লাজলজ্জা ছেড়ে ‘মধ্যবিত্তের’ ক্লান্তিহীন অপেক্ষা

31

মনিরুল ইসলাম মুন্না

সকাল ১০টা। নগরীর বহদ্দারহাটস্থ বহদ্দারবাড়ি পুকুরের সামনে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে তিন শতাধিক নারী-পুরুষ জড়ো হয়েছেন। সবাই খাদ্য অধিদপ্তরের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ওপেন মার্কেট সেলের (ওএমএস) ট্রাকের পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন। উদ্দেশ্য ওএমএসের চাল কিনা।
ট্রাকের সামনে মহিলাদের লাইনটিই বেশ দীর্ঘ। লাইনে প্রায় ১৮০ জন মহিলা পণ্য কেনার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। পাশেই আরেকটি লাইনে ছিলেন দেড়শো জনের মত পুরুষ। তারা জানান, কেউ কেউ সকাল সাতটা-আটটা থেকে ওএমএসের পণ্যের জন্য অপেক্ষা করছেন। তবে ট্রাক আসে সকাল সাড়ে নয়টার দিকে।
ট্রাক থেকে চাল ও আটা কেনেন খরমপাড়া এলাকার বাসিন্দা গৃহিণী রওশন আক্তার। পূর্বদেশকে তিনি বলেন, সকাল সাতটা থেকে বহদ্দারহাট পুকুরপাড় এলাকায় অপেক্ষা করছিলাম। প্রায় তিন ঘণ্টার মত অপেক্ষার পর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে চাল কিনতে পারি। তবে একই এলাকায় দুইটা করে ট্রাক দিলে আমাদের ভোগান্তি একটু কম হতো। রওশন আক্তার বলেন, ৫ কেজি চাল ১৫০ টাকা দিয়ে নিয়েছি। বাজার থেকে ৫ কেজি চাল কিনতে কমপক্ষে ৩০০ টাকা লাগে (চালের কেজি ৬০ টাকা করে ধরলে)। কিন্তু এখান থেকে কেনার ফলে ১৫০ টাকা সাশ্রয় হয়েছে। নগরীর বিভিন্ন বাজারে বর্তমানে প্রতি কেজি মোটা চাল মানভেদে ৫৫ থেকে ৬৫ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা গেল, ট্রাকের সামনে এসে কোনো লাইন কিংবা শৃঙ্খলা মানতে রাজি নন কেউ। সবার উদ্দেশ্য আগে পণ্য কেনা। দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে অনেকে ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন। নারীদের লাইনে বিশৃঙ্খলা ছিল বেশি।
ক্রেতা মনছুর আলী বলেন, আমি রিকশা চালাই। বহদ্দারহাট এলাকায় একটি ভাড়া নিয়ে এসে দেখি কমমূল্যে চাল বিক্রি করা হচ্ছে। তাই লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ি। সকাল ১০টার দিকে লাইনে দাঁড়ালাম এখন পৌনে একটা বাজে তারপরও নিতে পারলাম না। তবে আশাকরি কিছুক্ষণের মধ্যে নিতে পারব। গরমে একটু কষ্ট হলেও তো কিছুটা সাশ্রয় পাচ্ছি।
লাইনের মধ্যে শুধু গরীব মানুষ বা নি¤œ আয়ের মানুষ নয়, অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের মহিলা-পুরুষও মুখে মাস্ক পরে চাল কেনার অপেক্ষায় ছিলেন। তবে আত্মসম্মানের ভয়ে কেউ নাম বলতে রাজি হননি।
তারা বলছেন, আমরা নিরূপায় হয়ে এখানে দাঁড়িয়েছি। ঘরে বসে থাকলে তো কেউ এক মুঠো চাল দিবে না। বাজারের যে অবস্থা, তা বলে বুঝানো যাবে না। গত দুই মাস আগে দর যা ছিল তার থেকে বর্তমানে ২ থেকে ৪ হাজার টাকা বেশি দিয়ে বাজার করতে হচ্ছে। এ হচ্ছে আমাদের অবস্থা।
খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম মহানগরে ১৪টি কেন্দ্রে ট্রাক সেলের মাধ্যমে চাল বিক্রি করা হচ্ছে। প্রতিটি ট্রাকে ২ মেট্রিক টন বা দুই হাজার কেজি চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া নগরীর আরও ১৯টি দোকানে চাল বিক্রি করা হচ্ছে। এসব দোকানে বরাদ্দ রয়েছে দেড় মেট্রিক টন চাল এবং একটন আটা। এতে প্রতিকেজি চালের মূল্য ৩০ টাকা এবং আটার মূল্য ১৮ টাকা।
খাদ্য পরিদর্শক আবুল মনছুর মো. হাবিব পূর্বদেশকে বলেন, আমরা প্রতিদিন ট্রাক ও দোকানে বিক্রি কার্যক্রম পরিদর্শন করি। কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে দিই না। কোথাও বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে স্থানীয় পুলিশকে জানালে তারা ঘটনাস্থলে এসে দ্রæত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। এছাড়াও ডিলারের পক্ষ থেকে কর্মচারী থাকে, যারা সিরিয়াল মেনটেনের দায়িত্ব পালন করে থাকে।
চট্টগ্রাম জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. আব্দুল কাদের পূর্বদেশকে বলেন, সাধারণ মানুষ সাশ্রয়ী মূল্যে চাল কিনতে পেরে স্বস্তি পাচ্ছেন। ক্রেতাদের একটু কষ্ট হলেও সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে পেরে খুশি সকলে। কারণ ওএমএস এর চাল বিক্রি না হলে অসাধু ব্যবসায়ীরা চালের দাম দেড় থেকে দ্বিগুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতেন। এখন আমাদের বিক্রি কার্যক্রম চলাতে দাম একটু স্বাভাবিক রয়েছে।
বিক্রির পয়েন্ট আরও বাড়ানো যায় কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নগরীতে ট্রাক সেল পয়েন্ট আরও বাড়ানো উচিত। তবে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার বাইরে তো আর কিছু করা যায় না। আমরা প্রধান কার্যালয়ে জানিয়েছি, ওখান থেকে নির্দেশনা আসলে পরবর্তী পদক্ষেপে যেতে পারবো।