লোকালয়ে মায়া হরিণেরা আসে

81

ব্রিটিশ বেনিয়ারা এই উপমহাদেশ শাসন ও শোষণ করার পর তারা এতদঞ্চলের মানুষের মাঝে কিছু বদ অভ্যাস রেখে যায়। বলা চলে উপমহাদেশের সংকর মানব গোষ্ঠি তাদের রেখে যাওয়া প্রথা, স্বভাব ও আচরণগুলো উত্তরাধিকার হিসাবে গ্রহণ করে। উদাহরণত বলা চলে লালফিতার দৌরাত্ম্য, তাদের মধ্যে অন্যতম। সমাজ বিশ্লেষকগণ এ ব্যাপারে আরো ভালো তথ্য দিতে পারবেন। পুর্তগীজ ও ইংরেজরা প্রথমে বাণিজ্য করতে আসে। পরবর্তীতে তারা দেশ শাসন করার মতলবে নানা দুরভিসন্ধি করে এক পর্যায়ে ভারতের শাসন ক্ষমতা দখল করে। এই ইংরেজরা দেশের সম্পদ যেমন পাচার করেছে, তেমনি এদেশের পাহাড় জঙ্গলের অবলা প্রাণীদের নির্বিচারে শিকার করেছে। তাদের নির্মম শিকারে এ দেশের বাস্ততন্ত্রের অনেক প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যায়। ইংরেজরা শিকার করার জন্য ব্যবহার করত অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। দেশিয় তথা নেটিভরা সে সুযোগ কম পেত। তবে ইংরেজদের চামচা কতিপয় জমিদার ও স্বার্থান্বেষি সে সুযোগ পেত। যাই হোক, সেসময় ইংরেজদের সাথে খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারের জন্য অনেক পাদ্রীদের আগমন ঘটে। এই ধর্মপ্রচারকগণ দেশের বর্ণপ্রথা নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সহজে ধর্মান্তরিত করতে সক্ষম হয়। ভারত উপমহাদেশের অধিকাংশ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীগণই হচ্ছেন নিম্নবর্ণের হিন্দুরা। চট্টগ্রামে এরা মাটিয়া (মেইট্যা) ফিরিঙ্গী নামে পরিচিত। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে এরা ফিরিঙ্গী নামে পরিচিত। ইংরেজরা শিকারে যাওয়ার সময় বিশ্বস্ত মনে করে এদের সাথে নিয়ে যেতেন। পরে তারা যখন এ দেশ থেকে চলে যাবার সময় হলো তখন তারা এদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দিয়ে যায়। আগে থেকেই এরা শিকারে অভ্যস্ত ছিল। ফলে তারা আগ্নেয়াস্ত্র বিশেষ করে বন্দুক, রাইফেলের মালিক হয়ে যায়।
ষাটের দশকে আমরা দেখেছি চট্টগ্রামের মাইট্যা ফিরিঙ্গীরা ছুটির দিনে দল বেঁধে চট্টগ্রামের খুলশী, জঙ্গল সলিমপুর, পাহাড়তলী, সীতাকুÐ, মিরসরাই, হাটহাজারী এতদঞ্চলের পাহাড়ে শিকার করতে যেত। চট্টগ্রাম ও তার আশপাশ এলাকায় তখনও ঝোপঝাড় ও জঙ্গল ছিল। সেখানে পাওয়া যেত বন্য শুকুর, খরগোস, বিভিন্ন প্রকারের হরিণ, বনকুকুর। মাঝে মাঝে বাঘ বা বন বিড়াল হত্যার কথা শোনা যেত। তবে বেশি পরিমাণে মারা যেত মায়া হরিণ, খরগোস ও বুনো ছাগল। শিকারিরা ৭০ দশক পর্যন্ত নির্বিচারে শিকার করে। মুক্তিযুদ্ধের পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। তখন সাধারণ মানুষের হাতে চলে আসে আগ্নেয়াস্ত্র। যার প্রেক্ষিতে বাকী যা ছিল তাও মারা পড়তে লাগলো। অন্য দিকে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শিল্পায়ন ও বসতি স্থাপনের জন্য ঝোপঝাড় পাহাড়টিলা নির্বিচারে ধ্বংস হতে শুরু হয়। ফলে ঐ সকল এলাকায় বন্যপ্রাণী দিনদিন বিলুপ্তির পথে এগুতে থাকে। দেশের সংবাদপত্রে বিশেষ করে চট্টগ্রামের সংবাদপত্রে লোকালয়ে বন্যপ্রাণী আসার সংবাদ সচিত্র ছাপা হয়ে থাকে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কবি ময়ুখ চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাহাড়ঘেরা শিক্ষক আবাসিক এলাকায় বাস করেন। তিনি তাঁর বাড়ির আঙ্গিনায় একদিন জ্যোসনা রাতে একটি মায়া হরিণ দেখার বিষয় নিয়ে একটি অতিচমৎকার কবিতা লিখেছিলেন। পাঠকের জন্য উদ্ধৃতি দেয়া যাক; কবিতার নাম ‘মাঝে মধ্যে হরিণেরা আসে’। হরিণেরা মাঝ রাতে হরিণীকে ডাকে/মৃগনাভি গন্ধে কাঁপে বাতাসেরা রাত্রির ডানায়/আকাশমনির পাতা বাদামী বিছানা পেতে দেয়/লতাগুল্ম শিহরিত শুভেচ্ছা জানায়।/হরিণেরা শান্তি চায়। মানুষের চোখে ঘুম নেই/আপাদমস্তক তারা খবরের কাগজে মোড়া,/রঙিন ধমনীজুড়ে রঙ্গিন টিভির হাতি-ঘোড়া।/এইসব মানুষের জানালার পাশে/মাঝেমধ্যে হরিণীরা আসে।/সংসার শিল্পের কলা শিখে নিয়ে সভ্য হতে চায়/অথচ হরিণ দ্যাখে ঘরে ঘরে ঘুমের ঔষধ/স্বপ্নের নিকট হাত পাতে, সেখানেও দুঃসংবাদ। /অতপর খুরধ্বনি ফিরে যায় বনের ভিতর, /খবর শোনে না বলে হরিণেরা রয়েছে সুন্দর। (তথ্য: প্রকৃতি নভেম্বর ২০১৫ প্রথম সংখ্যা)। আবাসিক এলাকায় কিংবা লোকালয়ে বন্যপ্রাণী আসায় একজন সৃজনশীল ব্যক্তির মন ও মনন ঘনীভ‚ত হয়ে পড়ে। তাঁর হৃদয় মথিত হয়ে রচনা হয় ানন্য সাধারণ এক কবিতা। যা আমাদের শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে হৃদ্ধ করেছে।
অন্য দিকে এধরনের বন্যপ্রাণী লোকালয়ে আসলে এক শ্রেণির লোকের মধ্যে মাংস খাওয়ার লোভ বেড়ে যায়। তারা বন্দুক বা শিকার করার হাতিয়ার না পেলে মাছ ধরার জাল দিয়ে, কিংবা বন্য মানুষের মতো পাথর মেরে তাদের হত্যা করে রসনা তৃপ্ত করে থাকে। ঝোপঝাড় বনজঙ্গল ও জলাশয়ে পরিযায়ী পাখি এলে তাদেরও নির্বিচারে হত্যা করে থাকে। বাংলাদেশের উপক‚ল, হাওর, বাওর সহ জলাশয় পীড়িত অঞ্চলে অবাধে পাখি শিকার হয়ে থাকে। শুধু শিকার নয় বড় বড় শহরাঞ্চলে প্রকাশ্যে বিক্রি করার সংবাদ আছে। আমি নিজে সিলেট, বগুড়া ও মুন্সীগঞ্জে শিকার করা পাখি প্রকাশ্যে বিক্রি হতে দেখেছি। খোদ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখের সামনে হাতে ঝুলিয়ে পাখি বিক্রি হতে দেখা যায়। সুন্দরবনে রাজনৈতিক, প্রশাসনের সহায়তায় নির্বিচারে হরিণ শিকারের তথ্য সামাজিক মাধ্যমে প্রচার হচ্ছে। কে রক্ষা করবে এই সকল বন্যপ্রাণীকে ? ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিতের মধ্যে কোন ফারাক নেই। হাতের নাগালে পেলেই হল। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকায় ঘেরায় একটি মায়া হরিণ আটকে যায়। একজন অধ্যাপক তাকে ধরে হালাল পদ্ধতিতে জবাই করে ভোজের ব্যবস্থা করেন। তখন অধ্যাপক আবু ইউসুফ ছিলেন উপাচার্য্য তিনি উক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছিলেন বলে জানা যায়।
সম্প্রতি ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় ‘লোকালয়ে মায়া হরিণ’ শিরোনামে সংবাদে উল্লেখিত চারিদিকে পাহাড় ও বন ধ্বংসের উল্লাস চলছে। উল্লাস ধ্বনিতে সন্ত্রস্ত বনজঙ্গলের বাসিন্দারা। বনবাসের পরিবেশের পাশাপাশি তীব্র খাদ্য সংকটে পড়েছে বন্যপ্রাণী। এর প্রমাণ মেলে দলবেঁধে হারিণেরা লোকালয়ে নেমে আসা দেখে। খাদ্য অন্বেষণে কয়েকমাস ধরে নগরের বিভিন্ন স্থানে দেখা মিলছে বনের মায়া হরিণের। চট্টগ্রাম নগরের আকবর শাহ কবরস্থান, শাহঘোনা এবং চিড়িয়াখানার আশে পাশের এলাকায় প্রতিদিন সকালে এসব হরিণ আসে প্রায় দু-তিন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে। ক্রমাগত পাহাড় কাটা এবং বন্যপ্রাণীর আসা নষ্ট করার কারণে এভাবে হরিণ নেমে আসছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। (সূত্র প্রথম আলো ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯)
শুধু হরিণ নয়, খাদ্যের প্রয়োজনে সরীসৃপ, হাতি এবং বিড়াল জাতীয় প্রাণী লোকালয়ে প্রবেশের সংবাদ প্রতিনিয়ত আসছে। এই পৃথিবী শুধু মানুষের জন্য নয়। বনবনানী ও জলাশয় বন্যপ্রাণী, কীটপতঙ্গ, পশুপাখিদের বসবাস, খাদ্যের প্রয়োজনে মহান আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। এই বাস্তুতন্ত্র শুধু মানুষের প্রয়োজনে ধ্বংস করা অন্যায়। খাদ্য শৃঙ্খল ও জীব শৃঙ্খলের মাঝে যদি কেউ বিলুপ্ত হয়ে যায়, তাতো পৃথিবীর এই গ্রহে বসবাসরত অন্য প্রাণীর জন্য হুমকী হয়ে দাঁড়াবে।
বিবেকবান ও জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ কী বুঝতে পারছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া ? এই গ্রহ ক্রমশ উষ্ণতর হচ্ছে। উত্তরাঞ্চলে বরফ গলে সাগর মহা সাগরের পানির উচ্চতা বাড়াচ্ছে। উপকূলীয় দেশসমূহে পানির উচ্চতা বাড়ছে। তারপরও কী মানুষ সতর্ক হবে না ? বনের বসবাসকারী প্রাণীদের বাঁচাতে হবে। ওরা আমাদের জীব শৃঙ্খলের অংশ। কবি জীবনানন্দের ভাষায় বলা যায়, ‘কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার ; / বনের ভিতরে আজ শিকারীরা আসিয়াছে/ আমিও তাদের ঘ্রাণ পাই যেন। আজ শিকারী ছাড়াও বন্যপ্রাণীর জন্য আতঙ্ক হচ্ছে মানুষের উন্নয়ন প্রচেষ্টা। লোকালয় ও শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করার জন্য নির্বিচারে ধ্বংস হচ্ছে প্রকৃতি, বন বনানী। মানব জাতির বলগাহীন ও পরিবেশ ক্ষতিকর উন্নয়ন একদিন এই গ্রহের জন্য হুমকী হিসাবে দেখা দিতে পারে। এই গ্রহ যেভাবে উষ্ণ হচ্ছে দাবানলে জ্বলে পুড়ে সব যে ছাই হবে না সেকথা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারেন !
লেখক : কবি, নিসর্গী, ব্যাংক নির্বাহী (অব.)