র‌্যাবের হাতে আটক ৫ জনই চাঁদাজীবী

19

মনিরুল ইসলাম মুন্না

নগরীর অলংকার মোড়ে গাড়ি থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগে পরিবহন শ্রমিক ও মালিক সমিতির পাঁচ লোককে গ্রেপ্তারের ঘটনায় অঘোষিত ধর্মঘট পালন করে পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠন। পরবর্তীতে নগরে বন্ধ ছিল যান চলাচল। ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ যাত্রীরা।
কিন্তু পরিবহন শ্রমিকের নামে চাঁদাবাজির ঘটনার সত্যতা মিলেছে। বাস-মিনিবাস ও হিউম্যান হলারের চালক-মালিকদের কাছ থেকে জিম্মি করে আদায় করা হতো চাঁদা। আর চাঁদাবাজির দায়েই এ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-৭।
তারা হলেন লুসাই বাস মালিক সমিতির লাইনম্যান মোহাম্মদ আরিফ হোসেন (৩০), চট্টলা (মেট্রো) বাসমালিক সমিতির লাইনম্যান নারায়ন দে (৫১) ও মো. অহিদ (৩৮), চট্টগ্রাম জেলা বাস-মিনিবাস হিউম্যান হলার মালিক সমিতির লাইনম্যান সিদ্দিক হোসেন (৪৫) ও মোহাম্মদ আজাদকে (৩৪) সাদা পোশাকে তুলে নিয়ে যায় র‌্যাব। পরে রাতে তাদের চাঁদাবাজির মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে পাহাড়তলী থানায় হস্তান্তর করা হয়।
র‌্যাবের দাবি, জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে কাভার্ডভ্যান, মালবাহী ট্রাকসহ অন্যান্য পরিবহনের ড্রাইভারদের কাছ থেকে জোরপূর্বক চাঁদা আদায় করার বিষয়টি স্বীকার করে। তাদের দেহ তল্লাশি করে চাঁদা আদায়ের নগদ ২১ হাজার ৮২০ টাকা জব্দ করা হয়।
র‌্যাব-৭ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল এম. ইউসুফ পূর্বদেশকে বলেন, পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।
তবে চাঁদাবাজির বিষয়টি অস্বীকার করে মালিক সংগঠনের নেতারা বলছেন,সংগঠনের পক্ষ থেকে কোনো ধরণের চাঁদা নেয়া হয়নি এবং ধর্মঘটের ডাকও দেয়া হয়নি। চালক-মালিকরা ইচ্ছে করেই গাড়ি বন্ধ রেখেছেন।
অন্যদিকে পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, চাঁদাবাজির বিষয়ে আমরা কিছু প্রমাণ পেয়েছি। আমাদের তদন্ত অব্যাহত আছে।
গতকাল শনিবার সরেজমিনে অলংকার, একে খান মোড়ে মিনিবাস ও হিউম্যান হলারের চালক-মালিকদের সাথে কথা বলে চাঁদাবাজির বিষয়ে সত্যতা মেলে।
তারা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ৮, ১১, ১৫ ও ১৭ নম্বর মিনিবাস ও হিউম্যান হলার রুটে চাঁদাবাজির নৈরাজ্য চলছিল। র‌্যাবের হাতে ধরা পড়ার পর কয়েকদিন ধরে টাকা উত্তোলন বন্ধ আছে।
কি পরিমাণ চাঁদা তোলা হতো জানতে চাইলে তারা জানান, প্রতি লাইনে গাড়ির সংখ্যা রয়েছে ৫০ থেকে ৭০ টির মত। শুধু ৮নং রুট থেকে প্রতিদিন ৫ হাজার টাকার মত চাঁদা তোলা হতো। গাড়ি রাস্তায় নামালে চাঁদা দিতে হবে। অলংকার মোড়ে প্রতি গাড়ি থেকে দৈনিক ১০০ টাকা ওয়েবিল নামে আর ২০ টাকা লাইনম্যানের খরচ বাবদ উত্তোলন করা হতো। করোনা মহামারির সময় যখন অর্ধেক যাত্রী করে যানবাহন চলাচল করেছিল, তখনও বন্ধ ছিল না চাঁদা উত্তোলন। প্রতিমাসে হিসাব করে তিন হাজার টাকা ওয়েবিল এবং এক হাজার টাকা সমিতির নামে চাঁদা তুলে নিত। সমিতির নাম দিয়ে তারা চালক-মলিকদের এক প্রকার জিম্মি করে টাকা নিত। তা নাহলে গাড়ি চলতে দিত না। অথবা পুলিশ সার্জেন্ট দিয়ে নানা অজুহাত বের করে মামলা-হয়রানি করত। এক কথায় চাঁদা না দিয়ে গাড়ি চলাচলের সুযোগ ছিল না।
নাম প্রকাশ না করার একটি গাড়ির মালিক বলেন, করোনা মহামারিতে আমরা এক বেলা গাড়ি বের করতে পারলেও অন্য বেলা বসিয়ে রাখতে হয়েছে। কারণ মানুষ ঘর থেকে বের হতো না। ভাড়ার পরিমাণ ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হলেও গাড়ির খরচ উঠানো যেত না। তারমধ্যেও তাদের চাঁদা আদায়ে কোনো ছাড় দেয়নি। চাঁদা তাদেরকে দিতেই হবে। তিন হাজার টাকা ওয়েবিলের সাথে এক হাজার টাকা সমিতিতে দিতে হতো। যা চলমান ছিল। তবে গ্রেপ্তার হওয়ার পরবর্তী তিন দিন ধরে চাঁদা তোলা বন্ধ রয়েছে।
এদিকে জেলা হিউম্যান হলার পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা জানান, নিয়ম হলো স্ব-স্ব টার্মিনালে লাইন খরচের চাঁদা নেবে। ছোট গাড়ি যত্রতত্র স্টেশন গড়ে তুলে চাঁদা নেয়া শুরু করেছে। নির্ধারিত স্টেশন ছাড়া পথে পথে যত্রতত্র চাঁদা তোলার বিষয়টির বিরোধিতা করছি। গত বুধবার যে শ্রমিকদের প্রশাসন গ্রেপ্তার করেছে তারা আসলেই চাঁদাবাজি করেছে কি না তা তদন্ত করার দায়িত্ব পুলিশের। নিরপরাধ হলে ছেড়ে দিক। এদের গ্রেপ্তারকে কেন্দ্র করে কোন ধরণের পরিবহন ধর্মঘটের ডাক তাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে দেয়া হয়নি। কিছু মালিক ইচ্ছে করে গাড়ি বের করেননি।
জেলা হিউম্যান হলার পরিবহন মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. খোরশেদ বলেন, গ্রেপ্তার পাঁচজনের মধ্যে দুই জন সরাসরি আমাদের লাইনের। মো. আজাদ ও মো. সিদ্দিক হোসেন। র‌্যাব তাদের পকেটের টাকা উদ্ধার দেখিয়ে চাঁদার টাকা বলেছে। আমরা তাদেরকে অফিস থেকে বেতন দেয়া স্বত্বেও তারা চাঁদাবাজি করবে কেন? চাঁদা তোলা নিয়ে আমাদের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
প্রতিদিন ওয়েবিলের ১২০ টাকা এবং মাসিক মালিক সমিতির নামে এক হাজার টাকা কেন তোলা হত প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, করোনার আগে আমরা চাঁদা তুলতাম, তবে এখন তুলি না। প্রয়োজনে আপনি এসে দেখে যান। বর্তমানে আমরা ওয়েবিল তো দূরের কথা মাসিক চাঁদা পর্যন্ত না নেয়ার নির্দেশনা রয়েছে। লাইনম্যানরা ব্যক্তিগতভাবে নিলে নিতে পারে।
একইভাবে চট্টলা বাস-মিনিবাস হিউম্যান হলার পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জিয়াউদ্দিন শরীফ মিজান বলেন, করোনা আসার পর থেকে লাইন থেকে চাঁদা তোলা বন্ধ রয়েছে।
তাহলে দৈনিক উত্তোলিত চাঁদা কি অবৈধভাবে তোলা হতো? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমি জানি না।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি গোলাম রসুল বাবুল বলেন, আমি জানি না কে চাঁদাবাজি করেছে আর কে করে নাই। গ্রেপ্তারকৃতরা যদি দোষ করে থাকেন, আর বিষয়টি পুলিশি তদন্তের মাধ্যমে উঠে আসে তবে তাদের আইনের আওতায় আনা হোক। আর নির্দোষ ব্যক্তিকে এসব থেকে অব্যাহতি দেয়া হোক।
মামলার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পাহাড়তলী থানার উপ-পরিদর্শক ধীমান মজুমদার পূর্বদেশকে বলেন, বাস মিনিবাস থেকে চাঁদা তোলার বিষয়ে কিছু সত্যতা পেয়েছি এবং গ্রেপ্তারকৃতরা স্বীকারও করেছে। তবে কত টাকা বা কোথা থেকে নেয়া হতো তা এখনও জানতে পারিনি। নিয়মিত মামলার অংশ হিসেবে তদন্ত চলমান রয়েছে।