রোহিঙ্গা নেতা মহিবুল্লাহ হত্যাকান্ড সংকট প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ!

8

 

২০১৭ সালে মহিবুল্লাহ তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্মম নির্যাতন থেকে রক্ষা পেতে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন স্কুল শিক্ষক, শিক্ষিত লোক হিসেবে তাঁর নিজের রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের দুঃখ দুর্দশার কথা মানুষের কাছে তুলে ধরার উপযুক্ততা ছিল প্রশ্নাতীত। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বর্বরতা থেকে আপাতত রক্ষা পেয়ে তিনি বাংলাদেশে এসে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের প্রয়াস শুরু করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় সেপ্টেম্বর ২৯ তারিখ সন্ধ্যায় তিনি আততায়ীর গুলিতে কক্সবাজারের কুতুপালং ক্যাম্পে মৃত্যুবরণ করেন। যখন তিনি ক্যাম্পসংলগ্ন তাঁর অফিসে লোকের সাথে কথা বলছিলেন। তখন একেবারে কাছে থেকেই তাকে গুলি করা হয়, সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। মুহিবের পরিবারের সদস্যরা এ হত্যার জন্য রোহিঙ্গা সেলভেশন আর্মিকে (ARSA)দায়ী করেন। মুহিবের ভাই বলেছেন, তাঁর ভাইকে কিছুদিন ধরে অহরহ টেলিফোনের মাধ্যমে হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। তাঁর বদ্ধমূল ধারণা তারাই এ হত্যার জন্য দায়ী। কিন্তু কেন মুহিবকে টার্গেট করা হলো?
মুহিব বাংলাদেশে আসার পর থেকে একাগ্রচিত্তে রোহিঙ্গাদের স্বার্থে কাজ করে যাচ্ছিলেন। গুলির আঘাতে তাঁর মৃত্যু হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি সে কাজেই নিয়োজিত ছিলেন। সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো তিনি শুধু বাংলাদেশে প্রয়াস চালান নাই। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রোহিঙ্গা তুলে ধরতে আশ্চর্যজনকভাবে সফল হয়েছিলেন। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গাদের উপর অমানবিক অত্যাচার এবং আচরণের কথা সফলতার সহিত তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রোহিঙ্গাদের দুঃখ দুর্দশার কথা জানার জন্য যথেষ্ট সময় দিয়েছিলেন। মহিবুল্লাহ ARSPH(Arakan Rohingya Society For Peace And Human Rights) নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন।
মহিবুল্লাহ চেয়েছিলাম রোহিঙ্গা সমস্যার একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান। হয়তো তাঁর শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ অনেকেরই পছন্দ ছিল না। তন্মধ্যে সংশ্লিষ্টদের ধারণা হলো যেহেতু ARSA (The Arakan Rohingya Salvation Army) মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করার জন্য অস্ত্রের দ্বারা সন্ত্রাসী হামলার বিকল্প কিছু আছে বলে মনে করেন না। সে জন্য সংশ্লিষ্টদের ধারণা অজঝঅ ই মহিবুল্লাহকে হত্যার জন্য দায়ী। কারণ এর আগেও ৫ জন রোহিঙ্গাকে একই কারণে অজঝঅ অপহরণ করেছিল। নূর খাঁন নামে এক নেতৃস্থানীয় রোহিঙ্গাকে এই ব্যাপারে Limbo সংগঠন হুঁশিয়ার করে দিয়েছিল। মহিবুল্লার হত্যার ঘটনায় আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচিলেট ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সেক্রেটারি এই হত্যার সাথে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার জন্য এই হত্যার স্বচ্ছ তদন্ত দাবি করেছেন। হত্যাকান্ডের পরপরই সাধারণ রোহিঙ্গারা যে কথাটি বলেছেন তা বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগজনক। রোহিঙ্গারা এই হত্যার পরই প্রকাশ্যে বলেছেন দীর্ঘদিন ধরে শিবিরগুলিতে দাপট দেখানো সশস্ত্র সন্ত্রাসীগোষ্ঠী আল ইয়াকিন আমাদের নেতা মহিবুল্লাকে হত্যা করে থাকতে পারে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আল ইয়াকিনসহ একাধিক সন্ত্রাসী গ্রুপ রয়েছে। সন্ত্রাসী গোষ্ঠিগুলি ফিরে যেতে চায় না। বরং মিয়ানমারে ফেরার পক্ষে কথা বললে তাদের উপর হামলা চালায়। নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা যায়, সশস্ত্র রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী মুহিবুল্লাহকে নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করে আসছিল। অবশেষে ব্যর্থ হয়ে তাঁকে চিরবিদায়ের ব্যবস্থা করেছে। আর ও অনেক কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলিতে অহরহ সন্ত্রাসী কর্মকান্ড অব্যাহত রয়েছে। ২০২০ সালে বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়েছিল এবং প্রায় ৭ জন রোহিঙ্গার মৃত্যু ঘটেছিল। পরে জানা গেল ড্রাগ চোরাচালানকারী রোহিঙ্গাদের মধ্যে এই দাঙ্গা ঘটেছিল। কারও কারও ধারণা মুহিবের দেশে বিদেশে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা এবং জনপ্রিয়তার কারণে ঈর্ষান্বিত হয়ে এই হত্যাকান্ড ঘটনো হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো যদি অজঝঅ নামের সন্ত্রাসীরা মুহিবুল্লাহ হত্যার ঘটনাটি ঘটিয়ে থাকে এবং তাও অনেক মানুষের সামনে। যদি সত্য হয় সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারকে নিরাপত্তার কৌশলটাই সম্পূর্ণ ঢেলে সাজাতে হবে। ইয়াকিনের উপস্থিতি যদি সত্যি হয় তাহলে এটি শুধু রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার ব্যাপার হবে না, সেক্ষেত্রে হবে বাংলাদেশের নিরাপত্তা সঙ্কটের ব্যাপার। জানা যায় মহিবুল্লাহকে চার বা পাঁচ জন লোকগুলি চালিয়েছিল। এতগুলি লোক বেশকিছু সময় গুলি চালিয়ে বিনা বাধায় চলে যেতে পারল তা কিন্তু আমাদের সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তারক্ষীদের অযোগ্যতায় বলতে হবে। যাই হউক, বাংলাদেশ সরকারের এই পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলির নিরাপত্তা সম্পূর্ণভাবে ঢেলে সাজাতে হবে। একথা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই যে রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে আমরা আমাদের কথিত বন্ধু ভারত, চীন, রাশিয়ার সমর্থন আদায় করতে ব্যর্থ হয়েছি। অথচ এই তিন দেশের সমর্থনে আমাদের জন্য এই মুহূর্তে জরুরি।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় সমর্থনের পরিবর্তে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সভায় আমাদের পক্ষের প্রস্তাবকে বারবার প্রত্যাখ্যান করে ভেটো দিয়ে চলেছে।কাজেই রোহিঙ্গারা নরকের সীমানায় ঘুরছে (খরসনড়)। তাদের কোথাও যাওয়ার পথ নেই। অথচ রাশিয়া এবং চীন বিশ্বের উৎপীড়িতদের নেতা। তাদের ভোটের ফলে রোহিঙ্গাদের এমন অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছে যে তাদের কোন পরিচয় বা জাতীয় সত্তা নেই। সারা বিশ্বে তাদের প্রতি কার ও সহানুভূতি আছে বলে মনে হয় না।
রোহিঙ্গাদের এই দুর্দিনে জাতিসংঘ এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টসহ আরও অনেক উচ্চস্তরের বিশ্ব নেতৃবৃন্দ একমাত্র রোহিঙ্গা নেতা মহিবুল্লাই রোহিঙ্গাদের দুঃখ দুর্দশার কথা পৌঁছিয়ে দিতে পেরেছিলেন। তিনি তাঁর যুক্তরাষ্ট্র সফরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টসহ বিভিন্ন উচ্চস্তরে বলেছিলেন, ‘For decades we faced systematic genocide in Myanmar.They took away our citizenship, they took away our land.They destroyed our mosques.No travel, no higher education,no health care, no jobs….. we are stateless. Stop calling us that.We have a state. It is Myanmar’. দশকের পর দশক ধরে মিয়ানমারে আমাদের উপর পরিকল্পিত গণহত্যা চলছে। তারা আমাদের জমি এবং নাগরিকত্ব হরণ করেছে। আমাদের মসজিদগুলি ধ্বংস করেছে, সফর করা, উচ্চশিক্ষা লাভ করা, স্বাস্থ্যসেবা এবং চাকুরি ইত্যাদি আমাদের জন্য বন্ধ। আমরা রাষ্ট্রহীন। আমাদেরও একটি রাষ্ট্র আছে। রাষ্ট্রটির নাম মিয়ানমার।
লেখক: কলামিস্ট