গ বিশেষভাবে বলা জরুরি। শবে বরাতে গরিব-দুঃখী অভাবী নিরন্ন মানুষকে দান-সদকাহ করা অতীব পুণ্যময় কাজ সন্দেহ নেই। যারা সারা বছর সুন্দরভাবে খেতে পারে না, মাছ-মাংসসহ নানা সুস্বাদু খাবার যাদের কপালে জুটেনা এই গরিব ক্ষুধার্ত মানুষদেরকে নিজ ঘরে বা আঙিনায় ডেকে নিয়ে ভাল উন্নত মানের খানাপিনা পরিবেশন করা সবচেয়ে উত্তম কাজ। কিন্তু আমরা ভেবে দেখিনা যারা গরিব অসহায় মানুষ আমাদের চারপাশে অবস্থান করে থাকে, তাদের শুধু বছরের এই কয়েকটি দিন দান-সদকাহ বা আদর আপ্যায়নের ব্যবস্থা করাই যথেষ্ট নয়। এই অসহায় নিরন্ন অধিকারবঞ্চিত মানুষের জীবন বদলানোর প্রয়াসে সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্বশীল ও কর্তব্যনিষ্ঠ হতে হবে। শুধু দান সদকাহ দিয়ে গরিবদেরকে শবে বরাত, শবে কদর বা ঈদের দিনে হাসি-খুশিতে রাখা যথেষ্ট ভাবলে হবে না। এই অসহায় মানুষগুলো যাতে সারা বছর অভাবমুক্ত সচ্ছল জীবনের দিশা খুঁজে পায় তার ব্যবস্থাও আপনাকে করতে হবে, যদি আপনার সেই সক্ষমতা ও সুযোগ থাকে।
এ বছর ভিন্ন পরিস্থিতিতে করুণ শোচনীয় সময়ে শবে বরাত আমাদের দোরগোড়ায় এসেছে। বৈশ্বিক মহামারি করোনার অভিঘাতে সারাবিশ্বের মানুষের জীবন আজ ওষ্ঠাগত। দেশে দেশে কোটি কোটি মানুষের জীবনে আজ নেমে এসেছে ঘোর অমানিশা। হাতে কাজ নেই, ঘরে খাবার নেই, এমনকি হাসপাতালে পর্যাপ্ত চিকিৎসাও মিলছে না। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বড় ছোট সকল নগর-শহর ও জনপদে চলছে লকডাউন। মানুষ আজ ঘরে অবরুদ্ধ হয়ে বন্দি জীবনযাপনে বাধ্য হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দীর্ঘ আশি বছরেও এমন বৈশ্বিক দুর্যোগ-প্রাণঘাতী মহামারি দেখেনি বিশ্ব। করোনার দানবীয় উন্মত্ততায় বিশ্ববাসী আজ পর্যুদস্ত। সরকার বলছে, মানুষ যেন ঘরেই থাকে। মানুষ তা মানছেও। কিন্তু করোনায় এই অবরুদ্ধ সময়ে দাউ দাউ করে জ্বলছে পেটের ক্ষুধার বহ্নিশিখা। পেট তো আর প্রবোধ মানে না। যতক্ষণ জীবন আছে, ততক্ষণ পেটেও খাবার জোগাতে হবে। এছাড়া গত্যন্তর নেই। তাই, এই করোনার মহামারিতে মানুষ যতই বিচ্ছিন্ন থাকুক, শেষ পর্যন্ত মানুষই তো ভরসা। এই বড় দুঃসময়ে মানুষকে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। দয়া ও করুণার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে একে অন্যের প্রতি। এবার শবে বরাতে আমাদের প্রত্যয় ও শপথ নিতে হবে, দেশের একজন মানুষও অভুক্ত থাকবে না। কেউ খাবারের জন্য হাহাকার করবে না। এই চরম দুঃসময়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোই হোক এবার শবে বরাতে আমাদের দৃঢ় প্রত্যয়।
করোনা পরিস্থিতিতে লোক সমাগম এড়ানোর পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন সংস্থা ইসলামিক ফাউন্ডেশন মসজিদে মসজিদে উপস্থিতির বিপরীতে ঘরে বসে নিভৃতে ইবাদত বন্দেগিতে শবে বরাতের রজনীটি পার করার যে পরামর্শ দিয়েছে, তা যৌক্তিক ও সময়োপযোগী। তা দ্বীনদার ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা মেনে চলবে বলে আমরা আশা করি। তবে মসজিদে গেলেও যথাসম্ভব ইবাদত সংক্ষিপ্ত করে ঘরে ফিরে আসতে হবে। ধর্মাচার মানতে গিয়ে নিজের বা অন্য কারো জীবনকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া যাবে না।
আজ শবে বরাত মুক্তির রজনীতে আমাদেরকে বেশি বেশি কৃত পাপের জন্য আল্লাহর দরবারে ক্ষমা ও ইস্তেগফার প্রার্থনা করতে হবে। মানুষেরই পাপের ফল যাবতীয় দুর্যোগ ও মহামারি, তা যেন আমরা ভুলে না যাই। তাই, নিজেদের অতীত জীবনের যাবতীয় ভুল-বিচ্যুতির জন্য কায়মনোবাক্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে আজকের রাতে। আত্মীয়-স্বজনসহ চারপাশের গরিব অভাবী মানুষের মাঝে আজ অকাতরে দানের হাত বাড়িয়ে দিন। সবাই আর্তমানবতার পাশে দাঁড়ান নিজ নিজ সাধ্য ও সামর্থ্যানুযায়ী। আল্লাহপাক সবাইকে এ তৌফিক দিন।

লেখক : কলাম লেখক, ইসলামী চিন্তাবিদ