তুষার দেব
দেশের সীমান্তবর্তী কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রিত ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মিয়ানমারের রাখাইনে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটি মূলত দ্বি-পাক্ষিক হলেও এর পেছনে বহুপাক্ষিক স্বার্থ জড়িয়ে গেছে। মিয়ানমারে নিজ নিজ স্বার্থ রক্ষায় সচেষ্ট প্রতিবেশি দেশ ভারত, চীন, জাপান ও রাশিয়ার ঔদাসীন্যের পাশাপাশি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে দায়িত্বরত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার ভ‚মিকাও প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত করছে বলে অনেকেই মনে করছেন। সর্বশেষ এক মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে শরণার্থী ক্যাম্পে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় জোরালো ভ‚মিকা পালনকারী শীর্ষ রোহিঙ্গা নেতা মহিবুল্লাহ হত্যাকাÐের পর মাদ্রাসায় গুলি করে ও কুপিয়ে ছয় রোহিঙ্গাকে হত্যার ঘটনাগুলো সঙ্কটকে আরও ঘনীভ‚ত করেছে।
স্থানীয়রা বলছেন, গত চার বছরে শরণার্থী শিবিরে দায়িত্বরত দেশি-বিদেশি বেসরকারি সংস্থার ক‚টচালের পাশাপাশি হতাশাজনিত কারণে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের মধ্যে মতভেদ তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে প্রত্যাবাসন বিরোধী ২০টিরও অধিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ ও সংগঠনের তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। নিজেদের অভ্যন্তরীণ স্বার্থগত দ্ব›দ্ব ও আধিপত্য বিস্তারে এসব সশস্ত্র সংগঠন হরহামেশা প্রাণঘাতী সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে। মাদক ও অস্ত্রের কারবারে জড়িয়ে পড়ে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধ ও ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে গত চার বছরে দুইশ’ ৩২ জন রোহিঙ্গা নাগরিক নিহত হয়েছেন। এসব ঘটনাও প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এতে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা দেশের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য ক্রমেই হুমকি হয়ে উঠছে। একের পর এক খুন খারাবির ঘটনা বড় অঘটনের ঝূঁকি তৈরি করছে।
শরণার্থী বিষয়ক একাধিক সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত চার বছরে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় বিশেষ করে চীন, ভারত, রাশিয়া, জাপানের নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট নীরবতা এই সঙ্কটকে ঘনীভূত করে তুলেছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন ফোরামে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য উত্থাপিত বিভিন্ন প্রস্তাবের বাস্তবায়ন অনেকটাই ভেস্তে গেছে এই রাষ্ট্রগুলোর নীরবতার কারণে। চীন, ভারত, জাপান, রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক নানা ক্ষেত্রে উষ্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলেও এই রাষ্ট্রগুলো রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসন বা তাদের নিজভূমে প্রত্যাবাসনে সমাধানে কার্যকর কোনও পদক্ষেপ বা অবস্থান নিচ্ছে না। এর পেছনে রয়েছে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক স্বার্থ। বর্তমানে রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে চীনের অনেক প্রকল্প চালু রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম ‘বেল্ট এন্ড রোড’ আন্তর্জাতিক ব্যবসা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প, থেলং মিয়ানমার-চীন তেল ও গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ ইত্যাদি। এছাড়া মিয়ানমার ও চীন সরকারের যৌথ উদ্যোগে রাখাইন রাজ্যের পশ্চিমে এক হাজার হেক্টরের বেশি এলাকাজুড়ে ‘কিউকফিউ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন, যার লক্ষ্য- দুই দেশের শিল্প ও অবকাঠামো ভিত্তি এবং বৃহত্তর বাণিজ্যিক চ্যানেলকে সমৃদ্ধ করা। অর্থনীতি ছাড়াও বরাবরই চীন মিয়ানমারের সহযোগী দেশ।
অন্যদিকে প্রতিবেশি ভারত রাখাইন রাজ্যে কালাদান বহুমুখী প্রকল্প, দুটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প, মিয়ানমার-থাইল্যান্ড এবং ভারতের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনকারী চার লেন মহাসড়ক স্থাপন প্রকল্পের মত অনেক প্রকল্প গ্রহণ করেছে। কালাদান বহুমুখী প্রকল্পের মাধ্যমে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সিটওয়ে বন্দর ভারতের মিজোরামের সঙ্গে যুক্ত হবে। ভারতের রাজনীতিতে বহুল আলোচিত ‘সেভেন সিস্টারস’ অত্যন্ত গুরুত্ব ও তাৎপর্য বহন করে। ভারত বরাবরই এই অঞ্চলে সীমান্ত নিরাপত্তা ও উগ্র সন্ত্রাসবাদের তৎপরতার বিষয়ে সদাসতর্ক। এই সন্ত্রাসবাদ বা উগ্রবাদ মোকাবিলা করার জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক সুদৃঢ় করা জরুরি। রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে ভারতের নীরবতার পেছনে রাখাইন রাজ্যকে ঘিরে তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক স্বার্থের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। অন্যতম পরাশক্তি রাশিয়াও মিয়ানমারের সঙ্গে একটি পারস্পারিক বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করে যাচ্ছে। রাশিয়ার তেল কোম্পানি বাশনেফট এবং মিয়ানমার অয়েল অ্যান্ড গ্যাস এন্টারপ্রাইজ কেন্দ্রীয় মিয়ানমার অববাহিকা সুরক্ষিত করেছে। যার জন্য বাশনেফট ইতিমধ্যে সেখানে ৩৮ দশমিক তিন মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। জাপান সরকারের মূল পরিকল্পনায় রয়েছে রাখাইনের মংডুর কাছাকাছি পরিকল্পিত অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা এবং এই অঞ্চলের অর্থনীতিকে ঘিরে নতুন নতুন প্রকল্প প্রণয়ন করা। ফলে জাপান সরকার কৌশলগতভাবে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে নীরব ভূমিকা পালনকেই সুবিধাজনক মনে করছে। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বিভিন্ন ফোরামে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে কয়েক দফায় প্রস্তাব উত্থাপিত হলেও নিজস্ব স্বার্থসংশ্লিষ্ট কারণে বরাবরই সেসব প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিচ্ছে চীন আর ভোটদানে বিরত থাকে ভারত। বিগত ২০১৮ সাল থেকে ওআইসি ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যৌথভাবে তৃতীয় কমিটিতে রোহিঙ্গা সম্পর্কিত প্রস্তাবটি যখনই তুলেছে, প্রতিবারই বিপুল ভোটে তা গৃহীত হয়েছে। কিন্তু বরাবরই চীন ও ভারতের ভূমিকা বা অবস্থানের কোনও ব্যতিক্রম হয়নি। যে ৩১টি রাষ্ট্র এই ইস্যুতে ভোটদানে বিরত থেকেছে, তার মধ্যে ভারত ছাড়াও রয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্র জাপানও। তারা প্রত্যেকেই বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত হলেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে চার বছর ধরেই অনীহা এবং নীরবতার কৌশল অবলম্বন করে চলেছে। আন্তঃরাষ্ট্রীয় স্বার্থে আঘাত লাগতে পারে- এমন শঙ্কার পাশাপাশি শরণার্থী শিবিরে সাম্প্রতিক সময়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকা সহিংস সংঘাতের ঘটনা ও প্রত্যাবাসনবিরোধী অপপ্রচার পরিস্থিতিতে আরও জটিল করে তুলছে।
অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মো. এমদাদুল ইসলাম পূর্বদেশকে বলেন, গত ৪ অক্টোবর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৬তম অধিবেশনে অংশগ্রহণ-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যটি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, শরণার্থীদের লালন-পালন করাটাই অনেক বিদেশি সংস্থার জন্য ব্যবসা। রোহিঙ্গা সঙ্কটের সৃষ্টি মিয়ানমারে, সমাধানও রয়েছে মিয়ানমারে। রাখাইন রাজ্যে তাদের মাতৃভূমিতে টেকসই ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের মাধ্যমেই কেবল এ সঙ্কটের স্থায়ী সমাধান হতে পারে। এটাই এখনকার বাস্তবতা। কেননা, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিগত চার বছরে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারেনি। বিশ্বজুড়ে শরণার্থী সমস্যার উদ্ভব হলে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও বেসরকারি সংগঠনগুলোর কাছে চাকরি, বেতন-ভাতা, ব্যবসা বেশি প্রাধান্য পেয়ে থাকে। তেমনি শরণার্থী সমস্যার সমাধানে তাদের নির্লিপ্ততাও সমধিক দৃশ্যমান। ফলে দেশের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবস্থাও যে সত্তর দশক ধরে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতিহীন ফিলিস্তিনিদের মত হবে না কিংবা এশিয়া অঞ্চলে আরেকটি ‘ফিলিস্তিন সঙ্কট’ দেখা দেবে না- সে আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না।