র‌্যাগিং-বুলিং-কিশোর গ্যাং এর কবলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা

62

অধ্যাপক আয়েশা পারভীন চৌধুরী

র‌্যাগিং শব্দটা বর্তমানে শিক্ষার সাথে অতি পরিচিত শব্দ। বেশকিছুদিন আগেও এদেশের মানুষ র‌্যাগিং শব্দটির সাথে তেমন পরিচিত ছিলনা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হচ্ছে শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জনের স্থান। এখন প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে র‌্যাগিং বিরোধী কমিটি গঠনের নির্দেশনা আছে। অভিযোগ বাক্স রাখার ব্যবস্থা আছে। সরাসরি অভিযোগ করতে বাধা বিপত্তি থাকলে ও ভয়-ভীতির জন্য নিরবে প্রতিবাদ জানানোর জন্যই অভিযোগ বাক্স। দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে র‌্যাগিং চরম আকার ধারণ করেছে। দলীয় আধিপত্য ও ব্যক্তিগত কারণে প্রতিদিন কোননা কোন বিশ^বিদ্যালয়ে র‌্যাগিং হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে নির্যাতন ও খবরদারি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাসের নতুন কোন ঘটনা নয়। সব সময় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর নির্ভর করে সাধারণ-শিক্ষার্থীদের চাওয়া-পাওয়া।
এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসনের প্রশ্রয়ে। ২৪/০১/২০ তারিখের প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত ছবি ও সংবাদে জানা যায়, চার ছাত্রকে নির্যাতনের প্রতিবাদে শিক্ষার্থী মুকিবুল হক চৌধুরী অবস্থান কর্মসূচি করে। এই ধরনের ঘটনা ধারাবাহিক পরিস্থিতির অংশ। পত্রিকা থেকে জানা যায়, প্রতি বছর জানুয়ারির শুরুতে রাত ১১টা থেকে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একটু পর পর তরুণদের ছোট-বড় দল চোখেপড়ে। ‘গেস্টরুম’ থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বাইরে ঘুরতে পাঠানো এসব তরুণ বিশ^বিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থীদের দেখা মাত্র সালাম দেওয়া, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য করা ইত্যাদি। শর্ত সাপেক্ষে তারা বিশ^বিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে থাকার সুযোগ পায়। আবাসন সংকটের কারণে গণরুমে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। হলে থাকতে হলে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নিয়ন্ত্রণে থাকা গণরুমগুলোতে উঠতেই হয়। বিনিময়ে যেতে হয় সংগঠনের নিয়মিত রাজনৈতিক কর্মসূচিতে, অন্যথায় চলে নির্যাতন।
চট্টগ্রাম শহর থেকে অনেক দূরে অবস্থিত চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা ট্রেন, বাস ও অন্যান্য মাধ্যমে পড়তে যায়। আর যারা ভার্সিটির ক্যাম্পাসে অবস্থান করে তারা আবাসন সমস্যার সম্মুখীন হয়। অন্যান্য বিশ^বিদ্যালয়ের মত র‌্যাগিং সমস্যায় জর্জরিত না হলেও দলীয় আধিপত্য বিস্তারের কারণে মারামারির ঘটনা লেগে আছে। রাত-বিরাত, কথা নাই, বার্তা নাই হঠাৎ মারামারির সংবাদ প্রচারিত হতে থাকে। তাছাড়া শাটল ট্রেনেও সিট ও বগী দখল নিয়ে কথা কাটা কাটি থেকে মারামারিতে ও অবরোধের ডাক দেওয়া হয়। এতে সাধারণ ছাত্র/ছাত্রীরা বেশি ভুক্তভোগী হয়। সেশন জটের মত সমস্যার সৃষ্টি হয়। অথচ প্রাক্তন ছাত্র/ছাত্রীদের নিয়মিত পুনর্মিলনীর সংবাদ আমাদের আনন্দ দিলেও, চলমান মারামারি ও অবরোধের সংবাদে আমরা আশাহত হই। ২৩/০১/২০ তারিখে আজাদী পত্রিকায় ৩য় পাতায় প্রকাশিত, সংবাদে জানা যায়, ‘নবীন তোমায় স্বাগত জানাই, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রয়োজনে প্রবীণদের পাবে তোমাদের পাশে,’- এ প্রতিপাদ্যকে ধারণ করে বিশ^বিদ্যালয় র‌্যাগিংমুক্ত ক্যাম্পাসে নিশ্চিত করে নবীন ও প্রবীণ শিক্ষার্থীদের পরস্পরের মাঝে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় জিরো পয়েন্ট হতে চ/বি কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ পর্যন্ত উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতারের নেতৃত্বে ‘র‌্যাগিং বিরোধী শোভাযাত্রা’ অনুষ্ঠিত হয়। উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার বলেন, শুধু পঠন-পাঠন নয়, জ্ঞান অর্জন এবং জ্ঞান বিতরণের মাধ্যমে সৎ, দক্ষ, যোগ্য ও আলোকিত মানব সম্পদ তৈরি করা বিশ^বিদ্যালয়ের অন্যতম মূললক্ষ্য। প্রসঙ্গক্রমে উপাচার্য বলেন, জঙ্গি-সন্ত্রাস-মাদক ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বর্তমান সরকার ঘোষিত জিরো টলারেন্স নীতি ধারণ করে ড্রাগ মুক্ত ক্যাম্পাস হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। তিনি শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন গবেষণায় অধিকতর সম্পৃক্ত হয়ে সকল প্রকার অন্যায় ও সাম্প্রদায়িকতাকে প্রতিহত করে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হওয়ার আহ্বান জানান। বছরের শেষে ও বছরের শুরুতে ঘরভাড়া বৃদ্ধির সংবাদ এবং ভর্তিযুদ্ধ ও ভর্তি বাণিজ্য একটি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছরের এই ঘটনা ও সংবাদে সাধারণ নাগরিক অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রতিবাদের ভাষাও হারিয়ে ফেলেছে। জীবন চলার পথে অন্যদের সাথে টিকে থাকতে হলে এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধিকে স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করতে হচ্ছে। সাধ্য ও সামর্থ্যরে কাছে কখনো কখনো ব্যর্থ হয়ে অসহায়ত্তকে বরণ করে নিতে স্কুল পর্যায়ের কোমলমতী শিক্ষার্থীরাও মাঝে মাঝে নানান অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত হয়ে যায়। বিশেষ করে বন্ধুদের দলকে শক্তিশালী করতে বুলিং ও মারামারিতে লিপ্ত হয়। ইভটিজিং এ জড়িত হয়ে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করে। মাদক সেবন ও সিগারেটে আসক্ত হতে থাকে।
তাই পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি বিভিন্ন সহকারী শিক্ষাকে উৎসাহিত করতে হবে। খেলাধুলা, সংস্কৃতি ও স্কাউটে ব্যস্ত রাখতে হবে। সম্প্রতি প্রশ্নপত্র ফাঁস ও অন্যান্য অসদুপায়ের জন্য ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে ৬৪ শিক্ষার্থীকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হয়। অন্যদের সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। প্রথম বর্ষে যারা এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হন, দ্বিতীয় বর্ষে তাদেরই অনেকে আবার নির্যাতনের হোতা অর্থাৎ বড় ভাইয়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা যায়। তারাই আবার ছোটদের ভিন্ন অভিযোগে নির্যাতন করে। এভাবেই বছরের পর বছর ধরে নির্যাতনের এই চক্র-চলে আসছে, গণরুমে যারা অবস্থান করে তাদের রাতদিন আতঙ্কে দিন কাটে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে নামী ও দামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বুয়েটের আবরার র‌্যাগিং এর চরম শিকার। বুয়েটের ছাত্র আবরার হত্যার পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে র‌্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে জোড় প্রতিবাদ উঠে। আমরা সবাই কম-বেশী এই র‌্যাগিং বিষয়ে অবগত আছি। বিশেষ করে পাবলিক বিশ^বিদ্যালয় গুলোতে র‌্যাগিং সাধারণ ঘটনার মত। ফলে অনেক মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী মানসিক ও শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত হয়। কয়েকটি স্কুল পর্যায়ে র‌্যাগিং সংবাদ সবাইকে হতবাক করে। এইরকম কত আবরার হারিয়ে যাচ্ছে। যে আবরারকে নিয়ে আন্দোলন চলল, সেই আবরারকে সবাই ভুলে গেছে। পান থেকে চুন খসলেই বিশ^বিদ্যালয়ের অঙ্গ-সংগঠনগুলোতে সংঘর্ষ লেগে যায়। কথা-কাটাকাটি, গায়ে ধাক্কা লাগার মতো ‘সস্তা’ ঘটনায় যেমন সংঘর্ষে জড়িয়ে যায়, তেমনি হলের আসন দখল, টিভি কক্ষে বৈঠক করা নিয়ে সংঘর্ষ, ট্রেনের বগি দখল নিয়ে সংঘর্ষ, ইত্যাদি বিষয়ে সময় অসময়ে রাজনৈতিক অঙ্গ-সংগঠনগুলো অবরোধ ডেকে অচল অবস্থা সৃষ্টি করে। প্রত্যেকবার অবরোধের পিছনে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের গ্রæপভিত্তিক কোন্দলকে দায়ি করা হয়।
যারা আমাদের আদরের ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে তারা তাদের অবস্থান পোক্ত করে নিচ্ছে। ক্ষতি হচ্ছে অভিভাবক ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের। বর্তমানে কিশোর গ্যাং একটি প্রকট সমস্যায় পরিনত হয়েছে। নিজেদের শক্তি ও সামর্থ্য প্রদর্শন করতে গিয়ে অনেক কমোলমতি শিক্ষার্থী কিশোর গ্যাংটির সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন কর্মকাÐের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ইভটিজিং, কিশোরগ্যাং ও বুলিং এর বিরুদ্ধে পাঠদানের ব্যবস্থা করতে হবে। সত্যিকারের মানুষ হতে হলে পুঁথিগত শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষার কোন বিকল্প নেই।
লেখক: কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক