র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে ভারত কি ভূমিকা রাখছে ?

25

পূর্বদেশ ডেস্ক

বাংলাদেশের র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে দিল্লি কোনও সহযোগিতা করবে কিনা, সে প্রশ্ন এড়িয়ে গেলো ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের মন্তব্য নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া জানালেন না তারা। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকালে দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী বলেছেন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এখন ঢাকা সফর করছেন। তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন। তাই এখন আমি এই বিষয়ে কিছু বলতে পারব না। আগে সফর শেষ হোক। তারপর আমরা দেখব।
অরিন্দম জানান, সাধারণত আমরা যদি কোনো দেশ থেকে কোনো অনুরোধ পাই, তাহলে তা নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো কথা বলি না। এর আগে গত মঙ্গলবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেছিলেন, র‌্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে ভারতের সহযোগিতা চেয়েছে বাংলাদেশ। তিনি বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ৪৫ লাখ ভারতীয় বসবাস করেন। তারা খুব শক্তিশালী। তারাও বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এ কে আব্দুল মোমেন বিস্তারিত না বললেও স্পষ্টতই তার ইঙ্গিত ছিল যেহেতু ভারত ও আমেরিকার মধ্যে ক‚টনৈতিক সম্পর্ক বেশ ভালো, সেই সুসম্পর্কটাকে কাজে লাগিয়েই এই নিষেধাজ্ঞাজনিত অস্বস্তি কাটিয়ে উঠতে চাইছে ঢাকা।
বাংলাদেশের সহযোগিতা চাওয়া প্রসঙ্গের অবতারণা করেই দিল্লিতে গতকালের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে অরিন্দম বাগচী বলেন, এই মুহূর্তে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ঢাকায় রয়েছেন। ওই সফরে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও একে আবদুল মোমেনের সঙ্গেও দেখা করবেন। ফলে এখানে বসে বিষয়টা নিয়ে কোনও মন্তব্য করা সমীচীন বোধ করছি না। আমরা আগেই কোনও অনুরোধ পেয়েছিলাম কিনা, বিষয়টা নিয়ে আলোচনা হলো কিনা, সেটা বলাটা এখন ঠিক হবে না। পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে বৈঠকটা তো আগে হোক। তারপরে না হয় দেখা যাবে আমরা কোনও ডিটেলস শেয়ার করতে পারি কিনা! তবে হ্যাঁ, আমরাও সংবাদমাধ্যমে রিপোর্ট দেখেছি যে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ ধরনের একটা মন্তব্য করেছেন।
সেই সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র যোগ করেন, তবে এটাও বলার যে সত্যিই কোনও দেশ যদি আমাদের এরকম অনুরোধ জানিয়েও থাকে এবং তার ভিত্তিতে আমরা কোনও পদক্ষেপ নিয়েও থাকি, সেটা বোধহয় আমরা প্রকাশ্যে নাও জানাতে পারি। তাই বলবো, আপনারা বরং এস জয়শঙ্করের ঢাকা সফর শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করুন। দেখা যাক, আমরা আদৌ কিছু জানাতে পারি কিনা, বলেন অরিন্দম বাগচী।
দিল্লিতে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টি সরাসরি স্বীকার না-করলেও মুখপাত্র একবারের জন্যও তা কিন্তু অস্বীকারও করেননি। ফলে পর্দার আড়ালে দিল্লি ইতোমধ্যে ওয়াশিংটনের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথাবার্তা শুরু করেছে, এমনটা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে।
প্রসঙ্গত : গত ১০ ডিসেম্বর র‌্যাব এবং র‌্যাবের বর্তমান ও সাবেক সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর বাংলাদেশ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল মিলারকে ডেকে তার আপত্তি প্রকাশ করেছিল। বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা না করে এ নিষেধাজ্ঞা আরোপকে সঠিক মনে করেনি বাংলাদেশ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি বিøঙ্কেনের সঙ্গে গত ১৬ ডিসেম্বর আলাপকালে বাংলাদেশের এ আপত্তির কথা জানিয়েছিলেন। গত জানুয়ারি মাসের শুরুতে বিøঙ্কেনকে যে চিঠি দেন মোমেন, সেখানেও র‌্যাবের প্রশংসা ও মানবাধিকার পরিস্থিতি কেন ভালো, এর ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। প্রাথমিক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার পর বাংলাদেশের অবস্থান ক্রমেই নমনীয় হয়ে আসে। পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেছিলেন, ‘ভিত্তিহীন এবং বানানো তথ্যের’ ভিত্তিতে এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
নিষেধাজ্ঞার খবর জানিয়ে তখন মার্কিন অর্থ দফতর বলেছিলো যে, তাদের ফরেন অ্যাসেটস কনট্রোল অফিস (ওএফএসি) বিভিন্ন দেশের মোট দশটি প্রতিষ্ঠান ও পনের জন ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে-যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং নিপীড়নের সাথে সংশ্লিষ্ট। এই তালিকাভুক্তদের অন্যতম হলেন বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর বর্তমান প্রধান বেনজির আহমেদ ছাড়াও র‌্যাব ও এর ছয়জন কর্মকর্তা।
বিজ্ঞপ্তিটিতে বলা হয়, বাংলাদেশের বেসরকারি সংগঠনগুলো অভিযোগ করেছে যে র‌্যাব এবং অন্যান্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ২০০৯ সাল থেকে প্রায় ৬০০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাÐ, ৬০০-রও বেশি লোকের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া, এবং নির্যাতনের জন্য দায়ী।
যদিও বিশ্লেষকরা সবসময়ই বলে আসছেন যে এ বিষয়টির সাথে ক‚টনৈতিক ও রাজনৈতিক ইস্যু জড়িত আছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, পুলিশের এলিট ফোর্স র‌্যাব ও এর কর্মকর্তাদের উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দেবার ইস্যুটিকে বাংলাদেশের উপর আমেরিকার একটি ‘চাপ সৃষ্টি’র কৌশল।
এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বারবার অনুরোধ করা হলেও ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের নতুন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস গত সপ্তাহেই বলেছেন যে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার সুস্পষ্ট পদক্ষেপ ছাড়া র‌্যাবের প্রতি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার তার দেশের পক্ষে সম্ভব নয়।
র‌্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে প্রতিবেশী ভারতের সহায়তা চাওয়া প্রসঙ্গে সাবেক ক‚টনীতিক ও বিশ্লেষকরা মনে করেন ভারত বা তৃতীয় কোনো দেশের এ বিষয়ে কিছু করার নেই। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রকে নিজেদের মধ্যকার ক‚টনৈতিক সম্পর্ক দিয়েই এ সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে। তারা বলেন, র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা কীভাবে প্রত্যাহার হতে পারে সেটি যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষই স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে এবং সে কারণেই ভারত বা অন্য কারও এতে কোনো কিছু করার সুযোগই নেই।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই দেশ দুটি একযোগে কাজও করছে। তাছাড়া নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে মার্কিন কর্মকর্তারা ঢাকা ও ওয়াশিংটনে বারবার বলেছে যে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার জটিল প্রক্রিয়া। এটি প্রত্যাহার চাইলে কী করতে হবে সেটিও তারা পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছে। এ অবস্থায় তৃতীয় দেশের এখানে কিছু করণীয় আছে বলে তারা মনে করেন না।