লকডাউনে উত্তাল বাংলাদেশ !!!

47

রাইসুল উদ্দিন সৈকত

উত্তাল হল বাংলাদেশ। লকডাউনের বিপক্ষে। লকডাউন শব্দটি যেন নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের উপরে অনেকটা আচমকা বজ্রপাত। প্রশাসন লকডাউনের বিধিনিষেধ আরোপ করলো, আর জনসাধারণের একাংশ এতে বিক্ষোভ, ভাংচুর চালালো। বিশেষ করে ছোট ব্যবসায়ীরা এই ঘোষণার পরপরই জানিয়েছিলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে তাদের ব্যবসা চালু রাখার অনুমতি দেওয়া হোক। অবশ্য গত বছর করোনার প্রকোপ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। বড়-মাঝারি ব্যবসায়ীরা সরকারি নানা প্রণোদনা ও ব্যবসায়ীক কাঠামোর কারণে কিছুটা সামলে নিয়েছিল তখন। এবার লকডাউনের এই পরিস্থিতি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না দেশের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। সামনে পহেলা বৈশাখ তারপরে রমজান শেষে ঈদ, দেশের ভোক্তা ভিত্তিক অর্থনীতি এই সময় বা পর্বকে কেন্দ্র করে অনেকটাই পরিচালিত হয়। আর এইসব পর্বে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা কিছুটা লাভের মুখ দেখে সারাবছর ব্যবসার মনোবল পেয়ে থাকেন। গেলবছর তারা সেই সুযোগ একেবারেই পাননি। এবছরও একইসময়ে লকডাউন ঘোষণাতে তারা বেশ ক্ষুব্ধ। পথে নেমে এসেছেন তারা লকডাউনের বিরুদ্ধে। বিষয়টি ভেবে দেখার মতো।
প্রাথমিকভাবে মাত্র ৭ দিনের জন্য এই লকডাউন হলেও তা বাড়তে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। লকডাউন দীর্ঘ হলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাত, দোকানি, হকার, রিকশাচালক ও স্বল্প আয়ের মানুষেরা সমস্যায় পড়বেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। অবশ্য এরই মধ্যে সিটি এলাকায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন চলাচল করতে শুরু করতে নিদের্শনা দেয়া হয়েছে। কিন্তু কথা আর কাজের মিল নাই বলে আমরা খবরে দেখে আসছি।
দেশব্যাপী করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে এক সপ্তাহের জন্য ১৮ দিকনির্দেশনা দিয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেছিল সরকার। এজন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় গণপরিবহন। তবে ৭ এপ্রিল নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে সিটি করপোরেশন এলাকায় সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্তে কিছু মানুষের ভোগান্তি কমলেও তা পর্যাপ্ত নয়।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ শনাক্ত এবং মৃত্যুর হার ঊর্ধ্বমুখী হলেও এ নিয়ে আমাদের তেমন সচেতনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। যে যার মতো চলাফেরা করছে। রাস্তাঘাট এবং পাবলিক প্লেসগুলোতে মাস্কের ব্যবহারও কম। কিছু ক্ষেত্রে মাস্ক পরতে দেখা গেলেও তা ত্রুটিপূর্ণ। স্বাস্থ্যবিধির যেন কোনো বালাই নেই! মুখে মাস্ক বাধ্যতামূলক করা হলেও অনেকেই স্বাস্থ্যঝুঁকির এই প্রধান আদেশও মানছেন না। মাস্ক বিহীন রাস্তায় চলাচল করছে মানুষ।
গতবছরের এইসময়ে মানুষের মধ্যে করোনার ভয় ও সচেতনতার ছোঁয়া দেখা গেছে, তা বর্তমানে প্রায় নেই বললেই চলে। এভাবে চলতে থাকলে ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হতে হবে বলেই শঙ্কা দিনদিন বাড়ছে। এমনটা যদিও কাম্য নয়। করোনা মহামারির শুরুর দিকে আমরা তা প্রতিরোধের পন্থা না জানলেও এখন সবাই তা জানি। এরপরও যদি সবাই সচেতন না হয়, তাহলে সেটা যৌক্তিক নয়। সরকারের পাশাপাশি সর্বস্তরের জনগণ সচেতনতামূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করলে মহামারি মোকাবেলা সম্ভব হবে।
করোনা যতই প্রকট হোক না কেন জীবন-জীবিকা আর ক্ষুধার দায়ে মানুষকে বাইরে যেতেই হবে। বিষয়টা বিবেচনা করা অত্যন্ত জরুরি। এমন অবস্থায় আমাদের করণীয় কি? চিকিৎসকরা বারবার একটা কথাই বলছেন, আমরা প্রত্যেকেই যেন সেই আগের মত মাস্ক ব্যবহার করি এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা করি। এছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে হাট-বাজার, দোকানপাট-গণপরিবহনে মাস্ক পরতেই হবে।
অবশ্য গত দুই দিনে দেখা গেছে, লকডাউনের আগে অধিকাংশ মানুষ মাস্কবিহীন ঘোরাফেরা করলেও গত দুদিনে এ পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। জীবন-জীবিকার তাগিদে যারা ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন, তাদের প্রায় সবাই মুখে মাস্ক পরিধান করেছেন। যদিও ব্যবহারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দামও বেড়েছে। মাস্ক ছাড়াও করোনা সুরক্ষার সব সামগ্রীর দাম বেড়েছে। করোনা মহামারী সাধারণ মানুষের বাস্তব জীবনে এনে দিয়েছে স্থবিরতা। মানুষের জীবনে যে চঞ্চলতা, ক্ষিপ্রতা, উৎসাহ, আনন্দ ছিল তার গতি কমিয়ে দিয়েছে। মানুষে মানুষে যে সহানুভূতিশীল মনোভাব, যে আত্মার সম্পর্ক ছিল সেই সম্পর্কে তুলেছে দেয়াল। মানুষের জীবনে এনেছে বিশাল পরিবর্তন ও নেতিবাচকতা। করোনা ছোবলে একদিকে যেমন মানুষের হাহাকার বাড়ছে তেমনি ভাবে বর্তমান সময়ে দেশের সাধারণ জনগণের কাছে অন্যতম আতঙ্কের নাম দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি। দিনে দিনে এ সমস্যা যেন বেড়েই চলেছে। সামনে পবিত্র রমজান মাস। এ সময়ে হঠাৎ করেই জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধির ফলে শ্রমজীবী মানুষদের সঙ্গে সঙ্গে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে শুরু হয়েছে আর্তনাদ। বিশেষ করে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলা দ্রব্যমূল্যের কারণে ক্ষোভে ফুঁসছে দেশের নিম্ন আয়ের জনগণ।
সবকিছু মিলিয়ে মহামারী করোনা আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার পথকে করেছে আরও জটিল আরও নিম্নমুখী। তবুও আমরা আশাবাদী করোনা যুদ্ধে আমরা জয় লাভ করব এবং ভাইরাসমুক্ত নতুন একটি সমাজ জীবন গঠন করব। করোনামুক্ত সমাজে আবার নতুন করে স্বাভাবিক জীবনযাত্রার সূচনা হবে এটাই আমাদের সবার কামনা।
লেখক : চেয়ারম্যান, এলবিয়ন গ্রুপ