রোহিঙ্গা শিবিরে বড় অভিযানের প্রস্তুতি

19

বিশেষ প্রতিনিধি, কক্সবাজার

রোহিঙ্গা নেতা মহিবুল্লাহ হত্যাকান্ডের পর নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। রোহিঙ্গাক্যাম্প ঘিরে বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত এপিবিএন’র সদস্য সংখ্যা। একই সাথে বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা তৎপরতা ও নজরদারিও।
সম্প্রতি আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’র (এআরএসপিএইচ) চেয়ারম্যান ও রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যার পর ক্যাম্পগুলোতে নিরাপত্তাঝুঁকি নিয়ে নতুন করে ভাবছে প্রশাসন। এছাড়া বড় ধরনের অভিযানের কথা ভাবছে প্রশাসন।
ইতিমধ্যে বিভিন্ন অভিযানে বেশকিছু রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে আটক করা হয়েছে। গতকাল শনিবার উখিয়া রোহিঙ্গাক্যাম্প থেকে আরসা’র সদস্য সন্দেহে ৫ রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ১৪ এপিবিএন’র সদস্যরা গতকাল শনিবার ভোরে অভিযান চালিয়ে তাদেরকে গ্রেপ্তার করে। তারা হলেন মো. খালেদ হোসেন (৩৩), মাস্টার সৈয়দ আমিন (৩৮), মো. শাকের (৩৫), মোহাম্মদ কলিম (১৮) ও মো. ইলিয়াস (২২)।
১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন’র (এপিবিএন) অধিনায়ক পুলিশ সুপার নাঈমুল হক জানান, আটককৃতরা রোহিঙ্গাক্যাম্প এলাকায় চাঁদাবাজি, অপহরণসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত। তাদেরকে উখিয়া থানায় প্রেরণ করা হয়েছে।
এদিকে রোহিঙ্গা বিদ্রোহী সংগঠন আরসা, আরএসও ও আল ইয়াকিনসহ ১৭টি নিষিদ্ধ সংগঠনের সাংগঠনিক তৎপরতা রয়েছে ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে-বাইরে। এসব সংগঠনের অস্তিত্বের কথা স্বীকার করেন ১৬ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ানের অধিনায়ক মো. তারিকুল ইসলাম।
ক্যাম্পে দায়িত্বে নিয়োজিত একাধিক ক্যাম্প ইনচার্জ’র সাথে আলাপকালে তারা বলেন, ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে নিয়ন্ত্রণ করা খুব একটা সহজ কাজ নয়। কারণ ৫ হাজারের ঊর্ধ্বে রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠনের সদস্য সক্রিয় রয়েছে ছদ্মবেশে। গেল ৪ বছরে ২২৬ জন রোহিঙ্গা পরস্পর বিরোধী হামলা-সংঘর্ষে নিহত হন। তবে রোহিঙ্গা নেতা মহিবুল্লাহর মতো বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী লোকের হত্যাকান্ডের ঘটনা এ প্রথম। তাই এ ঘটনার পর মুহিবুল্লাহর পরিবারসহ সাধারণ রোহিঙ্গারা উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় কঠিন সময় পার করছেন।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বিশেষ করে সেনাবাহিনীর তত্ত¡াবধানে র‌্যাব, পুলিশ, এপিবিএন ও বিজিবি যৌথ অভিযানের মাধ্যমে চিহ্নিত অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হবে বলে জানান সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ। সেই সঙ্গে টানা ‘ব্লক রেইড’ ও ‘টাস্কফোর্স’ অভিযানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন।
এদিকে এপিবিএন’র একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, মুহিবুল্লাহ হত্যার পর রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে এপিবিএন’র আরো দুটি নতুন ব্যাটালিয়ন বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক এসপি নাইমুল হক বলেন, রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যার পর তার পরিবারের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। একই সঙ্গে চারগুণ বাড়ানো হয়েছে এপিবিএন’র সদস্য। উখিয়ার কুতুপালং লম্বাশিয়া ও এর আশপাশের ক্যাম্পে আগে যেখানে ৭০-৭৫ জন এপিবিএন সদস্য দায়িত্ব পালন করতেন, সেখানে এখন বাড়িয়ে ৩০০ জন করা হয়েছে। এছাড়া জোরদার করা হয়েছে গোয়েন্দা নেটওয়ার্কও।
তিনি আরো বলেন, মুহিবুল্লাহর হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে দ্রæত আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। ক্যাম্পে বøক রেইডসহ দিনে-রাতে ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। শুধু তাই নয়, রোহিঙ্গাক্যাম্প পর্যবেক্ষণে ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
ক্যাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা বলছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ‘ওয়াচ টাওয়ার’ তৈরি হলে নজরদারি আরো সহজ হবে। কারণ ক্যাম্পের বিভিন্ন স্থানে নিরাপত্তা বেষ্টনীর কাঁটাতার কেটে ছোট ছোট চোরাই পথ তৈরি করেছে দুষ্কৃতকারীরা। অপরাধীরা নিজেদের সুবিধার্থে কাঁটাতারের বেষ্টনী কাটছে। ছিনতাই, চুরি, চোরাচালান, খুন, গুম, ইয়াবা ও মানব পাচার, হুন্ডি কারবার এবং অস্ত্র মজুদসহ নানা অপরাধকান্ড ঘটিয়ে কাঁটাতারের বেষ্টনী পেরিয়ে অনেকে নিরাপদে পালিয়ে যান। ওয়াচ টাওয়ার থাকলে ২৪ ঘণ্টা নজরদারিতে থাকবে অপরাধী চক্র।
উল্লেখ্য, গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৮ টায় উখিয়ায় কুতুপালং লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় ইস্ট-ওয়েস্ট ১ নম্বর বøকের বাড়ির সামনে নিজ কার্যালয়ে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে গুলি করে হত্যা করে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় অজ্ঞাতা ২০-২৫ জনকে আসামি করে উখিয়া থানায় মামলা করেন মুহিবুল্লাহর ছোট ভাই মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ।
এর আগে হাবিবুল্লাহ গণমাধ্যমে আরসা নেতা মাস্টার আবদু রহিমসহ বেশ কয়েক জনের নাম উল্লেখ করেছিলেন, যারা মহিবুল্লাহকে সরাসরি হত্যা করেছেন অথচ মামলার এজহারে এদের নাম নেই। আলোচিত এ মামলায় এখন পর্যন্ত সন্দেহজনক পাঁচ রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান বলেন, মামলাটি তদন্তের প্রাইমারি পর্যায়ে রয়েছে। এ পর্যন্ত সন্দেহভাজন পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম জাতীয় কমিটির সভাপতি আতা উল্লাহ খাঁন জানান, মহিবুল্লাহ হত্যাকান্ড সম্পূর্ণ মিয়ানমার সরকারের মদদে রোহিঙ্গা জঙ্গিরা ঘটিয়ে থাকতে পারে। কারণ মহিবুল্লাহর চেয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রোহিঙ্গা সমস্যা তুলে ধরার মতো দক্ষ ও যোগ্য রোহিঙ্গা নেতা আপাতদৃষ্টিতে নেই।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. আতিকুর রহমান জানান, রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী প্রমাণের মাধ্যমে গাম্বিয়ার করা আন্তর্জাতিক আদালতের মামলাকে প্রশ্নবিদ্ধ করাই হচ্ছে মিয়ানমারের মূল উদ্দেশ্য। তাই তারা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিরোধী নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনগুলোকে কাজে লাগাচ্ছে। রোহিঙ্গাক্যাম্পে একের পর এক হত্যাকান্ডসহ নানা অপরাধ সংঘটিত করছে। নিষিদ্ধ রোহিঙ্গা সংগঠনগুলোর ক্যাডাররা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে নিয়মিত যাতায়াত করছে বলে মনে করি।