শত্রুসম্পত্তি আইন ও প্রিয়া সাহার ৩৭ মিলিয়ন ডিসএপিয়ার

81

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে প্রিয়া সাহার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ তথা সার বিশ্বে বাঙালি হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে এবং প্রতিবেশি দেশগুলোর সরকার ও সাধারণ জনগণের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা চলছে বেশ কিছু দিন ধরে।
আসলে এ বিতর্কিত বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আমাদেরকে পিছনে তাকাতে হবে। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় পাক সরকার এক বিতর্কিত আইন অধ্যাদেশের মাধ্যমে জারি করে যা শত্রæ সম্পত্তি আইন হিসেবে পরিচিত। এই আইনের মূল বিষয় হলো পাকিস্তানে বসবাসরত কোন সংখ্যালঘু বা তার পরিবারের কোন সদস্য ভারত বা অন্য কোন দেশে অবস্থান করলে তাদের সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হবে। ১৯৬৫ সালে আইনটি কার্যকর হবার পর দেখা গেল সংখ্যালঘু প্রায় পরিবারের স্থাবর সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে কারণ ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর সংখ্যালঘুদের অনেক সদস্য ভারত বা অন্য কোন দেশে মাইগ্রেট করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে সংখ্যালঘুর উপর আর একটি নতুন গজব নেমে আসল। এই আইন জারির পর আমলা, ভূমি অফিসের কর্মচারি এবং মুসলিম লিগারদের বৃহস্পতি তুঙ্গে উঠে গেল। এই সব সম্পত্তি মুসলিম লিগাররা সরকারের কাছ থেকে লিজ নিয়ে ভোগ করতে শুরু করলো। অন্যদিকে আমলা এবং ভূমি অফিসের কর্মচারিদের পকেট ভারি হতে লাগলো।
ভ‚মি অফিসের কর্মকর্তারা সবচেয়ে যে ক্ষতি করা শুরু করলো তা হলো খতিয়ান এবং বালামে উল্লেখ করলো এই সব জমির মালিক হলো ভারত সরকার। আমার জানা মতে যে সব ব্যক্তি ভারতে গিয়ে প্রমাণ করতে পেরেছে তাদের জমি শত্রু সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা হয়েছে তাদেরকে জমির সব দলিল জমা দেওয়া সাপেক্ষে ক্ষতি পূরণ দিয়েছে ভারত সরকার।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেগুলো বঙ্গবন্ধু অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করে এই কালো আইন বাতিল না করে। তখন আইনমন্ত্রী ছিলেন মনোরঞ্জন ধর। বঙ্গবন্ধু তাকে দিয়ে এই অর্পিত সম্পত্তি আইন কার্যকর করেন।
জেনারেল এরশাদ গণতান্ত্রিক সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করার পর তিনি সাংবিধানিকভাবে ‘ইসলাম’কে রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেন। তারই প্রতিক্রিয়া হিসেবে সংখ্যালঘুরা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ গঠন সহ সংখ্যালঘুদের অন্যান্য মানবাধিকার সংগঠন গঠন করল। সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী বাতিলের মাধ্যমে রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম খারিজ হলেও আওয়ামী লীগ, জাসদ, ওয়াকারস পার্টি, জাপার মহাজোট সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আবারো ‘ইসলাম’ রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে বহাল রাখল। মুখে ধর্মনির পেক্ষতার জিগির তুললেও রাষ্ট্রকে আবারো ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করল তারা। সংখ্যালঘুরা হয়ে পড়লো এতিম অবস্থায়।
সরকারি হিসাবে ৩০ লাখ একর জমি শত্রু সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত। তার মধ্যে এখন সরকারের দখলে আছে তিন লক্ষ একরের মতো। এই আইনের কারণে সবচেয়ে বেশি মানুষ দেশান্তরি হয়েছে।
সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৪৭ সালে সংখ্যালঘু জনসংখ্যা ছিলো ২৯.৭ শতাংশ আর ২০১১ সালে তা’ হয়েছে ৯.৬ শতাংশ।
২০১০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর দৈনিক প্রথম আলোর শেষ পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু জনসংখ্যা উদ্বেগজনক হারে কমার খবর। আদমশুমারির তথ্য মতে, সংখ্যালঘু জনসংখ্যা কমেছে ২৪ শতাংশ। তখন সরকার কোন প্রতিবাদ করেনি। ডক্টর বারাকাতের গবেষণায় আতঙ্কজনক খবর প্রকাশিত হয় ১৯৯৬ সালের নভেম্বরে তার ‘বাংলাদেশে কৃষি-ভূমি -জলা সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ শীর্ষক এক গবেষণায়। তাঁর মতে ১৯৬৪-২০১৩ সাল পর্যন্ত ৫দশকে মোট ১কোটি ১৩লাখ সংখ্যালঘু মানুষ দেশান্তরি হয়েছে। প্রতি বছরে ২ লাখ ৩০ হাজার ৬১২জন সংখ্যালঘু নিরুদ্দিষ্ট বা দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। আর প্রতিদিন দেশ ছেড়েছেন ৬৩২জন। এখানেও সরকার কোন প্রতিবাদ করেনি।
প্রিয়া সাহার দেওয়া ৩৭ মিলিয়ন সংখ্যালঘু কমার তথ্য নিয়ে যখন এত বিতর্ক চলছে তখন এর চেয়ে আরও অনেক বেশি (৪৯ মিলিয়ন) সংখ্যালঘু বাংলাদেশ ছাড়ার তথ্য আমেরিকান কংগ্রেসের লাইব্রেরিতেই আছে। ২০১৩ সালে আমেরিকান কংগ্রেসের টম ল্যান্টোস মানবাধিকার কমিশনের হিয়ারিংয়ে আমেরিকার স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্কের অধ্যাপক সাচি ডি দস্তিদার দাবি করেছেন- ‘49 million Hindus missing from Bangladesh’ ’ সেদিনের হিয়ারিংয়ের ভিডিও ইউটিউবেও পাওয়া যায় (https://www.youtube.com/watch?v=cGq_RZfnwx4)।
সুইডেন সরকারের অর্থায়নে মাইনোরিটি রাইটস গ্রুপের ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসের প্রতিবেদনে (https://minorityrights.org/…/11/MRG_Rep_Ban_Oct16_ONLINE.pdf) বলা হয়েছে, ‘The decline of the Hindu population, from more than 22 percent in the 1940s to less than 9 percent today, is the result of this exodus: between 1964 and 2001, for instance, an estimated 8.1 million Ômissing HindusÕ left, amounting to around 219,000 people annually. Continued discrimination, land grabbing and the growing threat of violence have meant that Bangladeshi Hindus have continued to emigrate, in many cases irregularly, to India.
২০১৭ সালে জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের আলোচনায়ও বাংলাদেশ মাইনোরিটি কাউন্সিলের পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হয়েছিল-’About 49 million Hindus are missing. Where are they?’ (https://www.ohchr.org/…/item5%20-%20Bangladesh%20Minority%2…) তখনো সরকারের পক্ষ থেকে বলিষ্ট কোন প্রতিবাদ দেখা যায় নি। তাই এ দেশ থেকে ৩৭ বা ৪৯ মিলিয়ন হিন্দু ‘মিসিং’ হবার তথ্য বৈশ্বিক অঙ্গনে নতুন নয়। তবে এ মিসিং কিভাবে হয়েছে তা ব্যাখ্যার দাবি রাখে।
বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের একটা মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা হলো তারা আওয়ামী লীগের প্রতি শতভাগ দুর্বল। তাদের এই দুর্বলতার কোন যৌক্তিক ভিত্তি নাই। যে কারণে ২০০১ সালের নির্বাচনের পর তাদের উপর যে রাজনৈতিক হামলা হয়েছে তাকে আওয়ামী লীগ এবং সংখ্যালঘুরা সাম্প্রদায়িক হামলা হিসেবে সারা বিশ্বে প্রচার করেছে যা প্রিয়া সাহা উল্লেখ করেছেন, যদিওবা তা ছিল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উপর হামলা। তখন এটার বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করেনি। প্রিয়া সাহা যে অভিযোগ ট্রাম্পের কাছে করেছেন তাতে তিনি বলেছেন ২ মার্চ ২০১৯ সালে তার বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে ইসলামিক ফান্ডামেন্টালিস্টরা। বাস্তবে কি তাই। আসলে প্রিয়া সাহা কি বলতে চেয়েছেন তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন ও বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

লেখক : রাজনীতিক, প্রাবন্ধিক