শতভাগ এলইডিতে নগরময় আলোর মিছিল

63

ওয়াসিম আহমেদ

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে (চসিক) আলোকায়নযোগ্য সড়ক রয়েছে ১২শ কিলোমিটার। এর মধ্যে নিজস্ব ও জাইকার অর্থায়নে ১৫৩ কিলোমিটার সড়কে এলইডি বাতি বসানো হয়েছে। ইতোমধ্যে একনেকে অনুমোদিত ভারতীয় বিনিয়োগে ২৬১ কোটি টাকার এলইডি বাতি স্থাপন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন শেষ হলে আরও ৪৬০ কিলোমিটার এলইডি বাতি বসবে। বাকি থাকা ৫৮৭ কিলোমিটার সড়কে এলইডি বাতি স্থাপনের পরিকল্পনায় এডিপি অর্থায়নে নতুন প্রকল্পের জন্য জরিপ চালাচ্ছে চসিক।
২০২৫ সালের মধ্যে পুরো শহরটাকে ধবধবে আলোকিত করার কথা জানিয়ে সিটি মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের অন্যতম একটি কাজ শহরের সড়কে আলোকায়ন নিশ্চিত করা। নিয়ন আলোর বাতি লালচে, অধিক বিদ্যুৎ খরচে ব্যয়ও বেশি। তাই আমরা ধবধবে আলো, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী ও ব্যবস্থাপনা খরচ কম এলইডি বাতি ব্যবহার শুরু করছি। একটি প্রকল্পের কাজ চলছে। তা শেষ হলে ৫০ শতাংশ নগর এলইডি বাতির আওতায় আসবে। আমাদের সড়ক উন্নয়নের আড়াই হাজার কোটি টাকার যে প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে তাতে অনেক নতুন সড়ক তৈরি হবে। সেখানে আলোকায়ন করতে হবে। তাই নতুন সড়ক, নিয়ন বাতির সড়ক সবগুলো নিয়ে আলাদা আরেকটি প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরির নির্দেশনা দিয়েছি। প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করবো প্রকল্পটি যাতে অনুমোদন দেন। তাহলে আমার মেয়াদের মধ্যে পুরো শহরে আর কোনো নিয়ন বাতি থাকবে না।’
চসিকের বিদ্যুৎ উপ-বিভাগ সূত্র বলছে, গেল বছরের জানুয়ারির জরিপ অনুসারে চসিকের অধীনে আলোকায়নযোগ্য সড়ক রয়েছে ১১৮৪ কিলোমিটার। এ বছরে তা ১২শ কিলোমিটার ছাড়িয়ে যাবে। কেননা চসিকের ১২৩০ কোটি, ২৫০০ কোটি সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে উন্নয়নকৃত নতুন সড়ক যোগ হবে। তাই আলোকায়নযোগ্য সড়কের ম্যাপ আরও দীর্ঘ হবে। সূত্রটি আরও বলছে, রাজস্ব তহবিল থেকে ১৬ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার, পিডিবি প্রকল্প থেকে ৫৮ কিলোমিটার, জাইকা প্রকল্প থেকে ৭৮ কিলোমিটার এলইডি বাতি রয়েছে। এ ছাড়া সোডিয়াম/সিএফএল/টিউবলাইট রয়েছে ৮৯০ কিলোমিটার জুড়ে ৪৮ হাজার ৫৫৭টি বাতি।
ভারত সরকারের এলওসির (লাইন অব ক্রেডিট) প্রক্রিয়ায় ২৬১ কোটি টাকার এলইডি বাতি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চসিক। আগামী মাস থেকে প্রকল্পটির ভৌত বাস্তবায়ন শুরু হবে। এতে ৪৬০ কিলোমিটার সড়কজুড়ে এলইডি বাতি জ্বলবে। বিষয়টি নিশ্চিত করে প্রকল্পটির পরিচালক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশ পূর্বদেশকে জানান, ‘মেয়রের নির্দেশে নতুন প্রকল্পের জন্য জরিপ চালাচ্ছি। এ সপ্তাহের মধ্যে কাজ শেষ হবে। তারপর আমরা ফিজিবিলি স্টাডি করে ডিপিপি তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব করবো।’
চসিক সূত্রে জানা গেছে, ‘মর্ডানাইজেশন অব সিটি স্ট্রিট লাইট সিস্টেম অ্যাট ডিফারেন্ট এরিয়া আন্ডার চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন’ শীর্ষক প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২৬০ কোটি ৮৯ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। এর মধ্যে এলওসির (লাইন অব ক্রেডিট) আওতায় ৮২ দশমিক ২০ শতাংশ অর্থের যোগান দেবে ভারত। ঋণ হিসেবে দেয়া এ অর্থের পরিমাণ ২১৪ কোটি ৪৬ লাখ ৮২ হাজার টাকা। অবশিষ্ট ১৭ দশমিক ৮০ শতাংশ বা ৪৬ কোটি ৪৩ লাখ ৫ হাজার টাকা দেবে বাংলাদেশ সরকার।
জানা গেছে, ২০১৯ সালের ৯ জুলাই একনেক সভায় এই প্রকল্পটির অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন শেষ হলে চসিকের বিদ্যুৎ বিল কমে আসবে প্রায় অর্ধেকে। এছাড়াও বাতি নিয়ন্ত্রণের ৫শ সুইচের বদলে হবে মাত্র ৪টি কেন্দ্রিয় সার্ভার স্টেশন এবং সাশ্রয় হবে প্রায় সাড়ে ১২ লাখ টাকা।
চসিক সূত্র আরও জানা যায়, নগরীতে মোট ১ হাজার ৪৩ কিলোমিটার সড়কে বাতি রয়েছে। তারমধ্যে সোডিয়াম বাতি রয়েছে ৮শ ৯০ কিলোমিটার এবং এলইডি বাতি রয়েছে ১৫৩ কিলোমিটার। এদিকে অনুমোদিত প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ৪৬৭ কিলোমিটার সড়কে সোডিয়াম বাতির বদলে বসানো হবে এলইডি বাতি। তবে ওই সরানো সোডিয়াম বাতিগুলো নগরীর অবশিষ্ট সড়ক ও নতুন আবাসিকে সংযোজন করা হবে। ফলে নগরীর সবকটি সড়কে বসবে বাতি। এমনটাই মনে করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
প্রকল্পের উন্নয়ন প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সূত্রে জানা গেছে, ‘চসিকরে বিভিন্ন এলাকার সড়ক আলোকায়ন ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন কাজ’ শীর্ষক এ প্রকল্পের আওতায় ৪০, ৬০, ৯০, ১০০ ও ২৫০ ওয়াটের ২০ হাজার ৬০০টি এলইডি বাতি এবং ২০ হাজার ২৬৭টি জিআই পোল বসানো হবে। চসিকের গৃহীত এ প্রকল্পের আওতায় ৪১ ওয়ার্ডের প্রতিটিতে ১০ কিলোমিটার এলইডি লাইট লাগানো হবে। অন্যদিকে নগরীর আলোকায়নে প্রায় ৫১ হাজার ৫৭৩টি সোডিয়াম বাতি রয়েছে। বিভিন্ন মসজিদ, মন্দির ও সামাজিক সংগঠন কার্যালয়ের ১ হাজার ৫৩৪টি সুইচিং পয়েন্ট থেকে এই বাতিগুলো ‘অন-অফ’ করা হত। এ কাজে প্রত্যেক পয়েন্টে নিয়োজিত আছেন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের একজন করে মোট ১ হাজার ৫৩৪ জন ইমাম, মুয়াজ্জিন ও পুরোহিত। তাঁদের প্রত্যেককে ২ হাজার ৫শ টাকা করে সম্মানি প্রদান করে আসছে চসিক। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে এমন সুইচ কমে আসবে প্রায় ৫০০টি। ফলে চসিকের সাশ্রয় হবে সাড়ে ১২ লাখ টাকা।
জানা গেছে, স্মার্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে বাতিগুলোর সুইচ নিয়ন্ত্রণ করা হবে। যার জন্য স্থাপন করা হবে ৪টি কেন্দ্রিয় সার্ভার স্টেশন। যেখান থেকে সহজেই ‘অন-অফ’ ও কমানো-বাড়ানো যাবে। এছাড়াও প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পরবর্তী পাঁচ বছর পর্যন্ত সকল ধরনের ব্যবস্থাপনা খরচ বহন করবে বাস্তবায়নকারী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।
বর্তমানে ৪০ ওয়াট টিউব বাতি (ফ্লুরোসেন্ট ল্যাম্প), ৬৫ ওয়াট এনার্জি বাতি (সিএফএল), ১৫০ ওয়াট হাইপ্রেসার সোডিয়াম, ৪০০ ওয়াট মেটাল হ্যালাইড বাতি ব্যবহার করা হচ্ছে। এগুলোতে বেশি পরিমাণে বিদ্যুৎ অপচয় হয় এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইডও বৃদ্ধি করে। যা শহরে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করে ট্রফিক এবং পথচারীদের জন্য কার্যকর ও টেকসই সড়ক বাতির আলোক সুবিধা নিশ্চিত করা যাবে। রাত্রিকালীন শহরের সৌন্দর্য, ব্যবসায়িক সুবিধা, সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাবে। একই সঙ্গে কম কার্বন নির্গমন এবং শক্তি শোষণ সম্পর্কিত পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ট্রাফিক ও পথচারীর জন্য স্মার্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে সড়ক বাতির আলো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।