রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধ বৃদ্ধি প্রত্যাবর্তনের মধ্যেই রয়েছে সমাধান

10

 

বছরজুড়ে আলোচনার বিষয় ছিল আশ্রিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান হারে অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধির ব্যাপারটি। স্থানীয় প্রশাসন ও জনগণকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন সংগঠনের অপতৎপরতা, অস্ত্র ব্যবসা, সন্ত্রাসী কর্মকান্ড এবং মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন সামাজিক অপরাধের কারণে। শুধু তা নয়, প্রশাসনের অগোচরে ক্যাম্পগুলোয় বিভিন্ন ধরনের কমিটি গঠনের কথাও গণমাধ্যমে এসেছে। ফলে সেখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে চলছে অনেকদিন ধরে। অতি সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংঘটিত বেশকিছু হত্যাকান্ড তেমনটি গুরুত্ব না পেলেও গত বুধবার রাতে রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার মুহিব্বুল্লাহকে একদল মুখোশ পরিহিত সন্ত্রাসী প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার মাধ্যমে ক্যাম্পগুলোর নিরাপত্তা এবং রোহিঙ্গাদের অপরাধপ্রবণতা নিয়ে নতুন করে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ক্যাম্প ও ক্যাম্পের বাইরে স্থানীয় জনগণের মধ্যে উৎকণ্ঠা বেড়েছে। স্থানীয় প্রশাসন বলছে, অপরাধীদের গ্রেফতারে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। আমরা আশা করি, ক্যাম্প ও স্থানীয় জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী শুরু থেকেই বাংলাদেশের জন্য মূর্তিমান সমস্যা হিসেবে বিরাজ করছে। দুশ্চিন্তার বিষয় হল, এ সংকট চার বছর পেরিয়ে পঞ্চম বছরে পদার্পণ করলেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কোনোরকম অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না; বরং আশ্রয় শিবিরগুলোকে তারা বিভিন্ন অপরাধের আখড়ায় পরিণত করেছে। জানা গেছে, ১১ লাখের অধিক রোহিঙ্গা অধ্যুষিত ৩৪টি আশ্রয় শিবির নিয়ন্ত্রণ করছে অন্তত ৩২টি সন্ত্রাসী দল ও উপদল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে গত চার বছরে নিহত হয়েছে ৫৩ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী। ২০১৭ সালে মামলা হয়েছে ৭৬টি, যেখানে আসামির সংখ্যা ছিল কয়েকশ। ২০১৮ সালে ২০৮টি মামলায় আসামি করা হয় ৪১৪ জনকে। ২০১৯ সালে মামলার সংখ্যা ছিল ২৬৩ আর আসামি ৬৪৯ জন। চলতি বছরের শুরু থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২০০ মামলা হয়েছে; যেসব মামলায় আসামির সংখ্যা অন্তত ৫০০।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির কথিত গণতান্ত্রিক সরকারের ছত্রছায়ায় সেনা অভিযান শুরু হলে সংখ্যালঘু এ মুসলিম জনগোষ্ঠীর সাত লাখেরও বেশি মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এর আগে গত কয়েক দশকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছে আরও চার লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। অবৈধ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের কারণে আমাদের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় আর্থ-সামাজিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটছে। অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে বিদেশ গিয়ে নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে এবং এর দায়ভার বর্তাচ্ছে বাংলাদেশের ওপর। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার বাসস্থান ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সরকারকে। সরকার ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের একাংশকে নোয়াখালীর ভাসানচরে স্থানান্তর করেছে। সেখানে উন্নত বাসস্থান ও যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ স্বকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে আমরা মনে করি, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের মধ্যেই যাবতীয় সমস্যার সমাধান নিহিত রয়েছে। রোহিঙ্গা সংকটের জরুরি সমাধানের লক্ষ্যে গত বছর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের রেজুলেশন গৃহীত হয়েছে, যার প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল- বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের মধ্যেই সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান রয়েছে। উল্লেখ্য, ওআইসি ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যৌথভাবে এ রেজুলেশন উত্থাপন করেছে, যাতে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেছে ১০৪টি দেশ। এবারও রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরত বিষয়ে জাতিসংঘের উচ্চ পর্যায়ে ব্যাপক আলোচনা এবং সাধারণ পরিষদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া ভাষণ ও প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় শিবিরে দীর্ঘস্থায়ী অবস্থান এবং তাদের বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ড শুধু বাংলাদেশ নয়, এ অঞ্চলের জন্য হুমকি হয়ে দাঁডাতে পারে। রোহিঙ্গা নেতা মুহিব্বুল্লাহ হত্যাকান্ডের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর সেই বার্তা সহজেই অনুমান যোগ্য। সূত্র জানায়, মুহিব্বুল্লাহ আন্তর্জাতিকভাবে রোহিঙ্গা নেতা হিসাবে বেশ পরিচিত। তিনি সন্মান ও নাগরিকত্ব মর্যাদা নিয়ে তাদেও নিজ জন্মভূমি মিয়ানমারে ফেরতের পক্ষে কাজ করে আসছিলেন। এ অবস্থায় মুহিব্বুল্লাহর হত্যাকাÐ কী বার্তা দেয়, সেটিও অনুধাবনের সময় এসেছে। বাংলাদেশ সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গঠনমূলক একটি প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে রোহিঙ্গাদের ফেরৎ নিতে মিয়ানমারের ওপর নতুনভাবে চাপ সৃষ্টি করবে, এটাই প্রত্যশা।