‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ সর্বোত্তম যিক্র

15

সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী

যিক্র মানে স্মরণ করা, মনে করা, উল্লেখ করা, বর্ণনা করা। আর শরীয়তের পরিভাষায় যিক্র হল, মুখে বা অন্তরে আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করা এবং তাঁর প্রশংসা করা। যিক্র সৃষ্টিকে ¯্রষ্টার সান্নিধ্য লাভের পথ সুগম করে এবং উত্তম আদর্শ ও সরল-সঠিক পথের উপর অবিচল রাখে। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমদেরকে সর্বদা যিক্রে নিমগ্ন থাকার নির্দেশ প্রদানপূর্বক এরশাদ করেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা অধিক হারে আল্লাহর যিকর কর এবং সকাল সন্ধ্যা তাঁর তাসবীহ পাঠ কর। [সূরা আল-আহযাব, ৪১-৪২]
আল্লাহ তা‘আলা আরও এরশাদ করেন, “আর আপনি আপনার রব্বকে স্মরণ করুন মনে মনে, মিনতি ও ভীতিসহকারে, অনুচ্চস্বরে; সকালে ও সন্ধ্যায়। আর উদাসীনদের অন্তর্ভুক্ত হবেন না।” [আ’রাফ-২০৫]
আল্লাহ তা‘আলা আরও এরশাদ করেন, “অতএব তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদেরকে স্মরণ রাখব। আর তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর এবং আমার প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়ো না।” [বাক্বারাহ-১৫২]
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি তার রবের যিক্র (স্মরণ) করে, আর যে ব্যক্তি তার রবের যিক্র করে না তারা যেন জীবিত আর মৃত।”[বুখারী- ৬৪০৭; মুসলিম- ৭৭৯]।
তিনি আরও এরশাদ করেন, “যদি কোনো একদল লোক এমন কোনো বৈঠক থেকে উঠল, যেখানে তারা আল্লাহ্র নাম স্মরণ করেনি, তবে তারা যেন গাধার লাশের কাছ থেকে উঠে আসল। আর এরূপ মজলিস তাদের জন্য আফসোসের কারণ হবে”। (আব‚ দাউদ- ৪৮৫৫)
তিনি আরও এরশাদ করেন, “যদি কোনো দল কোনো বৈঠকে বসে আল্লাহ্র যিক্র না করে এবং তাদের নবীর ওপর দরূদও পাঠ না করে, তাহলে তাদের সেই বৈঠক তাদের জন্য কমতি ও আফসোসের কারণ হবে। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদেরকে শাস্তি দেবেন, অথবা তিনি চাইলে তাদের ক্ষমা করবেন।” (তিরমিযী-৩৩৮০।)
এক ব্যক্তি আল্লাহর রাসূলের খেদমতে আরয করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ইসলামের বিধি-বিধান আমার জন্য বেশি হয়ে গেছে। কাজেই আপনি আমাকে এমন একটি বিষয় সম্পর্কে বলে দিন, যা আমি শক্ত করে আঁকড়ে ধরব। তখন তিনি এরশাদ করলেন, “তোমর জিহŸা যেনো সর্বক্ষণ আল্লাহ্র যিক্রে সজীব থাকে।” (তিরমিযী-৩৩৭৫; ইবন মাজাহ্- ৩৭৯৩)
যিকরের উপকারিতা : ১- অন্তরে প্রশান্তি লাভ : আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন, “যারা ঈমান আনে এবং আল্লাহর স্মরণে যাদের চিত্ত প্রশান্ত হয়; জেনে রাখ, আল্লাহর স্মরণেই চিত্ত প্রশান্ত হয়।” (সূরা রাদ : ২৮)
২- আল্লাহর যিক্র সর্বাধিক মহান : আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন, “আর আল্লাহর স্মরণই তো সর্বশ্রেষ্ঠ।” [সূরা আনকাবুত ৪৫]
৩- যিকরকারীর জন্য ক্ষমা ও পুরস্কারের প্রতিশ্রæতি : আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন, “আর আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণকারী পুরুষ ও নারী, আল্লাহ তাদের জন্য ক্ষমা ও বিরাট পুরস্কার প্রস্তুত করে রেখেছেন। [আহযাব-৩৫]।”
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র যিকর : ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ সর্বোত্তম যিকর। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, “সর্বোত্তম যিকির, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ ও সর্বোত্তম দো‘আ, আল-হামদুলিল্লাহ”। (তিরমিযী-৩৩৮৩; ইবন মাজাহ-৩৮০০)
এ কালেমাটি যে ব্যাক্তি খালেস অন্তর থেকে বলবে, কিয়ামতের দিন সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুপারিশ লাভে ধন্য হবে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, “কিয়ামতের দিন আমার সুপারিশ লাভ করে সবচেয়ে বেশি ভাগ্যবান সে-ই হবে, যে নিজের অন্তর থেকে খালিসভাবে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে”।( বুখারী- ৯৯)
তিনি আরও এরশাদ করেন, “যে কোনো বান্দা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলে আর এর উপর অটল থাকে ও এ অবস্থায় তার মৃত্যু হয় সে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে।” ((বুখারী-৫৮২৭; মুসলিম-২৮৩))
তিনি আরও এরশাদ করেন, “যার সর্বশেষ বাক্য হবে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, সে নিশ্চিত জান্নাতে প্রবেশ করবে। ”(আহমদ: ৫/২৪৭; আবু দাউদ-৩১১৬)
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘বেহেশতের চাবি হচ্ছে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’।’ (মুসনাদে আহমদ, ৫/২৪২, হাদীস :২২১০২)
‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর অর্থ বুঝে পূর্ণ ইখলাস সহকারে উচ্চারণ করতে হবে
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুখে উচ্চারণ করাই যথেষ্ট নয়; বরং তার হক ও শর্তসমূহ পূর্ণ করা জরুরি। তথা এ মহান বাণীর অর্থ জেনে-বুঝে তা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করা ও পূর্ণ ইখলাসসহ উচ্চারণ করা । আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন, “জেনে রাখ যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই”। [সূরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ১৯]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, “যে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র অর্থ জানা অবস্থায় মারা গেল সে জান্নাতে যাবে”।( মুসলিম- ৩৬)
তিনি আরও এরশাদ করেন, “এ দেয়ালের পশ্চাতে তুমি যাকে পাবে, সে যদি নিজের অন্তর থেকে দৃঢ় বিশ্বাসসহ ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র সাক্ষ্য প্রদান করে, তাকে জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান কর”। (মুসলিম- ৩১, ১৫৬)
কালেমা’র ক্ষেত্রে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র সাথে ‘মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ’ অংশটি যুক্ত করা অবশ্যক
উল্লেখ্য যে, আমরা যখন ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’কে কালেমায়ে তাইয়্যেবা অথবা কালেমায়ে শাহাদাতের অংশ হিসেবে বর্ণনা করব তখন ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র সাথে ‘মুহাম্মর্দু রাসূলুল্লাহ’ অংশটি যুক্ত করা অবশ্যক। এ অংশটি ছাড়া কালেমা পূর্ণ হবেনা।
কারণ এ কালিমাটি হলো ইসলামে প্রবেশের একমাত্র দরজা। এর উপর স্থাপিত দ্বীন ও ঈমানের আকাশ-ছোঁয়া মিনার। আজন্ম কাফের-মুশরিকও যদি এ কালিমা গ্রহণ করে এবং বিশ্বাসের সঙ্গে পাঠ করে তাহলে মুহূর্তের মধ্যে সে মুমিন ও মুসলমানরূপে আত্মপ্রকাশ করে; দুনিয়া ও আখেরাতের চির মুক্তি ও নাজাতের অধিকারী হতে পারে।
যে ব্যক্তি খাঁটি দিলে তাওহীদ ও রেসালাতের স্বীকৃতি দেবে তার জন্য রয়েছে বড় সুসংবাদ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, “এমন কেউ যে অন্তরের সততা থেকে সাক্ষ্য দিবে আল্লাহ ছাড়া কোনো মা‘বুদ নেই এবং হযরত মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল, অবশ্যই আল্লাহ তার ওপর জাহান্নাম হারাম করে দিবে।” (বুখারী-১২৮; মুসলিম-৩২)
তিনি আরও এরশাদ করেন,“আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং আমি তার রাসূল। যে কোনো বান্দা এ দু’টি বিষয় সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করা ব্যতীত আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবে সে জান্নাতে যাবে”।(মুসলিম-২৭)
‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র রয়েছে মহান ফযীলত-মর্যাদা ও বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এটি সর্বোত্তম, সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে মহান। উচ্চারণে অতি সহজ হলেও কিন্তু কিয়ামতের দিন মীযানের পাল্লায় হবে অনেক ভারী। এটাই মজবুত রশি ও তাকওয়ার বাহন, দীনের মহা রুকন ও ঈমানের মূল ভিত্তি। এ বাক্যটির দ্বারা জান্নাত লাভ হয় ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি মিলে। এটি জান্নাতের চাবি, দীনের মূল শিক্ষা, মৌলিক স্তম্ভ ও প্রধান শিরোনাম। যে ব্যক্তি সত্য-সত্যই কায়মনোবাক্যে এ বাক্যটি পাঠ করবে আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন- ইনশা আল্লাহ।

লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, সাদার্ন
বিশ্ববিদ্যালয়, খতীব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ