লবণের দামে আবারও ধস

18

রাহুল দাশ নয়ন

চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের উপকূলে লবণ উৎপাদনে এখন ভরা মৌসুম। মাঠে ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষীরা। কিন্তু লবণের দামে হঠাৎ ধস নামায় হতাশ চাষীরা। মৌসুমের শুরুতে ৩৬০ থেকে ৩৮০ টাকা মণপ্রতি বিক্রি করা লবণের দাম এখন নিম্নমুখী। গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মাঠেই ২৬০ থেকে ২৮০ টাকায় লবণ বিক্রি হচ্ছে। ১৫ দিন আগে ভালো দাম পেলেও হঠাৎ লবণের দামে এমন ধস নেমেছে বলে জানিয়েছেন চাষীরা।
বিসিক ও মিল মালিকরা বলছেন, ভরা মৌসুম হওয়াতে লবণ উৎপাদন বেড়েছে। বাজারে লবণ বাড়ার কারণে দাম কমেছে। চলতি মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে চাষী ও মিল মালিকরা মজুদ শুরু করবে। তখন লবণের চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে দামও বাড়বে।
বিসিক কক্সবাজার লবণশিল্প উন্নয়ন কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক জাফর ইকবাল ভূঁইয়া পূর্বদেশকে বলেন, মৌসুমের শুরুতে লবণের ভালো দাম পেয়েছিল চাষীরা। তবে এখন চলছে ভরা মৌসুম। উৎপাদন বেশ বেড়েছে। লবণের উৎপাদন যেহেতু বেড়েছে দামতো একটু কমবে। এরচেয়ে যাতে আর দাম না কমে সেদিকে লক্ষ্য রাখছি আমরা। কোনপক্ষ কারসাজি করছে কিনা তদারকিতে নিয়মিত বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজার চাষী লবণ মাঠে সময় দিচ্ছে বলে জানান তিনি।
বিসিক কক্সবাজার লবণশিল্প উন্নয়ন কার্যালয় সূত্র জানায়, কক্সবাজারের কুতুবদিয়া, টেকনাফ, মহেশখালী, পেকুয়া ও চকরিয়া, চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে সবচেয়ে বেশি লবণ চাষ হয়। প্রতি বছর অগ্রহায়ণ থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত ছয়মাস লবণ উৎপাদনের ভরা মৌসুম। অগ্রহায়ণ মাসে মাঠ তৈরিতে নেমে পড়েন চাষীরা। পৌষ মাসে লবণ উৎপাদন শুরু হয়। পরবর্তীতে বৈশাখ মাসে বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত লবণ উৎপাদন হয়। পলিথিন পদ্ধতিতে উৎপাদিত লবণ প্রতি ৫-৭দিন পরপর মাঠ থেকে তোলা হয়। যা পরবর্তীতে নৌ ও সড়কপথে লবণ মিলে পাঠানো হয়। চলতি ২০২১-২২ অর্থ বছরে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের ৫৮ হাজার একর জমিতে লবণ চাষ হয়েছে। প্রায় ৩০ হাজার লবণচাষী মাঠে ব্যস্ত। এবার ২৩ লক্ষ ৫৬ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি নুরুল কবির পূর্বদেশকে বলেন, প্রতিবস্তা (দুইমণ) লবণের দাম মিলেই কিনে নিচ্ছি ৬৭০ থেকে ৭৫০ টাকায়। মৌসুমের শুরুতে আমরা প্রতিবস্তা এগার’শ টাকাও কিনেছি। বেশি উৎপাদন হওয়ায় দাম কমেছে। মার্চের ২০ তারিখ থেকে মজুদ বাড়লে আবারও দাম বাড়বে। বর্তমানে লবণের দাম সঠিক আছে। এমন দাম থাকলে চাষী, মিল মালিক সবার জন্য ভালো। এর বেশি দাম হলে বাজার অস্থিতিশীল হবে। অবৈধ লবণ ঢুকে যাবে। তখন চাষীরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে চাষীদের কাছ থেকে লবণ কিনে মিল পর্যন্ত পৌঁছে দিতে মধ্যস্বত্ত¡ভোগীরা কিছুটা সুফল নিচ্ছে বলে তিনি জানান।
বাঁশখালীর ছনুয়া লবণ মাঠে গিয়ে দেখা যায়, চাষীরা লবণ মাঠ তৈরি, মাঠে পলিথিন বিছানো ও উৎপাদিত লবণ সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছেন। মাঠে স্তুপ করে থরে-থরে সাজানো লবণ। চাষীদের সংগৃহীত লবণ মাঠ থেকেই কিনে নিচ্ছেন মধ্যস্বত্ত¡ভোগীরা। প্রতি চার থেকে পাঁচদিন পরপর মাঠ থেকে লবণ তোলা হচ্ছে। লবণের বাম্পার ফলন হয়েছে এবার। তবে মৌসুমের শুরুতে লবণের দাম ভালো থাকায় মাঠ মালিকরা জমির লাগিয়ত বাড়িয়েছে দ্বিগুণ। খরচ বেড়ে গেলেও হঠাৎ করে দাম পড়ে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই হতাশ চাষীরা।
ছনুয়ার খুদুকখালীর লবণ চাষী মোজাম্মেল ছেলে রিফাত ও মেয়ে সাদিয়াকে নিয়ে মাঠের লবণ উৎপাদনে কাজ করছেন। জানতে চাইলে মোজাম্মেল বলেন, কানি প্রতি লবণ মাঠের লাগিয়ত নিয়েছিলাম ১৮ হাজার টাকা। এবছর লাগিয়তের দরদাম না হলেও অবস্থা বুঝে মনে হচ্ছে কানিপ্রতি লাগিয়তের টাকা দিতে হবে ৩০ হাজার টাকা। দাম ভালো থাকলে এ টাকা দিতেও রাজি ছিলাম। কিন্তু ১৫ দিনের ব্যবধানে হঠাৎ ১০০ টাকা লবণের দাম কমে গেছে।
তোতকখালীর চাষী আব্দুর রহিম বলেন, লবণের দাম একদম পড়ে গেছে। মৌসুমের শুরুতে ভালো দাম পেয়ে আমরা খুশি হয়েছিলাম। মণপ্রতি ৩৮০ টাকার লবণ এখন বিক্রি করতে হচ্ছে ২৮০ টাকায়। মিলে দাম কমেছে বলে ব্রোকাররা (মধ্যস্বত্ত¡ভোগী) দাম কমিয়ে দিয়েছে। দাম না বাড়লে আবারো গত কয়েক বছরের মতো হতাশ হবে চাষীরা। লোকসান হলে আগামী বছর দেখা যাবে লবণ চাষী কমে গেছে।
লবণ শিল্প দেশের সর্ববৃহৎ শ্রম নিবিড় কুটির শিল্প। লবণ উৎপাদন থেকে মিল পর্যায়ে প্যাকেটজাত হওয়া পর্যন্ত এ শিল্পের সঙ্গে প্রায় পাঁচ লক্ষ লোক জড়িত। জাতীয় অর্থনীতিতে লবণ শিল্প প্রতি বছর ১২০০ থেকে ১৫০০ কোটি টাকার অবদান রাখে। যা প্রক্রিয়াজাত শেষে ৩০০০ থেকে ৩৫০০ কোটি টাকাতে দাঁড়ায়।