লাশের অপেক্ষায় থাকেন তারা, ভাড়া নিয়ে বাণিজ্য

41

করোনাকালেও থেমে নেই মৃত্যুর মিছিল। প্রতিদিনই সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে অথবা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাচ্ছে রোগী। এসব মরদেহ পরিবহনের অপেক্ষায় থাকেন অ্যাম্বুলেন্স চালকরা। গন্তব্যে পৌঁছে দিতে স্বজনদের সঙ্গে এই চালকদের ভাড়া নিয়ে বাগবিতন্ডা এখন নিত্যদিনকার ঘটনা।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল ঘিরে গড়ে ওঠা একটি চক্রের কাছে অসহায় এসব অ্যাম্বুলেন্সের মালিক ও চালকরা। তাদের অভিযোগ, ওই চক্রের কারণেই নিতে হচ্ছে বেশি ভাড়া। দিতে হচ্ছে চাঁদা। চাঁদা না দিলে চমেক হাসপাতাল থেকে রোগী বা মরদেহ নিয়ে বাইরে যাওয়া কিংবা জরুরি বিভাগের সামনে যাওয়া যায় না।
চমেক হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১ হাজার ৩১৩ শয্যার এ হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ১৫-২০ জন রোগী মারা যায়। রোগী ও মরদেহ পরিবহনের ক্ষেত্রে অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া নৈরাজ্য বন্ধে দুই বছর আগে নীতিমালা করা হয়। এ জন্য চালকদের কিছু নির্দিষ্ট শর্তও দেওয়া হয়।
শুরুতে এ নীতিমালা মেনে কিছুদিন চললেও তদারকির অভাবে পরে আবারও একই অবস্থায় ফিরে গেছেন অ্যাম্বুলেন্স চালকরা। করোনার এই সময়ে রোগী বা মরদেহ পরিবহনে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের অজুহাতে নেওয়া হচ্ছে দ্বিগুণ ভাড়া। খবর বাংলানিউজের
চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মরদেহবাহী গাড়ি নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি কক্ষ চালু করেছিল, যেখানে দায়িত্ব পালন করেন হাসপাতালের একজন কর্মচারী। মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্সগুলোর তালিকা ও প্রয়োজনীয় তথ্যাদি নিয়ন্ত্রণ কক্ষে লিপিবদ্ধ করা হতো। এখন এসব কার্যক্রম বন্ধ।
নীতিমালা অনুযায়ী ৩টি ক্যাটাগরিতে নন-এসি, এসি ও ফ্রিজার ভ্যানের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছিল। আসা-যাওয়া মিলে ১০ কিলোমিটার নন এসি ছোট ও বড় অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া ৮০০ টাকা, এসি ও ফ্রিজার ভ্যান ৯০০ টাকা, ২০ কিলোমিটারে নন এসি ছোট ও বড় ১ হাজার ২০০ টাকা, এসি ও ফ্রিজার ১ হাজার ৩০০ টাকা, ৩০ কিলোমিটারে নন এসি ছোট ও বড় ১ হাজার ৮০০ টাকা, এসি ও ফ্রিজার ভ্যান ১ হাজার ৯০০ টাকা, বিমানবন্দর পর্যন্ত ৪৫ কিলোমিটারে নন এসি ছোট ও বড় ২ হাজার ২০০ টাকা এবং এসি ও ফ্রিজার ভ্যান ভাড়া ২ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
এছাড়া আন্তঃনগরে নন এসি ছোট গাড়ি (১৮শ সিসির নিচে) ১ হাজার ৫০০ টাকা স্থির খরচের সঙ্গে প্রতি কিলোমিটারে ১৪ টাকা, বড় গাড়ি (১৮শ সিসি ও তার চেয়ে বেশি) ১ হাজার ৫০০ টাকা স্থির খরচের সঙ্গে প্রতি কিলোমিটারে ১৭ টাকা, এসি ও ফ্রিজার ভ্যান ১ হাজার ৫০০ টাকা স্থির খরচের সঙ্গে প্রতি কিলোমিটারে ১৯ টাকা, পাহাড়ি অঞ্চলে প্রতি কিলোমিটারে ১০ শতাংশ বেশি এবং ফ্রিজার ভ্যানের ওয়েটিং চার্জ গন্তব্যে পৌঁছানোর পর প্রথম ঘণ্টা ফ্রি থাকার কথা ছিল।
এরপর বিদ্যুৎ ব্যবহারে প্রতি ঘণ্টায় ৩০০ টাকা, পরিবহনের বিদ্যুৎ ব্যবহারে প্রতি ঘণ্টায় ৩৫০ টাকা ও অক্সিজেনের জন্য নতুন সিলিন্ডার প্রতি ২২০ টাকা গ্রাহককে পরিশোধের নিয়ম চালু করা হয়। পাশাপাশি গাড়িগুলো নির্দিষ্ট জায়গায় পার্কিং ও সর্বোচ্চ পাঁচটি গাড়ি পার্কিংয়ে অবস্থান করতে পারবে। অপেক্ষমাণ গাড়িগুলো সিরিয়াল অনুযায়ী ভাড়া পাবে বলে নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছিল।
জানা গেছে, চট্টগ্রামে অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতির আওতায় শতাধিক অ্যাম্বুলেন্স ও প্রায় ৮০ জন চালক রয়েছে। আশপাশের উপজেলা ও জেলা থেকে প্রতিদিন ৩০-৩৫টি অ্যাম্বুলেন্সে করে চমেক হাসপাতালসহ অন্যান্য হাসপাতাল-ক্লিনিকে রোগী ও মরদেহ পরিবহন করা হয়।
হাসপাতালের সামনে অপেক্ষায় থাকা চালকরা রোগী বা মরদেহ এলেই শুরু করে টানাটানি। সবারই আগে থেকে ঠিক করে রাখা ভাড়া পরিশোধের শর্তে স্বজনরা নিস্তার পান হয়রানি থেকে। অনেক সময় ঘটছে ভাড়া নিয়ে মারামারির ঘটনাও।
বাইরে থেকে আসা অ্যাম্বুলেন্স চালকরাও হাসপাতালকেন্দ্রিক চক্রের হাতে নাজেহাল হচ্ছেন। ওই চক্রের দালালরা রোগীর স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে গন্তব্যে যাওয়ার ভাড়া ঠিক করে দিচ্ছে। ভাড়ার ৪০ শতাংশ নিজেরা নিয়ে বাকি টাকা দেওয়া হচ্ছে চালককে। সেই টাকার ৪০-৪৫ শতাংশই আবার দিতে হয় অ্যাম্বুলেন্স মালিককে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন অ্যাম্বুলেন্স চালক বলেন, চমেক এলাকার এই চক্রের দালালদের কাছে চালক-মালিকরা জিম্মি হয়ে আছে। তাদের চাঁদা না দিলে মারধরও করা হয়।
কয়েকদিন আগে মো. আলমগীর হোসেন নামের এক অ্যাম্বুলেন্স (চট্টমেট্রো-চ-১১-০৩৬০) চালককে মইজ্জ্যারটেক এলাকায় এবং চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে দুই দফায় মারধর করে দালালরা। তার অপরাধ, মরদেহ পরিবহনের জন্য দুই হাজার টাকা ভাড়ার চুক্তি করেছিল। এরমধ্যে ১ হাজার টাকা দালালদের না দেওয়ায় তাকে পেটানো হয়। এ ব্যাপারে পাঁচলাইশ থানায় তানভীর ও সুমন নামে দুই দালালের নাম উল্লেখ করে অভিযোগও দায়ের করা হয়েছে।
অ্যাম্বুলেন্স পরিবহন মালিক সমিতির নেতা মোহাম্মদ নুরু বলেন, রোগী ও মরদেহ পরিবহনের ক্ষেত্রে সাধারণত নীতিমালা অনুযায়ী স্বজনদের কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া হয়। ওয়ার্ড মাস্টার অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া নির্ধারণ করে দেওয়ার পাশাপাশি টাকার রশিদও বুঝিয়ে দেন। তবে বাইরে থেকে আসা অ্যাম্বুলেন্সে রোগী ও মরদেহ পরিবহনের ক্ষেত্রে বেশি ভাড়া দিতে হয়। এজন্য চমেক হাসপাতাল এলাকার একটি দালাল চক্র দায়ী।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপ পরিচালক ডা. আফতাবুল ইসলাম বলেন, রোগী ও মরদেহ পরিবহনের ক্ষেত্রে যে নীতিমালা তৈরি করা হয়েছিল তা এখনও বহাল আছে। তবে এরপরও অ্যাম্বুলেন্সে রোগী নেওয়ার জন্য অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও নানা অব্যবস্থাপনার অভিযোগ পেয়েছি।
তিনি বলেন, মঙ্গলবার (৩০ জুন) অ্যাম্বুলেন্স পরিবহন মালিক সমিতির নেতাদের আমরা ডেকেছিলাম। তাদের স্পষ্ট বলে দেওয়া হয়েছে, ৫শ টাকার ভাড়া করোনার এই সময়ে সর্বোচ্চ ৭শ টাকা তারা নিতে পারে। কিন্তু এর বেশি নেওয়া হলে তা হবে অনৈতিক। এছাড়া হাসপাতালের পার্কিং এরিয়ার সর্বোচ্চ পাঁচটি অ্যাম্বুলেন্স রাখার ব্যাপারেও তাদের জানানো হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী ভাড়া নিতে হবে। বিষয়টি আমরা মনিটরিং করছি।