মো. নুরুল করিম আরমান, লামা
সূর্যমুখি ফুল শুধু দেখতে রূপময় নয়, গুণেও অনন্য। এটি তৈলবীজ জাতীয় অর্থকরী ফসল। বান্দরবানের লামা উপজেলার গজালিয়া ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ি গতিরাম ত্রিপুরা পাড়া গ্রামের প্রিতমা ত্রিপুরা চাষ করেছেন ‘সূর্যমুখি’। সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে তার সূর্যমুখি ক্ষেত। উপজেলা সদর থেকে ৮ কিলোমিটার উত্তরে এ ক্ষেতের অবস্থান। প্রতিদিন এ সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে অনেক দর্শনার্থী ভিড় করছেন ক্ষেতে। সকালে পূর্বদিকে তাকিয়ে থাকলেও বেলা বাড়ার সাথে সাথে সূর্যের দিকে ঘুরতে থাকে এ ফুল। দেশে তেলের ঘাটতি মেটাতে ব্যাপকভাবে সূর্যমুখি চাষের উদ্যোগ নেওয়া হয় বলে জানায় কৃষি বিভাগ।
জানা যায়, প্রথমবারের মত এ বছরই উপজেলায় পরীক্ষামূলক সূর্যমুখি চাষ হয়েছে। কৃষি অধিদপ্তরের প্রণোদনায় ৭টি ইউনিয়নের ৪০ জন কৃষক ৩৩ শতক করে মোট ১৩ একর ২০ শতক জমিতে এ চাষ করেছেন। ফলন ভালো হওয়ায় এটি নিয়ে কৃষকের মাঝে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে।
গতকাল বুধবার গতিরাম পাড়াস্থ ক্ষেতে সরেজমিনে দেখা যায়, ৬ থেকে ৭ ফুট লম্বা সূর্যমুখি গাছে ফুল ফুটে আছে। ফুলের সৌন্দর্য্য ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। ফুল দেখতে প্রতিদিনই আসছে বিভিন্ন বয়সী মানুষ। এ সময় গজালিয়া ইউনিয়নের কৃষক মো. মিজান, করই মুরুং, অংছাচিং মার্মা ও তুমরিং মুরুং বলেন, ‘এ বছর কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে সূর্যমুখি ফুলের চাষ করেছি। এ চাষে খুব বেশি পরিশ্রম হয় না। শুধু বীজ বপনে একটু শ্রম দিতে হয়। এরপর দেখভাল করলেই চলে।’
চাষী প্রিতমা ত্রিপুরা জানায়, এ বছর তিনি লামা কৃষি অধিদপ্তর থেকে প্রণোদনা নিয়ে ৩৩ শতক জমিতে সূর্যমুখি ফুলের চাষ করেন। কৃষি অফিস থেকে প্রয়োজনীয় বীজ ও সার দেয়া হয়েছে। কৃষি কর্মকর্তারা নিয়মিত পরিদর্শন ও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। বীজ ও সার ছাড়া ৩৩ শতক জমিতে সূর্যমুখি চাষ করতে তার ৪ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।
দর্শনার্থী জিয়াউর রহমান, মো. ইলিয়াছ, বোরহান, সেলিমসহ অনেকে বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেখে তারা অনেকদূর থেকে সূর্যমুখি ক্ষেতে এসেছেন। তার এ দৃশ্য দেখে তারা মুগ্ধ। সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে যাওয়ার সময় সূর্যমুখি ফুলের সেদিকে তাকিয়ে থাকার দৃশ্য অত্যন্ত মনোরম। মৌমাছিরা শেষ বিকেলে মধু সংগ্রহ করতে ব্যস্ত সূর্যমুখি ফুল থেকে। দেখা যায়, প্রজাপতির মেলা। এ অপরূপ সৌন্দর্য্য যে কাউকেই মুগ্ধ করবে।
গজালিয়া ইউনিয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা প্রকাশ বড়–য়ার হিসেব মতে, ১ হেক্টর জমিতে ২ টন বীজ উৎপন্ন হয় এবং প্রতি কেজি বীজ থেকে ৩০০ গ্রাম সূর্যমুখি তেল পওয়া যায়। এবছর প্রায় ১৩ একর জমিতে ১০ হাজার ৬৮৮ কেজি সূর্যমুখি বীজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতি কেজি সূর্যমুখি বীজ থেকে ৩০০ গ্রাম করে ৩ হাজার ২০৬ কেজি তেল উৎপাদন হতে পারে। এতে করে প্রতিজন কৃষক ৩২ হাজার টাকার তেল বিক্রি করতে পারবেন।
জানা গেছে, লামা-নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলাসহ পার্বত্য জেলার বিভিন্ন স্থানে সূর্যমুখি চাষাবাদ দিন দিন বাড়ছে। বাজারে পুষ্টিগুণসম্পন্ন সূর্যমুখি ফুলের তেল পাওয়া যায়। যদিও সূর্যমুখি ফুলের তেল বনস্পতি তেল নামে পরিচিত। ফুল থেকে তেল উৎপাদনের পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবে মধুও উৎপাদিত হচ্ছে।
এ বিষয়ে লামা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রতন কুমার বর্মন বলেন, ‘প্রথমবারের মত এ বছর লামায় কৃষি অধিদপ্তরের প্রণোদনায় সূর্যমুখি ফুলের চাষ করা হয়েছে। প্রত্যেক চাষীকে বীজ ও সার দেয়া হয়। গত ডিসেম্বরের শুরুতে ক্ষেতে সূর্যমুখি বীজ বপন করা হয়েছিল। ফসল ঘরে তোলা যাবে এপ্রিলে। চাষ করতে বিশেষ সমস্যা বা তেমন খরচ নেই। একজন চাষী বিঘাপ্রতি ৪ থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকা খরচ করে তৈলবীজ সূর্যমুখি চাষ করতে পারেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘সূর্যমুখির তেল ক্ষতিকর কোলেস্টেরলমুক্ত ও শতকরা ১০০ ভাগ উপকারী ফ্যাটযুক্ত। এ তেলে আছে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও পানি। হৃদরোগী, ডায়াবেটস রোগী, উচ্চ রক্তচাপের রোগী, কিডনি রোগীর জন্যও সূর্যমুখি তেল নিরাপদ। তাই দেশে তেলের ঘাটতি মেটাতে ব্যাপকভাবে সূর্যমুখি চাষের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে বারি-৩ জাতের নতুন সূর্যমুখি ফুলের চাষ করে স্থানীয় ভোজ্যতেলের ঘাটতি মেটনোর পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা যাবে।’