লক্ষ্যে অটুট ছিলেন প্রধানমন্ত্রী

27

ঢাকা প্রতিনিধি

অবশেষে বহুল প্রত্যাশিত ও দেশের সর্ববৃহৎ স্বপ্নের ‘পদ্মা সেতু’ আজ উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমেই সব ষড়যন্ত্র, অভিযোগ, বাঁধা, বিপত্তি, আলোচনা ও সমালোচনার অবসান ঘটিয়ে প্রমত্তা পদ্মার উপর নির্মিত সেতুটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী এ দিনটিকে বাংলাদেশের জন্য এক গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহাসিক দিন হিসাবে অভিহিত করেছেন। এক বাণীতে তিনি বলেন, দেশপ্রেমিক জনগণের আস্থা ও সমর্থনের ফলেই আজকে উন্নয়নের এ নতুন অধ্যায় উন্মোচিত হয়েছে। আগামী দিনেও গণমানুষের আশা-আকাক্সক্ষা ও স্বপ্ন পূরণে আমরা আন্তরিকভাবে কাজ করে যাব। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ক্ষুধা দারিদ্র্যমুক্ত ও উন্নত-সমৃদ্ধ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজীবন লালিত স্বপ্নের ‘সোনার বাংলাদেশ’ গড়ে তুলতে সক্ষম হব, ইনশাআল্লাহ।’ এছাড়া ‘পদ্মা সেতু’ উদ্বোধন উপলক্ষে তিনি দেশবাসীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর দেশের অন্য সবকিছুর সাথে বাণিজ্য স¤প্রসারণেও আসবে মাইলফলক গতি। গ্রামীণ অর্থনীতির উৎপাদনশীলতা হবে রপ্তানিমুখী। দারিদ্র্য নিরসন এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখবে। গতি ও মাত্রা বাড়বে অভ্যন্তরীণ ও আন্তঃদেশীয় যান চলাচলের। সব মিলিয়ে সেতুর উভয়পাশে বিকাশ ঘটবে সুষম অর্থনীতির।
গবেষণা বলছে, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ১.২৩ শতাংশ হারে জিডিপি বৃদ্ধি পাবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২.৩ শতাংশ। মোংলা বন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোকে সারাদেশের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করবে এ সেতু। সব মিলিয়ে পদ্মা সেতু বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সীমা ছাড়ানো অবদান রাখবে।
পদ্মা সেতু যোগাযোগ ব্যবস্থায় সূতিকাগার হিসেবে কাজ করবে। এ সেতুর মাধ্যমে দুই প্রান্তে বিদ্যুৎ, গ্যাস, অপটিক্যাল ফাইবারসহ পরিষেবাসমূহের সংযোগ স্থাপিত হবে। দারিদ্র্য নিরসনের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এ সেতু অনন্য অবদান রাখবে। নিজস্ব অর্থায়নে বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতুর সফল নির্মাণ দেশের উন্নয়ন কর্মসূচি পরিচালনার জন্য বাংলাদেশকে অন্যের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করবে।
উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ পদ্মা সেতু নির্মাণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়। ২০০১ সালের ৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। এর আগে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে ১৯৯৮-৯৯ সালে পদ্মা সেতুর প্রি-ফিজিবিলিটি সম্পন্ন করে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতা গ্রহণের পরই ফেব্রুয়ারি মাসে পদ্মা সেতুর জন্য ডিজাইন কনসালট্যান্ট নিয়োগ করে। কনসালট্যান্ট সেপ্টেম্বর ২০১০-এ প্রাথমিক ডিজাইন সম্পন্ন করে এবং সেতু বিভাগ প্রিকোয়ালিফিকেশন দরপত্র আহবান করে। ২০১১ সালে সরকার বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণ চুক্তিবদ্ধ হয়।
কিন্তু ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংক ‘দুর্নীতি’ হয়েছে বলে অভিযোগ তুলে ঋণ চুক্তি বাতিল করে। বিশ্বব্যাংকের পাশাপাশি জাইকা, এডিবিসহ দাতাসংস্থাগুলোও সরে দাঁড়ায়। সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলায় তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হয়। সংশ্লিষ্ট সচিবসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিএনপিসহ সুশীল সমাজের কতিপয় ব্যক্তি সরকারের সমালোচনায় মেতে ওঠেন। অথচ মন্ত্রীসহ কারোর বিরুদ্ধেই কোনও অভিযোগই প্রমাণিত হয়নি। পরে কানাডার এক আদালতে মামলা করা হয়। বিশ্বব্যাংক সেখানে কোনও প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি। কানাডার আদালত বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে রায় দেন। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির কোনও প্রমাণ মেলেনি। এর মাধ্যমে সত্য উন্মোচিত হয়। সব ষড়যন্ত্র মিথ্যা প্রমাণিত হয়।
আওয়ামী লীগ ও সরকারের পক্ষে বিশ্বব্যাংকের অভেযোগকে ‘ষড়যন্ত্রের খেলা’ বলে উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, আওয়ামী লীগ সরকারের ইমেজকে কলঙ্কিত করতে দুর্নীতির এ মিথ্যা অভিযোগ করা হয়েছে।
এছাড়া অভিযোগ উঠে, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বব্যাংকে ঋণ সহায়তা প্রদানে বাধা দেন। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, পদ্মা সেতুতে টাকা দিতে বিশ্বব্যাংক সব সময় রাজি ছিল। কিন্তু ইউনূসের কারণে সেটি হয়নি। বিশ্বব্যাংক যেন টাকা না দেয়, সে জন্য ড. ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে দিয়ে সংস্থাটিকে চাপ দিয়েছিলেন। বহির্বিশ্বে সরকারের বিরুদ্ধে তিনি অনবরত অভিযোগ করে যাওয়ায় অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। অবাক লাগে, একজন নোবেলজয়ী কী করে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেন?
এভাবে নানা অভিযোগ, ষড়যন্ত্র, বাঁধা ও প্রতিক‚লতার চাপ উপেক্ষা করেই পদ্মা সেতু নির্মাণে অটুট ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দৃঢ় মনোবলে তিনি ঘোষণা দেন, স্বপ্নের পদ্মা সেতু হবে।
জানা যায়, ২০১২-এর ফেব্রুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, প্রয়োজনে নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু হবে। জুলাই মাসেও প্রধানমন্ত্রী সংসদে ঘোষণা দেন, প্রয়োজনে নিজস্ব অর্থায়নেই হবে পদ্মা সেতু। তিনি এও বলেন, কোনও দুর্নীতি করা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দেন, দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগের সামনে মাথা নত করবে না বাংলাদেশ।
২০১৫-এর ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। যখন সরকার নিজম্ব অর্থায়নে কাজ শুরু করে দিল, তখন বিশ্বব্যাংক বলে, এত বড় উন্নয়ন প্রকল্প থেকে অর্থ প্রত্যাহার উচিত কাজ হয়নি। সেতুটি হচ্ছে বাংলাদেশের স্টিল লাইফ লাইন।
পরবর্তীতে বিশ্বব্যাংক পুনরায় পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের কথা জানালে তা প্রত্যাখান করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়চেতা মনোভাব এবং ঐকান্তিক চেষ্টায় শত প্রতিকূলতা থাকার পরও দ্রæতগতিতে এগিয়ে চলে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ। আজ এ সেতুরই উদ্বোধন করবেন তিনি।
অদম্য সাহস ও দৃঢ়তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে সেতু সম্পন্ন করার ঘোষণা দেন। বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে ঘোষণা দেন ‘নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু গড়ার।’ তৃতীয় বিশ্বের মতো দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে বিদেশি কোনো সাহায্য ছাড়া ৩০ হাজার কোটি টাকা খরচ করে সেতু নির্মাণের যে পরিকল্পনা তিনি করেছিলেন, সত্যিই তা ১৮ কোটি বাঙালির কাছে দুঃসাহসিক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু সব জল্পনা-কল্পনা উড়িয়ে সেই স্বপ্ন আজ পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়েছে। পদ্মা সেতু নিছক কোনো সেতু নয়, এটা বাংলাদেশের সক্ষমতার প্রমাণ। জাতি হিসেবে বাঙালির গর্ব ও অহঙ্কারের নিদর্শন এবং সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার দৃঢ়প্রত্যয়ের ফসল।