রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে আইসিজে মামলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে

42

বাংলাদেশে আশ্রিত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ঘিরে নানা অস্থিরতা মোকাবেলা করছে বাংলাদেশ। যা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বারবার আলোচিত হচ্ছে। দীর্ঘ চার দশক ধরে মিয়ানমার সরকারের নিপীড়নের মুখে বিভিন্ন সময় রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশ বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে শরণার্থী হিসাবে দিনযাপন করে আসলেও ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় এগারো লাখের অধিক। দেশটির সেনাবাহিনীর জাতিগত নিপীড়নের মুখে বাধ্য হয়ে সর্বশেষ সাত লাখের অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। যদিও সরকার এদের শরণার্থী হিসাবে স্বীকৃতি দেয়নি, এরপরও দীর্ঘ সময় এদেশে রোহিঙ্গাদের অবস্থান এ দেশ ও জাতির জন্য কোনভাবেই মঙ্গলজনক নয়। সরকারের উদার ও মানবিক দিক বিবেচনা করে এদের আশ্রয় দেয়ার পর দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের জন্য অন্ততপক্ষে দুইবার উদ্যোগ নিলেও তা ভেস্তে যাচ্ছে। এরমধ্যে চলছে পশ্চিমা বিশ্বের এনজিওগুলোর সন্দেহজনক তৎপরতা। এমতাবস্থায় গত ১১ নভেম্বর ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে মামলা করেছে ওআইসিভুক্ত দেশ গাম্বিয়া। অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রাখাইন রাজ্যে বসবাসরত রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ এবং তাদের আবাস ধ্বংসের কথা বলেছে গাম্বিয়া। মামলার বিষয়ে আগামী মাসে শুনানি শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। আইসিজের বিধি অনুসারে, জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত এক দেশ অন্য দেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গের অভিযোগ তুলতে পারে। গণহত্যা প্রতিরোধ ও এর শাস্তি বিধানে ১৯৮৪ সালে স্বাক্ষরিত কনভেনশন লঙ্ঘনের অভিযোগ করা হয়েছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে। মিয়ানমার আইসিসির স্বাক্ষরকারী দেশ না হলেও আইসিসির রায়ে যা আসবে, তা পালন করার দায়িত্ব প্রতিটি দেশের। আইসিসি সনদে জাপান, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বেশির ভাগ দেশই সই করেছে। যেসব দেশ ওই সনদে সই করেছে, তাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব আইসিসির রায় বাস্তবায়ন করা। সোমবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রয়োজনীয়তা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা মামালার পক্ষে জোরালো বক্তব্য তুলে ধরেন। ভোরের কাগজ ও আইসিএলডিএস যৌথভাবে এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। জানা গেছে, গত ৪ জুলাই আইসিসির কৌসুলি ফেতু বেনসুদা রোহিঙ্গা বিতাড়নের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্তের অনুমতি চেয়ে আইসিসিতে আবেদন করেছিলেন। ওই আবেদনে তিনি বলেন, ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর থেকে রোহিঙ্গা বিতাড়ন শুরু হয়েছিল। সেই সময় থেকে অপরাধের তদন্ত করা হবে। এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে ২০১৭ সালে সহিংসতার মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের বিতাড়নসহ অন্যান্য অমানবিক কর্মকান্ড ঘটেছে। এসব কর্মকান্ডের ফলে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হওয়ার ভিত্তি রয়েছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের শিকার হয়ে ২০১৬ সালের অক্টোবরে প্রায় ৮৭ হাজার এবং ২০১৭ সালের আগস্টের পর প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। ওই সময় মানবিক কারণে বাংলাদেশ সীমান্ত খুলে দেয়। সে সময় ৬ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে বর্তমানে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখের বেশি। চলমান রোহিঙ্গা সংকটের দুই বছর অতিক্রম হয়েছে। মানবিক সংকট হিসেবে শুরু হলেও পর্যায়ক্রমে ভূরাজনৈতিক সংকটে রূপ নিচ্ছে রোহিঙ্গা ইস্যু। এ সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়কে সোচ্চার হতে হবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য ২০১৭ সালে ২৩ নভেম্বর মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তিও স্বাক্ষর হয়। চুক্তি অনুযায়ী প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা শুরু হয়নি। রোহিঙ্গারা রাখাইন রাজ্যে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমারের পদক্ষেপের ওপর কোনো আস্থা রাখতে পারছে না। অপরদিকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতেও আন্তরিক নয় মিয়ানমার। বর্তমান প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাদের নাগরিক পরিচয়ের স্বীকৃতি, তাদের ওপর নিপীড়ন বন্ধ করা ও নিরাপদ বসবাসের নিশ্চয়তা দেয়ার জন্য মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগে বিশ্ব স¤প্রদায়ের জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। আমরা আশা করি, আন্তর্জাতিক আদালতে আইসিজের এ মামলা রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে একটি কার্যকর ভূমিকা রাখবে।