লকডাউনের পর দ্রুত বিচার চায় সিনহার পরিবার

2

সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলায় মহামারি নিয়ন্ত্রণের লকডাউনে সাক্ষ্যগ্রহণ আটকে গেলেও আদালতের কার্যক্রম স্বাভাবিক হলে দ্রুত বিচার কাজ দেখতে চায় পরিবার। এই মামলায় গত ২৬, ২৭ ও ২৮ জুলাই সাক্ষ্য গ্রহণের দিন থাকলেও করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে চলমান লকডাউনে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় সাক্ষ্য গ্রহণ হয়নি।
হত্যাকান্ডের এক বছরের মাথায় মামলার বাদি সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বলেন, ‘লকডাউন উঠে গেলে আদালতের কার্যক্রম স্বাভাবিক হলে বিচার কাজ দ্রæতই শেষ হবে আশা করি। আমাদের প্রত্যাশা লকডাউন শেষে দ্রুততার
সাথে সাক্ষ্য শেষ হবে। মহামারির কারণে লকডাউন দীর্ঘ হলে মামলার বিচার কাজেও ধীরতা আসতে পারে। এসময়ে সাক্ষীদের সুরক্ষা দেওয়া প্রয়োজন’।
তবে এক বছরে অভিযোগ গঠন হয়ে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে আসায় সন্তোষ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘হত্যাকান্ডের পর থেকে চার্জশিট দেওয়ার সময় পর্যন্ত খুব দ্রæতই মামলার কার্যক্রম এগিয়েছে। পরবর্তীতে করোনা ভাইরাস মহামারির ফলে দেওয়া লকডাউন ও অন্যান্য কারণে কিছুটা দেরি হয়েছে। এরপরও এক বছরে অভিযোগ গঠন হয়ে সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে এসেছে’।
গত বছরের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরে এপিবিএন চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা। তিন বছর আগে সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যাওয়া সিনহা ‘লেটস গো’ নামে একটি ভ্রমণ বিষয়ক ডকুমেন্টারি বানানোর জন্য এর আগে প্রায় একমাস ধরে কক্সবাজারের হিমছড়ি এলাকায় ছিলেন।
ওই কাজে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া’ বিভাগের শিক্ষার্থী সাহেদুল ইসলাম সিফাত ও শিপ্রা দেবনাথ তার সঙ্গে ছিলেন।
কক্সবাজারের পুলিশ ওই সময় বলেছিল, সিনহা তার পরিচয় দিয়ে ‘তল্লাশিতে বাধা দেন’। পরে ‘পিস্তল বের করলে’ চেক পোস্টে দায়িত্বরত পুলিশ তাকে গুলি করে বলে জানানো হয়। পুলিশ সেদিন ঘটনাস্থল থেকেই সিফাতকে গ্রেপ্তার করে। পরে নীলিমা রিসোর্ট থেকে গ্রেপ্তার করা হয় শিপ্রাকে।
পরে সিনহা নিহত হওয়ার ঘটনা এবং গাড়ি থেকে মাদক উদ্ধারের অভিযোগে টেকনাফ থানায় আলাদা দুটি মামলা করে পুলিশ। মামলায় সিনহা এবং তার সঙ্গে থাকা সিফাতকে আসামি করা হয়। আর নীলিমা রিসোর্ট থেকে শিপ্রাকে গ্রেপ্তার করার সময় মাদক পাওয়া যায় অভিযোগ করে তার বিরুদ্ধে রামু থানায় আরেকটি মামলা করে পুলিশ।
কিন্তু পুলিশের দেওয়া ঘটনার বিবরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গতবছর ২ আগস্ট উচ্চ পর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। তখন পুলিশের বিরুদ্ধে ‘বিচার বহির্ভূত হত্যার’ অভিযোগও নতুন করে আলোচনায় আসে।
এরপর নিহত সিনহার বোন শারমিন ৫ আগস্ট টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ, পরিদর্শক লিয়াকতসহ ৯ পুলিশ সদস্যকে আসামি করে আদালতে মামলা করলে র‌্যাবকে তদন্তভার দেন বিচারক।
গতবছর ১৩ ডিসেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাব-১৫ তে দায়িত্বরত সহকারী পুলিশ সুপার মো. খায়রুল ইসলাম আলোচিত এ মামলায় ১৫ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। খবর বিডিনিউজের
আসামিরা হলেন টেকনাফ থানার সেসময়ের পরিদর্শক লিয়াকত আলী, টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল-মামুন, মোহাম্মদ মোস্তফা, এপিবিএন এর তিন সদস্য এসআই মোহাম্মদ শাহজাহান, কনস্টেবল মোহাম্মদ রাজীব ও মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ, পুলিশের মামলার তিন সাক্ষী নুরুল আমিন, নেজাম উদ্দিন ও মোহাম্মদ আয়াজ, টেকনাফ থানার সাবেক কনস্টেবল রুবেল শর্মা এবং সাবেক এএসআই সাগর দেব।
মামলায় গ্রেপ্তার ১৪ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তদন্তকারীরা। তাদের মধ্যে ওসি প্রদীপ ও কনস্টেবল রুবেল ছাড়া ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
গ্রেপ্তার হওয়ার পর ওসি প্রদীপ, পরিদর্শক লিয়াকতসহ গ্রেপ্তার পুলিশ সদস্যদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কক্সবাজারের পুলিশকে নতুন করে সাজানো হয়। এসপি থেকে কনস্টেবল- প্রায় সব পুলিশ সদস্যকে বদলি করা হয় অন্য জেলায়।
বাদী পক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ মোস্তফা বলেন, ‘আমরা মামলার কার্যক্রমে সন্তুষ্ট। সাক্ষ্য নেওয়ার জন্য মোট ৮৩ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৫ জনকে নোটিশও দেওয়া হয়েছিল। ২৬, ২৭ ও ২৮ জুলাই মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের দিন থাকলেও লকডাউনের কারণে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি। লকডাউন শেষে দ্রæতই বিচারকাজ শেষ হবে বলে আশা করি’।
এই মামলার অভিযোগ গঠনের দিন সাবেক ওসি প্রদীপ দাশের আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত আসামিদের নির্দোষ দাবি করে অভিযোগ গঠনের বিষয়ে ‘ন্যায়-বিচার’ ফিরে পেতে উচ্চ আদালতে আবেদন করবেন বলে জানিয়েছিলেন।
রানা দাশগুপ্ত গতকাল শনিবার বলেন, ‘করোনা ভাইরাসের কারণে সাক্ষ্যগ্রহণে দেরি হচ্ছে। লকডাউন কন্টিনিউ হলে সাক্ষ্য গ্রহণ কখন শুরু হবে ঠিক নেই। তবে দ্রæত সময়ে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে আশা করি’।
তবে মামলার এফআইআর (এজাহার) ও অভিযোগপত্রে গরমিল রয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘দুটিতেই পরস্পরবিরোধী বক্তব্য রয়েছে। এফআইআর এ বলা হয়েছে সিনহার মৃত্যু নিশ্চিত হবার পর ওসি প্রদীপ ঘটনাস্থলে গিয়েছেন, মুখমন্ডল বিকৃত করার চেষ্টা করেছেন। অথচ চার্জশিটে বলা হয়েছে মৃত্যুর পূর্বে ওসি প্রদীপ ঘটনাস্থলে গিয়ে পায়ে পাড়া দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করেছেন’।
ঘটনার পর সাবেক ওসি প্রদীপ ও তার স্ত্রী চুমকি কারনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের মামলায় সম্প্রতি আদালতে অভিযোগপত্র জমা পড়েছে।
অন্যদিকে সিনহার সঙ্গী সিফাত ও শিপ্রার বিরুদ্ধে মাদক আইনে পুলিশের করা দুটি মামলায় অভিযোগের ‘সত্যতা পাওয়া যায়নি’ জানিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।