শঙ্খ গিলছে বালুখেকোরা

76

মিয়ানমার সীমান্তের দুর্গম মদক পাহাড় থেকে নেমে আসে শঙ্খ নদী। উঁচু দুর্গম পাহাড়, গহিন বনাঞ্চল, পাহাড়ি জনপদ মাড়িয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে চলা নদী চট্টগ্রামের চার উপজেলা পেরিয়ে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। পাহাড়ি এলাকার প্রকৃতির নির্দশন অসংখ্য ঝর্ণা থেকে সৃষ্ট হওয়া ছোট ছোট নদী এসে মিলিত হয়েছে শঙ্খ নদীতে। বান্দরবান অংশে স্বচ্ছ এ নদী তামাক চাষে গ্রাস হচ্ছে। চট্টগ্রাম অংশ গিলছে বালুখেকোরা। প্রতিনিয়ত বালু উত্তোলনের কারণে প্রতিদিন ভাঙনের কবলে পড়েছে শঙ্খ পাড়ের নতুন নতুন এলাকা। দূষণ-ভাঙনের কারণে বিপর্যস্ত হচ্ছে নদীর পরিবেশ ও প্রকৃতি। বদলে যাচ্ছে নদীর গতিপথ।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. দেলোয়ার হোসেন পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমরা সরকার নির্ধারিত বালুমহালগুলো ইজারা দিই। এর বাইরে কেউ বালু উত্তোলন করলে তা অবৈধ। অবৈধ বালুমহালে অভিযান চালাতে ইউএনওদের নির্দেশ দেয়া আছে। কেউ অবৈধ বালু উত্তোলনে জড়িত প্রমাণ পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
জানা যায়, বান্দরবান পেরিয়ে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, আনোয়ারা, বাঁশখালী উপজেলার কমপক্ষে ১২টি ইউনিয়নের উপর দিয়ে শঙ্খ নদী বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। নদীর এ যাত্রাপথে দুই পাড়ের মানুষ ভাঙনে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমন ক্ষতির প্রধান কারণ বালু উত্তোলন। প্রতিটি ইউনিয়নের বাঁকে বাঁকে বালু উত্তোলন করছে প্রভাবশালীরা। ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় থেকে তারা প্রতিনিয়ত ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করলেও মাঝেমধ্যে কয়েকটা অভিযান চালিয়ে দায় সারে প্রশাসনের লোকজন।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, চন্দনাইশের দোহাজারী ব্রিজের পাশ থেকে রেলওয়ের দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনে দেয়ার জন্য বালু উত্তোলন করছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন। অল্পদূরেই আকবর খান গংরাও প্রতিনিয়ত বালু তুলছে। বৈলতলীর জাফরাবাদ এলাকায় আবদুল মোনাফ ও আব্দুল মজিদের নেতৃত্বে কয়েকটি গ্রæপ শঙ্খ নদী থেকে বালু উত্তোলন করে। গত বছরের শেষদিকে কয়েকজন বালু ব্যবসায়ীকে অবৈধ বালু উত্তোলনের দায়ে লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
সাতকানিয়ার নলুয়া ইউনিয়নের মরফলা বাজার এলাকায় ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করছে একটি সিন্ডিকেট। শ্যাম মুহুরী হাট কালার ঘাটা এলাকায় শঙ্খ নদী থেকে প্রতিনিয়ত বালু তোলা হয়। গত জুন মাসে সেখানে অভিযান চালিয়ে মোহাম্মদ সিরাজ মিয়া ও আব্দুল মজিদ নামে দুইজনকে জরিমানা করলেও বালু উত্তোলন বন্ধ হয়নি। চরতি ইউনিয়নেও দুটি সিন্ডিকেট বালু উত্তোলন করে।
আনোয়ারার জুঁইদন্ডী ইউনিয়নে শঙ্খ নদী থেকে বালু উত্তোলনে আছে শক্তিশালী চক্র। রাজনৈতিক নেতাদের নাম ভাঙিয়ে সেখানে দুটি সিন্ডিকেট ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করছে। দীর্ঘ আট বছর ধরে সেখানে ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করলেও তাদের লাগাম টানতে পারেনি প্রশাসন। মো. আব্বাস, বদরুজ, মো. গফুর, মো. মঞ্জুর, গিয়াস উদ্দিন, মো. পারভেজ জুঁইদন্ডীর বালু উত্তোলনে জড়িত।
বাঁশখালীর পুকুরিয়া তেচ্ছিপাড়া এলাকায় প্রতিনিয়ত বালু উত্তোলন করছে সংঘবদ্ধ চক্র। নিচু জমি ভরাট ও নির্মাণ কাজে এসব বালু ব্যবহার হচ্ছে। বালু উত্তোলনের কারণে ভাঙনে তেচ্ছিপাড়া এলাকার কমপক্ষে ৩০টি বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। গত ২৫ জুলাই তেচ্ছিপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, একটি ড্রেজার মেশিন বসানো নৌকা তেচ্ছিপাড়ার বাঁকে বসিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। কাছে ঘেঁষতেই নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ করে পাইপলাইন সরানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়েন শ্রমিকরা। জানতে চাইলে তারা বলেন, ড্রেজার মেশিন বসানো নৌকার মালিক কালুরঘাটের জসিম। স্থানীয় মাহবুব নামে এক ব্যক্তি বালুগুলো ডলু খাল থেকে এনে খালাস করছেন। পরে স্থানীয় একজন জানান, এ ড্রেজার মেশিন দিয়েই নিয়মিত শঙ্খের বালু তোলা হচ্ছে। তৈলারদ্বীপ শঙ্খ সেতুর বাঁশখালী অংশ থেকে বালু উত্তোলন করছে একটি ড্রেজার। ব্রিজে চলাচলে ড্রেজারে বালু উত্তোলনের দৃশ্য চোখে পড়লেও তা বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নেই। খানখানাবাদ ঈশ^র বাবুর হাট, এলাকায় বোরহান উদ্দিন নামে এক বালু ব্যবসায়ী ড্রেজার মেশিনে বালু উত্তোলন করেন। এসব বালু নির্মাণাধীন বেড়িবাঁধ প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও বালু সরবরাহকারীরা কিনে নিচ্ছে।
বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোমেনা আক্তার পূর্বদেশকে বলেন, ‘কোথাও বালু উত্তোলনের খবর পেলেই আমরা অভিযান পরিচালনা করি। কয়েকটি স্থানে বালু উত্তোলনের নতুন করে খবর পেয়েছি। খোঁজ নিয়ে অভিযান চালানো হবে। জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।’
দোহাজারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু নোমান বেগ পূর্বদেশকে বলেন, ‘দোহাজারী ব্রিজের আশপাশের এলাকা থেকে প্রতিনিয়ত বালু উত্তোলন করছে। রেলওয়ের প্রকল্পে কিছু বালু সরবরাহ করা হচ্ছে। আর কেউ কেউ স্থানীয়ভাবে বালু উত্তোলন করে বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে সরবরাহ করছে। প্রতিনিয়ত বালু উত্তোলনের কারণে দোহাজারী ব্রিজটি আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’
পুকুরিয়ার ইউপি চেয়ারম্যান আসহাব উদ্দিন পূর্বদেশকে বলেন, ‘শঙ্খ সেতুর পাশ থেকে বালু উত্তোলন করছে আনোয়ারা মানুষ। আমার ইউনিয়নে কেউ বালু উত্তোলন করছে না।’