লাল হলুদে সেজেছে চবি

46

শাহরিয়াজ মোহাম্মদ, চবি

বসন্ত বিদায় নিয়েছে। শীতের শেষে যেভাবে ঘটা করে বসন্তকে বরণ করে নেয়া হয়, সেভাবে যাওয়ার সময় বসন্তকে বিদায় দেয়া হয় না। একইভাবে বরণ করা হয় না বসন্তের পরে আসা গ্রীষ্মকেও। বলা হয় বসন্ত আসে শীতের মলিনতা ভেদ করে চারিদিকে সজিবতার বার্তা নিয়ে। বসন্তে প্রকৃতির চারিদিকে সবুজে ভরে উঠে। গাছে গাছে কচি পাতারা চোখ মেলে ধীরে ধীরে। নানা রঙের ফুল ফোটে, পাখিরা গান গায় নানান সুরে। তাইতো বসন্তকে বরণের জন্য চারিদিকে ধুম পড়ে।
কিন্তু বসন্তের শেষে গ্রীষ্ম আসে খরতাপ এবং রুক্ষতার বার্তা নিয়ে। রৌদ্রের তাপে প্রকৃতি ও প্রাণিক‚ল হয়ে উঠে অতিষ্ঠ। মাঠ ফেটে হয়ে যায় চৌচির। কিন্ত এসব কিছুর মাঝেও গ্রীষ্ম তার শোভা ছড়াতে ভুলে না। লাল আর হলুদ রঙের শোভা ছড়িয়ে দেয়ার আহবান নিয়ে আসে গ্রীষ্ম। গ্রীষ্মকালে প্রকৃতিতে দেখা যায় লাল কৃষ্ণচ‚ড়া, হলুদ রঙের সোনালু এবং বেগুনী রঙের জারুল ফুল।
চট্টগ্রাম বিদ্যালয়ের (চবি) ক্যাম্পাসও এর ব্যতিক্রম নয়। এই গ্রীষ্মের খরতাপকে সরিয়ে দিয়ে চবি ক্যাম্পাসে তার জায়গা দখল করেছে কৃষ্ণচূড়া, সোনালো ও জারুল ফুল। ক্যাম্পাসের জায়গায় জায়গায় বসেছে লাল, হলুদ ও বেগুনী রঙের পশরা।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, চবি ক্যাম্পাসের সমাজবিজ্ঞান অনুষদ, আইন অনুষদ, শিক্ষা ও গবেষণা ইনিস্টিটিউট প্রাঙ্গণ, বিবিএ অনুষদ প্রাঙ্গণ, জীববিজ্ঞান অনুষদ এলাকা, শহীদ মিনার, কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ এলাকা, বঙ্গবন্ধু হল প্রাঙ্গণ, শহীদ আবদুর রব হল, শাহজালাল হল, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার চত্বর, টিচার্স কলোনি, স্টেশন চত্ত্বরসহ ক্যাম্পাসের প্রায় সবর্ত্রই গ্রীষ্মের এসব ফুল ফুটেছে। এসব ভিন্ন ভিন্ন রং চবি ক্যাম্পাসকে এক নতুন রূপ দিয়েছে। শিক্ষার্থীরা ক্লাসে যাওয়ার পথে কিংবা ক্লাস শেষে নিজ গন্তব্যে ফেরার পথে অল্পক্ষণের জন্য হলেও থমকে দাঁড়ান ক্যাম্পাসের এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে। কেউ এসব ফুলের মনোরম দৃশ্যটিকে পেছনে রেখে ছবি তোলেন। আবার কেউ অতি যত্নে কুড়িয়ে নেন প্রিয় মানুষের হাতে তুলে দেবেন বলে।
ক্যাম্পাসের মনোরম এসব দৃশ্যকে ক্যামেরায় ধারণ করছিলেন ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষার্থী আফরিদা অপি। এসময় তিনি বলেন, গ্রীষ্মের প্রচন্ড তাপদাহে জনজীবন যখন অতিষ্ঠ, ঠিক তখনই যেন মানুষকে একটু স্বস্তি দিতে ধরাধামে আবিভর্‚ত হয় কৃষ্ণচূড়া, সোনালু ও জারুল ফুল। আমাদের মুগ্ধ করে ক্যাম্পাসের সবুজ বৃক্ষের এসব ফুলের সমাহার। ক্যাম্পাসে পা দিয়েই কিছুক্ষণ কৃষ্ণচ‚ড়ার দিকে তাকিয়ে থাকি। গ্রীষ্মের খরা রোদে যখন এই গাছের ছায়ায় একটু প্রশান্তির খোঁজ করি তখন বর্ণিল রঙের ফুলগুলো মনকে প্রফুল্ল করে তোলে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী সোহেল মাহমুদ বলেন, প্রতিবছর গ্রীষ্মকালের এই সময়ে ক্যাম্পাসের প্রতিটি জায়গা সোনালু, কৃষ্ণচ‚ড়া ও জারুল ফুলে ছেঁয়ে যায়। এক সাথে অজস্র ফুলের সম্ভার ক্যম্পাসকে এক টুকরো স্বর্গে পরিণত করে। যা স্ব-চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। আর কৃষ্ণচ‚ড়ার লাল আবীরের সৌন্দর্য তো বর্ণনা করার মতো না।
জানা যায়, সোনালু ফুলের আদি নিবাস হিমালয় অঞ্চল। তবে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও মায়ানমার অঞ্চল জুড়ে এর বিস্তৃতি রয়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় নিউ সাউথ ওয়েলস ও কুন্সল্যান্ডের উষ্ণ অঞ্চলে এদের প্রচুর দেখা মেলে। সোনালু গাছ সাধারণত ১৫ থেকে ২০ মিটার উঁচু হয়ে থাকে। এটি একটি পত্রঝরা বৃক্ষ, শীতে গাছের সমস্ত পাতা ঝরে গিয়ে পত্রশূন্য হয়ে পড়ে সোনালু গাছ। গ্রীষ্মে গাছের শাখা- প্রশাখাজুড়ে ঝুলন্ত মঞ্জুরিতে সোনালী হলুদ রঙের ফুল ফুটে। এর ব্যাপ্তি থাকে পুরো গ্রীষ্মকাল জুড়ে।
অন্যদিকে কৃষ্ণচ‚ড়ার আদি নিবাস পূর্ব আফ্রিকার মাদাগাস্কারে। কৃষ্ণচ‚ড়া গাছের উচ্চতা ১১-১২ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। তবে এর শাখা-পল্লব অনেক দূর পর্যন্ত ছড়ানো থাকে। আবহাওয়া অনুক‚লে থাকলে বাংলাদেশে কৃষ্ণচ‚ড়া ফুল ফোটে এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত। কুঁড়ি আসার কিছুদিনের মধ্যে পুরো গাছ ফুলে ফুলে ভরে যায়।
এছাড়া বাংলাদেশের নিম্নভূমির একান্ত অন্তরঙ্গ তরুদের অন্যতম জারুল গাছ। লেজারস্ট্রমিয়া গণের এই উদ্ভিদ দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক প্রজাতি। এটি মধ্যমাকৃতির পত্রমোচী বৃক্ষ। ধূসর মসৃণ কান্ডবিশিষ্ট জারুল ২০ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। এর পত্র বৃহৎ, ৬-৮ ইঞ্চি দীর্ঘ, আয়তাকৃতির মসৃণ ও দেখতে গাঢ় সবুজ। এর পাতার পিঠের রঙ ঈষৎ সবুজ। এর পত্রবিন্যাস বিপ্রতীপ। মঞ্জরী অনিয়ত, শাখায়িত, বহুপৌষ্পিক ও প্রান্তিক। জারুলের ফুলের বেগুনি বর্ণ যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি শোভন-সুন্দর তার পাঁপড়ির নমনীয় কোমলতা। ছয়টি মুক্ত পাঁপড়িতে গঠিত এর ফুল। যদিও এর রং বেগুনি, তবুও অনেক সময় এর রং সাদার কাছাকাছি এসে পৌঁছায়। এর বৈজ্ঞানিক নাম লেজারস্ট্রমিয়া স্পেসিওজা। নামটির প্রথমাংশ এসেছে সুইডেনের অন্যতম তরু অনুরাগী লেজারস্ট্রমের নাম থেকে। স্পেসিওজা ল্যাটিন শব্দ, অর্থ সুন্দর। জারুলের আদি নিবাস চীন, মালয় ও বাংলা-ভারতের জলাভূমি অঞ্চল।