লালদীঘির মেলায় ‘গরমের বন্ধু’ চন্দনাইশের ‘হাত পাখা’

146

মো. শাহাদাত হোসেন, চন্দনাইশ

গ্রীষ্মের তীব্র তাপদাহে যখন প্রাণ ওষ্ঠাগত। লোডশেডিংয়ের কারণে বৈদ্যুতিক পাখা যখন ঘুরে না, ঠিক তখনি একটু শীতল পরশের ছোঁয়া মেলে হাতপাখায়। হাতপাখার শীতল বাতাস কিছুটা হলেও প্রশান্তির ছোঁয়া এনে দেয়। আর এ প্রশান্তির উপকরণ তৈরিতে নিয়মিত কাজ করে চলেছেন চন্দনাইশ উপজেলার তিন শতাধিক পরিবার।
চন্দনাইশের কয়েকটি গ্রামে এখনো বহু পরিবার হাত পাখা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। চন্দনাইশে তৈরি এ হাতপাখার সুখ্যাতি দেশ ছেড়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। এখানে তৈরি অনেক উন্নতমানের হাতপাখা বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। তাছাড়া যেসব বিচ্ছিন্ন এলাকায় এখনো বিদ্যুৎ পৌঁছেনি, সেসব এলাকায় গরমের বন্ধু হয়ে থাকে এ হাতপাখা। হাতপাখার বিকল্প কোন ব্যবস্থা সৃষ্টি না হওয়ায় এখনও জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছে এই পণ্যটি।
চন্দনাইশ উপজেলার দক্ষিণ জোয়ারা জিহস ফকির পাড়া, দক্ষিণ গাছবাড়ীয়া ছিকন কাজী পাড়ায় নানা ধরনের হাতপাখা বানানো হয়। তবে সবচেয়ে সুপরিচিত এলাকা হচ্ছে দক্ষিণ জোয়ারা জিহস ফকির পাড়া। ১৯৪২-৪৩ সালে ব্রিটিশ শাসন আমলে আবদুল বারীহাট এলাকার সাহাব মিয়া, বদর রহমান, আবুল হাশেমসহ বেশ কয়েকজন জীবিকার সন্ধানে বের হয়ে এ শিল্পের কাজ শিখে আসেন। তারাই চন্দনাইশে হাত-পাখা শিল্পের গোড়াপত্তন করে বলে জানা যায়।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, এলাকার নারী-পুরুষ-শিশু সকলে একসাথে পাখা তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে এখন। বাড়ির পুরুষেরা হাতপাখা তৈরির সরঞ্জাম ও উপকরণ সংগ্রহ করে থাকে। আর শৈল্পিক কাজ সুনিপুণভাবে শেষ করে বাড়ির মহিলারা।
জিহস ফকির পাড়ার মো. সেলিম্ উদ্দীন, আহমদ হোসেন, আলী হোসেন জানান, এ পাখা বিক্রি করেই তাদের সংসার চলে। পরিবারের অন্যান্য কাজ সেরে সকলে মনোনিবেশ করে পাখা শিল্পের কাজে। বাড়ির মহিলারা এ শৈল্পিক কাজটি বাঁচিয়ে রেখেছে। তারা আরো বলেন, চৈত্র-বৈশাখ এ দুমাস পাখা তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় কাটায়। একজনে প্রতিদিন ৫ থেকে ৬টি পর্যন্ত পাখা তৈরি করতে পারে। একটি বাঁশের সামান্য অংশ, বেত দিয়ে পাখা তৈরি করা হয়। আর বাঁশ ও বেতের দাম বেশি হওয়ায় পাখার দামও কিছুটা বাড়িয়ে দিতে হয়েছে। বিশেষ করে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী লালদীঘির মেলায় হাত পাখা বিক্রির জন্য তারা ব্যাপক পরিশ্রম করে বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে পাখা তৈরি করেছেন অতিরিক্ত লাভের আশায়। হাতপাখা তৈরির প্রধান উপকরণ হচ্ছে, তালপাতা, ডলু বাঁশ, নিতা বাঁশ, বেত ও রং। কোন আধুনিক মেশিন ছাড়াই শুধুমাত্র দা, ছুরির সাহায্যে তৈরি হচ্ছে এ দৃষ্টিনন্দন হাতপাখা। প্রতিটি পাখা প্রকারভেদে ১শ’ থেকে ৩শ’ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হচ্ছে বলে জানান বিক্রেতারা। ডিজাইন সমৃদ্ধ গুণগতমান ও টেকসই পাখাগুলোর দাম একটু বেশি। পাখা শিল্পীদের মতে ৭, ৯, ১১, ১৩, ১৫ তারি হিসেবে হাতপাখার প্রকারভেদে বিবেচনা করা হয়। যতটি বেতের বর্ডার পাখাতে সংযুক্ত হয়, সেটি তত তারি পাখা হিসেবে চিহ্নিত হয়। লালদীঘির মেলা, বিভিন্ন বৈশাখী মেলা, বলীখেলা, গরুর লড়াই, হাট-বাজার ইত্যাদিতে বিপুল পরিমাণ হাতপাখা বিক্রি হয় চৈত্র-বৈশাখ মাসে। বছরব্যাপী এ হাতপাখার চাহিদা রয়েছে। কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, ফেনী, কুমিল্লা, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা এসে হাতপাখা কিনে নিয়ে যায় চন্দনাইশের জিহস ফকির পাড়া থেকে।
পাখা শিল্পীদের কয়েকজন জানান, বাংলাদেশ কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে জিহস ফকির পাড়ায় তৈরি হাতপাখা নিয়মিত চীন, কোরিয়া ও জাপানসহ বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়েছে বাজার সৃষ্টি করার লক্ষ্যে। তবে অনেক আগে থেকে মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, ওমান ও দুবাইতে প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণ হাতপাখা রপ্তানি হয়। সরকারিভাবে এ পাখা শিল্পীদের কোনরকম প্রশিক্ষণ বা ঋণ সুবিধা নেই বলে অভিযোগ জানান তারা। সরকারিভাবে এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কোন পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়নি এ পর্যন্ত। এলাকার সচেতন মহল এ শিল্পকে আরো সমৃদ্ধশালী করতে সরকারিভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করার দাবি জানিয়েছেন। জিহস ফকির পাড়ার ৭০ বছরের মমতাজ মিয়া ও ৬৫ বছরের আলী হোসেন জানান তারা পূর্ব পুরুষের স্মৃতি ধরে রাখতে এখনোও হাত পাখা তৈরি করে যাচ্ছেন। লাভ কমে যাওয়ায় দিন দিন এ ব্যবসা থেকে সরে পড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে অনেকে। সরকারিভাবে এ শিল্পকে ধরে রাখতে সহজ শর্তে ঋণ, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও পৃষ্টপোষকতা পেলে এ শিল্পের কদর দেশ ছেড়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়বে। যুগের পরিবর্তনের কারণে এখন হাতপাখার শোভা পাচ্ছে ধর্নাঢ্য ব্যক্তিদের ডয়িং রুমে ও দর্শনীয় স্থানে। হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালি জাতির ঐতিহ্য। এ শিল্পকে ধরে রাখতে শিল্প মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টদের সু-দৃষ্টি কামনা করেছেন হাতপাখা শিল্পীরা।