লাগাম টানতে বিলম্ব হলে চরম মাশুল দিতে হবে

50

মনসুর নাদিম

কথায় বলে-সন্ত্রাসীর কোন দল নেই, ধর্ম নেই। আরেক জায়গায় বলে-অপরাধীকে নয়, অপরাধ কে ঘৃণা করুন। এই কথা দুটির সাথে আমি মোটেও একমত নই। আমি মনে করি এই রাজনৈতিক কথাগুলোতে শুভংকরের ফাঁকি থেকে যাচ্ছে। সন্ত্রাসীর কোন দল নেই, ধর্ম নেই মানে কী ? সন্ত্রাসী কী মঙ্গলগ্রহ থেকে এসেছে ? ধরা পড়লেই ‘কেষ্ট বেটা চোর’র মতো ঘটনা। দল পিচলে বেরিয়ে যাওয়ার মতো কাÐ। দলে থেকে যখন সন্ত্রাস করেছিল, তখন দল দেখে নাই ? আরেকটাতে যখন বলা হয়, অপরাধীকে নয়, অপরাধ কে ঘৃণা করুন। অপরাধ কে ঘৃণা করবো আমি একা! আর অপরাধীকে ঘৃণা করবে গোটা জগৎ। অপরাধীকে ঘৃণা না করলে থুথু না ছিটালে আরও বেশি বেশি সম্রাট, জি কে শামীম, পাপিয়া ও সাহেদ, সাবরিনার জন্ম হবে। সুতরাং বলতে হবে অপরাধ আর অপরাধী দুটোকেই ঘৃণা করুন। রাজনীতিবিদেরা সেই আবহমান কাল থেকেই নিজেদের সুবিধার্থে কিছু প্রবাদ প্রবচন সমাজে ছুঁড়ে দেন যাতে ‘ ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র মত ব্যাপার থাকে। যেমন প্রতিশ্রæতি বাস্তবায়ন করতে না পারলে বলা হয়-‘ রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই’। এই লেখা যখন লিখছি তখন খবর পেলাম রিজেন্ট এর প্রধান আসামী সাহেদ করিম ওরফে সাহেদকে সাতক্ষিরার দেবহাটা সীমান্ত এলাকা থেকে বোরকা পরা অবস্থায় র‌্যাব গ্রেপ্তার করেছে। প্রতারণা আর চাপাবাজি দিয়েই উত্থান হয়েছিল তার। একসময় মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসা করে গ্রাহকের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন। প্রতারণা মামলায় জেলও খেটেছিলেন। অন্তত দুই ডজন মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। কিন্তু তার টিকিটির নাগালও পায়নি কেউ। কারণ তিনি নিজেকে কখনও সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা, কখনও গোয়েন্দা সংস্থার ঘনিষ্ঠ, আবার কখনও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সংশ্লিষ্ট বলে পরিচয় দিয়ে বেড়াতেন। নিজেকে মিডিয়া ব্যক্তিত্ব জাহির করে অর্থের বিনিময়ে টক শো’তে অংশ নেওয়াও শুরু করেছিলেন তিনি। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি রিজেন্ট হাসপাতালের কর্ণধার মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিমের। করোনাভাইরাসের পরীক্ষা নিয়ে জালিয়াতি করতে গিয়ে ধরা খেয়েছেন তিনি। এবার আসুন স¤প্রতি আদম পাচারে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া এমপি পাপুলের প্রসঙ্গে। কুয়েতে মানব পাচারে অভিযুক্ত ল²ীপুর-২ আসনের (রায়পুর-ল²ীপুর সদরের আংশিক) সাংসদ কাজী শহিদ ইসলাম ওরফে পাপুলকে ২০১৬ সালের ঈদুল আজহার আগে গ্রামের মানুষ চিনতেন না। গ্রামের বাড়ির সামনে মায়ের নামে একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান করতে গিয়ে এলাকাবাসীর নজরে আসেন তিনি। দুই হাতে দেদার বিলিয়েছেন টাকা। এরপর স্থানীয় আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সাংসদ নির্বাচিত হন। শহিদ একা নন, স্বামী-স্ত্রী দুজনই সাংসদ হয়েছেন। তিনি নির্বাচিত আর তাঁর স্ত্রী সেলিনা ইসলাম সংরক্ষিত আসনের সাংসদ। দুজনই সাংসদ হওয়ার পেছনে আওয়ামী লীগের অনেক প্রভাবশালী নেতার ভূমিকা রয়েছে বলে স্থানীয় লোকজন মনে করছেন। শহিদ ইসলাম কুয়েতে গ্রেপ্তার হন মানব ও মুদ্রা পাচারের অভিযোগে। তার আগে ল²ীপুরের মানুষ তাঁকে দানবীর হিসেবেই জানতেন। এলাকার লোকজন জানান, ১৯৮৯ সালে একটি প্রতিষ্ঠানের সুপারভাইজার (শ্রমিকদের তত্ত¡াবধায়ক) হিসেবে চাকরি নিয়ে কুয়েত যান তিনি। তখন তিনি ছিলেন অনেকটা নিঃস্ব। ১৯৯০ সালে ইরাকের কুয়েত দখলের কারণে তিনি দেশে ফিরে আসেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কাজী শহিদ আবার কুয়েতে যান। এ ক্ষেত্রে তাঁকে সহযোগিতা করেন বড় ভাই কাজী মঞ্জুরুল আলম। মঞ্জুরুল কুয়েত বিএনপির সাধারণ সম্পাদক। ( সূত্রঃ প্রথম আলো, বাংলা ট্রিবিউন)। ঘটনার বিশ্লেষণে দেখা যায় পাপুল আওয়ামীলীগের কতিপয় প্রভাবশালীদের মদদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচিত এমপি হন। তার স্ত্রী সংরক্ষিত আসনে মনোনীত সাংসদ হন। তারা কেউই আওয়ামীলীগের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। অথচ এর জন্যও আওয়ামীলীগ সরকারের ভাবমূর্তি সংকটে। এভাবে সাহেদ, পাপুল সহ আরও যারা রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে তারা কেউই আওয়ামীলীগের না। বরং নিজেদের স্বার্থে আওয়ামীলীগের দুর্বল চিত্তের কারো না কারো মদদে বৈতরণী পার হতে চেয়েছিল। এটা এই দুরভিসন্ধি কারীদের জন্য সহজ ছিল। আর আওয়ামী বিদ্বেষীরা এই ঘটনা গুলি নিয়ে সেই পুরানা ভাঙ্গা রেকর্ড বাজাতে থাকে। অথচ আওয়ামীলীগের গৌরবময় ইতিহাসের জন্য আওয়ামীলীগকে জনগণ সবসময় সমর্থন দিয়ে আসছে। সংগত কারণে আওয়ামীলীগ যখন ক্ষমতাই থাকে তখন আওয়ামীলীগের প্রতি মানুষের প্রত্যাশার পারদটাও উপরের দিকে থাকে। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হল প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে অনিয়ম ঘটলেই মানুষ ক্ষেপে যায়। আওয়ামীলীগের বেলায় ঘটেছে সেই একই ঘটনা। এখনো ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকারের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা অপরিসীম। ইতিহাস বলে আওয়ামীলীগ একটি ফলবান বৃক্ষ। আর ফলবান বৃক্ষে ঢিল পড়ে বেশি। যে বৃক্ষে ফল থাকে না সেখানে কেউ ঢিল ছোড়া দূরের কথা ফিরেও তাকাই না। এটা ইতিহাস স্বীকৃত যে, এইদেশ স্বাধীন হওয়ার পেছনে আওয়ামীলীগের অবদান কিংবা কৃতিত্ব সবচেয়ে বেশি। বঙ্গবন্ধুর আমল থেকেই দেখা গেছে, আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এলে চাটার দল আর খয়েরখাঁদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। দুঃসময়ে এদেরকে বাতি জ্বালিয়ে খুঁজে পাওয়া যায় না। একবার ৭৫’এ আরেকবার এক এগারোর সময় আওয়ামীলীগের প্রকৃত বন্ধুদেরকে চেনা গেছে। আজ আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আছে। তাই আওয়ামীলীগে অতিথি পাখির ভিড়। ক্ষমতার বসন্ত বিদায়ের সাথে সাথে অতিথি পাখিরা ফিরে যাবে নিজ নিজ নীড়ে। এই কথাটা আওয়ামীলীগের নীতি নির্ধারকদের বিচক্ষণতার সাথে পর্যবেক্ষণপূর্বক যথাযথ পদক্ষেপ দলের কল্যাণে সময়ের দাবি। অসংখ্য আওয়ামীলীগের শুভার্থী আছেন যাদেরকে আওয়ামীলীগের নেতারা চেনেন না। নিঃস্বার্থভাবে তাঁরা আজীবন আওয়ামীলীগের পক্ষে কথা বলেছেন, কলম ধরেছেন, কাজ করেছেন। শুধুমাত্র কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে। তাঁরা মনে করেন, এই দেশের স্বাধীনতার জন্য আওয়ামীলীগের ভূমিকা অতুলনীয়। তাই তাঁরা আওয়ামীলীগে ভুল নেতৃত্ব দেখলে ভুল সিদ্ধান্ত দেখলে কিংবা ভুল লোক দেখলে দুঃখ পান। ব্যথিত হন।
পাপিয়ারা কীভাবে কোন যোগ্যতায় মহিলা যুবলীগের নেতৃত্বে আসতে পারে । আওয়ামীলীগের মতো একটা দলে মহিলা যুবলীগের মতো অঙ্গ সংগঠনের কোন প্রয়োজন আছে কিনা ? পাপিয়ার পরিচয় আর কর্মকাÐ দেখলেই বোঝা যাবে পাপিয়ারা দলে পাপ ছড়াতে নিজ প্রয়োজনে এসেছে দলের প্রয়োজনে নয়। এখন পাপিয়ার বিচার হবে আর পাপিয়াকে যারা সুযোগ করে এত উপরে উঠিয়েছে তারা ধরছোঁয়ার বাইরে থাকবে তাতো হয় না। তাদেরকেও শাস্তি পেতে হবে। অন্যথায় তারা নতুন পাপিয়া তৈরি করবে। যুব মহিলা লীগের বিতর্কিত নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদের মুখে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছেন। তার নরসিংদী ও ঢাকার বাসায় অভিযান চালিয়ে র‌্যাব উদ্ধার করেছে বিপুল পরিমাণ অর্থ, বিদেশি মদ ও পিস্তল। দুর্ধর্ষ এই লেডি ডন ও তার স্বামী মফিজুর রহমান চৌধুরী সুমন ওরফে মতি সুমন দুজনই ঢাকা ও নরসিংদীতে অবৈধ কাজ-কারবারের বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন। আর তাদের এই অবৈধ কাজ-কারবারের পরিধি থাইল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত। পাপিয়া অনেক মানুষকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে আলাদাভাবে অর্থ সংগ্রহ করতেন। পাপিয়ার গায়ে পার্টির নেম প্লেট থাকাই পাপিয়ার পাপের বোঝার কলংক তিলক দলের কপালেও লেগেছে।
জি কে শামীম নারায়নগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলার একজন স্কুল মাস্টারের ছেলে হয়ে ওঠেন আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন। অস্ত্রধারী দেহরক্ষী নিয়ে চলাফেরা ও রাজনীতির অন্তরালে হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যান তিনি। ছোটখাটো মানুষ হলেও শামীমের ক্ষমতার দাপট ছিল আকাশ সমান। রাজধানীর সবুজবাগ, বাসাবো, মতিঝিলসহ বিভিন্ন এলাকায় জি কে শামীম প্রভাবশালী ঠিকাদার হিসেবে পরিচিত। গণপূর্ত ভবনের বেশির ভাগ ঠিকাদারি কাজই জি কে শামীম নিয়ন্ত্রণ করেন। বিএনপি-জামায়াত শাসনামলেও গণপূর্তে শামীম ছিলেন ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি। এতদ সত্তে¡ও সরকারের দিকেই মানুষ অঙ্গুলি ওঠাবে। যেহেতু রাষ্ট্র ক্ষমতায় এখন আওয়ামীলীগ সরকার। এভাবে সম্রাটসহ আরও যারা দলের নাম ভাঙিয়ে নিজেরা বিত্তশালী হয়ে দেশকে নিঃস্ব করতে পাঁয়তারা করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক যাতে আগামীতে কেউ অনুরূপ করার কোন দুঃসাহস না দেখায়। আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি, সতত এই মূলমন্ত্র যেন জীবনে মরণে প্রতিটি নাগরিকের সার্বক্ষণিক জপ মালা হয়।

লেখক : প্রবাসী সাংবাদিক ও কলাম লেখক