শক্তিশালী যন্ত্রেও ব্যাহত ড্রেজিং

67

দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা কর্ণফুলী নদীতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং কাজে তলদেশের চার মিটার নিচেও পলিথিন বর্জ্যরে অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এসব অপরিশোধিত পলিথিন বর্জ্য খনন কাজে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কমে যাচ্ছে ড্রেজিংয়ে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির কার্যক্ষমতাও। এ কারণে নয় মাস আগে শুরু হওয়া প্রকল্পটির কাজের অগ্রগতি যতটুকু হওয়ার কথা ছিল বাস্তবে তার চেয়ে অনেক কম হয়েছে।
এদিকে নির্ধারিত সময়ের পাঁচ মাস পরে কর্ণফুলী খনন কাজের জন্য গত বছরের মার্চে চীন থেকে আনা হয় ৩১ ইঞ্চি ব্যাসের অত্যাধিক শক্তিশালী সাকশন ড্রেজার। উন্নতমানের এই ড্রেজার দিয়ে প্রতি ঘণ্টায় আড়াই হাজার ঘনমিটার মাটি উত্তোলন করা সম্ভব। কিন্তু কর্ণফুলী নদীর তলদেশে পলিথিন বর্জ্যরে অত্যধিক চাপের কারণে ড্রেজার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ কারণে নদী থেকে সারাদিনে ৫ থেকে ৮ হাজার ঘনমিটারের বেশি মাটি উত্তোলন করা সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে কর্ণফুলীতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং শেষ হয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। অথচ খননকাজে কোনো বাধার সম্মুখীন না হলে কাজের অগ্রগতি ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ এগিয়ে যেত।
চট্টগ্রাম বন্দর হাইড্রোগ্রাফার বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত বছর ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে তিনটি ড্রেজার দিয়ে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। কিন্তু কর্ণফুলীর তলদেশ থেকে মাটি খনন করতে গিয়ে পলিথিন বর্জ্যরে কারণে বড় ধরনের বাধা আসে। এসব বর্জ্যরে কারণে খনন কাজে ব্যবহৃত ড্রেজার বারবার বন্ধ হয়ে যায়। এতে খনন কাজের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হয়ে পড়ে। তাই প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিতে গত বছরের মার্চে চীন থেকে ৩১ ইঞ্চি ব্যাসের শক্তিশালী সাকশন ড্রেজার আনা হয়। শক্তিশালী এই ড্রেজারও খনন কাজ করতে গিয়ে পলিথিনের কাছে হার মানে।
এদিকে নগরীর বিভিন্ন খাল সরাসরি কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়েছে। এসব খাল দিয়ে নদীতে যাওয়া লক্ষ লক্ষ টন ময়লা প্রতিদিন কর্ণফুলীতে জমাট হচ্ছে। এতে করে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে পলিথিনের বিশাল আস্তর তৈরি হয়েছে। প্লাস্টিক জাতীয় পণ্যের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় নদীকে গিলে খাচ্ছে এসব বর্জ্য। প্লাস্টিক, পলিথিন-জাতীয় বর্জ্য নদীর বিশাল জায়গা দখল করে আছে। এসব বর্জের মধ্যে রয়েছে, পলিথিন ব্যাগ, খাদ্য ও শিল্পের বিভিন্ন পণ্যের মোড়ক, শিল্পপণ্য, মুঠোফোন, ইলেকট্রনিকস, নির্মাণসামগ্রী, তৈজসপত্র, আসবাব, চিকিৎসা সরঞ্জাম ইত্যাদি।
চট্টগ্রাম বন্দরের চিফ হাইড্রোগ্রাফার কমান্ডার এম আরিফুর রহমান বলেন, আমরা ধরে নিয়েছিলাম নদীর তলদেশের এক থেকে দেড় মিটার নিচে পর্যন্ত পলিথিন থাকবে। কিন্তু বাস্তবে ৪ মিটারের নিচেও পলিথিনের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। ড্রেজার চালালেই একটু পর পর আটকে যাচ্ছে। নদীর সাথে সংযুক্ত খালগুলোর মুখে সবচেয়ে বেশি পলিথিন পাওয়া যাচ্ছে। এ কারণে খনন কাজে সবচেয়ে বড় বাধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে পলিথিন। এছাড়া খালগুলোর মধ্যে কর্ণফুলী ব্রিজের পুরোটাই, সদরঘাট, চাক্তাই ও রাজাখালী খালের মুখে পলিথিনের আস্তর বেশি পাওয়া যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ক্যাপিটাল ড্রেজিং কাজ ৩০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
খনন কাজে ব্যবহৃত চীন থেকে আসা শক্তিশালী সাকশন ড্রেজার সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ড্রেজার দিয়ে প্রতি ঘণ্টাই আড়াই হাজার ঘনমিটার মাটি উত্তোলন করা যাবে। কিন্তু পলিথিন বর্জ্যরে কারণে বাস্তবে সারাদিনে ৫ থেকে ৮ হাজার মাটি উত্তোলন করা সম্ভব হচ্ছে।
চিটাগাং শহরের সবধরনের ময়লা সরাসরি নদীতে পড়ছে উল্লেখ করে আরিফ বলেন, কর্ণফুলী নদীর সাথে সংযুক্ত খালগুলোর মুখে কোনো প্রতিবন্ধক না থাকাতে সব ময়লা নদীতে সরাসরি এসে পড়ছে। শহরের ময়লা সরাসরি নদীতে যাতে না পড়ে সেজন্য সিডিএকে ব্যবস্থা নিতে বন্দরের পক্ষ থেকে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
ক্যাপিটাল ড্রেজিং শেষ হলে কি ধরনের সুফল পাওয়া যাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় বিষয় হলো ৪০০ মিটারের একটি জেটি সচল হবে। পোর্টের মূল জেটিগুলোতে পলি জমা বন্ধ হবে। খালগুলো পরিষ্কার থাকায় চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা কিছুটা কমবে বলে আশা করি।
বন্দর সংশ্লিষ্টরা জানান, ক্যাপিটাল ড্রেজিং পূর্ণাঙ্গভাবে শেষে হলে বড় জাহাজ জেটিতে ভিড়তে পারবে, ছোট ছোট জাহাজ বেশি পরিমাণে নদীতে নোঙর করতে পারবে, নদীর তীরে সদরঘাট এলাকায় চারটি লাইটার জেটি চালু হবে। এতে করে বহির্নোঙর থেকে আনা আমদনিকৃত পণ্য জেটিতে নামানো অনেক সহজ হবে। সেই সাথে পণ্য খালাসের খরচও কমবে। একইভাবে নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। বর্ষাকালে চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা হলে কমবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়াল এডমিরাল জুলফিকার আজিজ বলেন, বন্দরের জেটিগুলোতে পলি জমে থাকায় জাহাজ ভিড়তে পারছে না। ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কাজ শেষ হলে এ সমস্যা নিরসন হবে। নির্বিঘেœ জাহাজ জেটিতে ভিড়তে পারবে। নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি পেলে লাইটারেজ জাহাজ চলাচল এবং বন্দরের অন্যান্য কার্যক্রমে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে।
উল্লেখ্য, কর্ণফুলী নদীর নাব্যতা ফেরাতে প্রায় ২৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘সদরঘাট টু বাকলিয়ার চর ড্রেজিং’ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। ই-ইঞ্জিনিয়ারিং ও চায়না হারবার নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশ নৌবাহিনী প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পের আওতায় সদরঘাট থেকে বাকলিয়ার চর পর্যন্ত প্রায় আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ২৫০ মিটার চওড়া এলাকায় ড্রেজিং করা হবে। এখান থেকে ৪২ লাখ ঘনমিটার মাটি তোলা হবে। প্রতি ঘনমিটার মাটি উত্তোলনে খরচ হবে ৩৭৩ টাকা। শুধু ড্রেজিংই নয়, পরবর্তী তিন বছর নদীকে রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে। গত বছরের ২৭ সেপ্টম্বর থেকে ড্রেজিংয়ের মূল কাজ শুরু হয়।

প্রতিক্রিয়া
পলিথিন উৎপাদন
ও বিপণন বন্ধ
করতে হবে

শক্তিশালী যন্ত্র দিয়েও কর্ণফুলীর ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্লাস্টিক বর্জ্যরে কারণে ব্যাহত হওয়ার বিষয়ে কর্ণফুলী বিশেষজ্ঞ ড. ইদ্রিস আলীর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি পূর্বদেশকে বলেন, পলিথিন বর্জ্য নির্মূল করতে হলে আগে পলিথিনের উৎস নির্মূল করতে হবে। অর্থাৎ পলিথিনের উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। সেই সাথে বন্ধ করতে হবে বাজারজাতকরণও। জনগণকে পলিথিন ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করতে হবে।
আর যত বেশি সম্ভব পঁচনশীল বস্তু দিয়ে পণ্যের মোড়ক তৈরি করতে হবে। সেইসাথে নান্দনিক কাগজ দিয়ে পণ্যের প্যাকটজাতকরণ বৃদ্ধি করতে হবে।
আমাদের দেশে আইনের প্রয়োগ ও তদারকি একবারেই নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, পলিথিনের ব্যবহার কমিয়ে আনার জন্য ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়কে সচেতন করতে হবে। পাট ও পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বাড়ানোর জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। যত্রতত্র পলিথিন ফেলে রাখা বন্ধ করতে হবে। রিসাইক্লিন সিস্টেম পরিবেশবান্ধব করতে হবে। সর্বোপরি সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে পলিথিন ব্যবহার বন্ধে আরো কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক আলিউর রহমান বলেন, পলিথিন বর্জ্যরে জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী হচ্ছে সিটি কর্পোরেশন ও চট্টগ্রাম ওয়াসা। ওয়াসার সুয়ারেজ প্ল্যান না থাকার কারণে এবং জনগণের অসচেতনতার জন্য চট্টগ্রাম মহানগরের ৭০ লাখ মানুষের ব্যবহৃত পলিথিন বর্জ্য সরাসরি কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়ছে। যে কারণে পলির সাথে পলিথিন মিশে কর্ণফুলী দ্রæত ভরাট হয়ে যাচ্ছে। কর্ণফুলী নদীকে বাঁচাতে হলে সিটি কর্পোরেশনকে আরো কঠোর হতে হবে। সেইসাথে কর্ণফুলীতে যাতে সরাসরি পলিথিন বর্জ্য না পড়ে সে জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।