রোহিঙ্গা এখন বিষফোঁড়া

21

তুষার দেব

প্রতিবেশি দেশ মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর গণহত্যার মুখে প্রাণ বাঁচাতে দেশের টেকনাফ-উখিয়ার শরণার্থী শিবিরসহ সীমান্তের শূন্যরেখায় আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা এখন কার্যত বিষফোঁড়ায় পরিণত হয়েছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলতে শুরু করেছেন, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীদের কারণে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকির মুখোমুখি হতে চলেছে। আধিপত্য বিস্তারসহ স্বার্থের সংঘাতে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রæপগুলোর অব্যাহত খুনোখুনি, মাদক ও অস্ত্রের কারবারসহ বিভিন্ন কারণে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা এখন দেশের জন্য চরম মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের অপরাধ তৎপরতার ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ নতুন বছরের গত ৩ জানুয়ারি কোস্টগার্ড সদস্যরা কক্সবাজারের টেকনাফের নাফ নদীর খড়ের দ্বীপে দীর্ঘ ৯ ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস অভিযান চালিয়ে ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র, চারশ’ ৮৬ রাউন্ড গোলাবারুদ ও মাদকদ্রব্যসহ ছয় রোহিঙ্গা ডাকাতকে গ্রেপ্তার করেছে। কোস্টগার্ড টেকনাফ স্টেশনের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মো. মহিউদ্দিন জামান জানান, গোপন সূত্রে ফিশিং বোটে সশস্ত্র ডাকাতির তথ্য পেয়ে কোস্টগার্ডের সেন্টমার্টিন ও টেকনাফ স্টেশনের যৌথ দল অভিযান পরিচালনা করে ৬ জন রোহিঙ্গা সশস্ত্র ডাকাতকে গ্রেপ্তার করে। পরে ডাকাত দলের সদস্যদের তথ্যের ভিত্তিতে খড়ের দ্বীপের বনে অভিযান চালিয়ে দুটি বিদেশি পিস্তল, তিনটি একনলা বন্দুক, দুটি এলজি, একটি শটগান, ছটি বিদেশি পিস্তল, চারটি পিস্তলের ম্যাগজিন, চারশ’ ৫০টি তাজা গোলা, ৩৬ টি ফাঁকা গোলা, চারটি রাম দা, ২০ হাজার পিস ইয়াবা, ২১ বোতল বিদেশি মদ, পাঁচশ’ ৫১ ক্যান বিয়ার, সাত সেট ডাকাতি কাজে ব্যবহৃত পোশাক, একটি হ্যান্ডকাপ, একটি ল্যান্ড ফোন ও চারটি বাটন মোবাইল জব্দ করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন, রেজিস্ট্রার্ড রোহিঙ্গা ক্যাম্প ১৩-এর হোসেন আহমেদের ছেলে মো. ইব্রাহিম (২৩), উনচিপ্রাং রেজিস্ট্রার্ড রোহিঙ্গা ক্যাম্প ২২-এর নুরুল ইসলামের ছেলে মো. আমিন (৩৩), ক্যাম্প ১৩-এর সুলতান আহমেদের ছেলে মো. আরিফ (৩৩), ক্যাম্প ১৩-এর নূর হাকিমের পুত্র মো. মাহমুদুর রহমান (১৮), ক্যাম্প- ২২-এর হাশেমের ছেলে মো. কানিজ (২৪) ও বালুখালী ক্যাম্প ১৪-এর সৈয়দ আহমেদের মো. নবী হোসেন (২৮)।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, মাদক ব্যবসা, চোরাচালান ও আধিপত্য নিয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হত্যাকান্ডের ঘটনা তুলনামূলকভাবে অনেকগুণ বেড়ে গেছে। ক্যাম্পগুলোতে এখন প্রধান চারটিসহ আট থেকে দশটি সন্ত্রাসী গ্রূপ সক্রিয় রয়েছে। তাদের মধ্যে ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ ও মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ব্যাপক দ্ব›দ্ব রয়েছে। আবার রোহিঙ্গারা যে ত্রাণ পায়, তা কারা কিনে বাইরে বিক্রি করবে তা নিয়েও প্রচন্ড বিরোধ রয়েছে। গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে উখিয়ার লাম্বাশিয়া আশ্রয়কেন্দ্রের ডি-ব্লকে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) নামের সংগঠনের কার্যালয়ে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ওই সংগঠনের চেয়ারম্যান মাস্টার মহিবুল্লাহকে গুলি করে হত্যার পর থেকে খুনোখুনি লাগামহীন হয়ে উঠেছে। তিনি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন পক্ষের শীর্ষ নেতা ছিলেন। তাকে হত্যার পর প্রত্যাবাসনবিরোধী গ্রæপগুলো শক্তি সঞ্চয় করেছে। এখন ক্যাম্পে কেউ মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার কথা বললেই তাকে হত্যার জন্য টার্গেট করা হচ্ছে। সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রূপগুলো ভারী অস্ত্র সংগ্রহের পাশাপাশি ক্যাম্পের ভেতরেই অস্ত্র তৈরি করে। তাদের সাথে মিয়ানমারে মাদক এবং অস্ত্র চোরাচালানিদের যোগাযোগ আছে। তাদের সাথে জড়িত রয়েছে কিছু স্থানীয় লোক। ক্যাম্পের অভ্যন্তরে প্রত্যাবাসনবিরোধী সন্ত্রাসীদেরকে গোপনে মিয়ানমার সরকার মদদ দিচ্ছে বলেও অভিযোগ অনেক সাধারণ রোহিঙ্গার।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ২০ আগস্ট পর্যন্ত পাঁচ বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১২ ধরনের অপরাধে মোট দুই হাজার চারশ’ ৩৮টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় মোট আসামির সংখ্যা পাঁচ হাজার দুইশ’ ২৬ জন। এই পাঁচ বছরে অস্ত্র জব্দের ঘটনায় একশ’ ৮৫টি, মাদক জব্দের ঘটনায় এক হাজার ছয়শ’ ৩৬টি, ধর্ষণের অভিযোগে ৮৮টি, অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায় বা আদায়ের চেষ্টার অভিযোগে ৩৯টি মামলা হয়েছে। পাঁচ বছরে হত্যাকাÐ সংঘটিত হয়েছে একশ’ ১০টি। এসব খুনের ঘটনায় একশ’ আর হত্যা মামলা হয়েছে। এর মধ্যে জোড়া খুনের ঘটনা ঘটেছে ছয়টি। খুনোখুনি ছাড়াও আরও যেসব অপরাধে মামলা হয়েছে তার মধ্যে আছে অস্ত্র, মাদক, ধর্ষণ, অপহরণ, বিশেষ ক্ষমতা আইন, ডাকাতি বা ডাকাতির প্রস্তুতি, মানব পাচারসহ ১২ ধরনের অপরাধ। এর মধ্যে চলতি বছরের গত আগস্ট পর্যন্ত মাত্র এক বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১২ ধরনের অপরাধে মামলা হয়েছে এক হাজার একশ’ ৪০টি। এই সময়ে অস্ত্র জব্দের ঘটনায় ৯৮টি, মাদক জব্দের ঘটনায় আটশ’৭৪টি, ধর্ষণের অভিযোগে ২৩টি এবং খুনের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৩০টি। তার মানে সর্বশেষ এক বছরে বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় মামলার সংখ্যা তুলনামূলভাবে অনেক বেশি।
কক্সবাজার নাগরিক আন্দোলনের সদস্যসচিব এইচ এম নজরুল ইসলাম পূর্বদেশকে বলেন, রোহিঙ্গাদের কারণে কক্সবাজার অঞ্চলের লোকরাই এখন নিজভূমে পরবাসী হওয়ার উপক্রম হয়েছে। প্রত্যাবাসনের মধ্যেই রোহিঙ্গা সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ সমাধান নিহিত। কিন্তু গত পাঁচ বছরেরও বেশি সময়ে প্রত্যাবাসন নিয়ে দৃশ্যমান কোনও অগ্রগতিই পরিলক্ষিত হয়নি। উল্টো দিন দিন সেটা যেন জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে। রোহিঙ্গারা এখন বিষফোঁড়া হয়ে উঠেছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম পূর্বদেশকে বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বিলম্বিত করতেই ক্যাম্পে একের পর এক হত্যাকান্ড সংঘটিত করছে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। মহিবুল্লাহ হত্যাকাÐের পর রোহিঙ্গাদের মাঝে নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হওয়ায় সেটা নস্যাৎ করতেই পরিকল্পিতভাবে ক্যাম্পে নতুন করে আতঙ্ক ও অরাজকতা তৈরি করা হচ্ছে। আমার ধারণা, মিয়ানমার সরকারই ক্যাম্পের কয়েকটি রোহিঙ্গা গোষ্ঠীকে সহযোগিতা ও উস্কানি দিয়ে খুনোখুনিসহ নানা অপরাধ অব্যাহত রেখেছে। তারা বিশ্ববাসীকে দেখাতে চায় রোহিঙ্গারা সন্ত্রাসী। ক্যাম্পের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে অদূর ভবিষ্যতে তা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। রোহিঙ্গা পরিস্থিতি এরইমধ্যে নাজুক অবস্থায় গিয়ে ঠেকেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর অব্যাহত হামলার মুখে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয় লাখ লাখ রোহিঙ্গা। এরপর থেকে রোহিঙ্গাদের দেখাশোনা করছে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন। এর মধ্যে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪ টি ক্যাম্পে বর্তমানে ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে। এর বাইরে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়েছে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা। শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে ক্যাম্প ইনচার্জ হিসেবে একজন করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ক্যাম্পগুলোর নিরাপত্তা ও আইন শৃংখলা রক্ষার জন্য তিন ব্যাটেলিয়ন আর্মড পুলিশ বা এপিবিএন সদস্যদের নিযুক্ত করা হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, প্রতিদিন শরণার্থী ক্যাম্প থেকে শত শত রোহিঙ্গা বাইরে বেরিয়ে এসে কক্সবাজার জেলার স্থানীয় লোকজনের সাথে মিশে যাচ্ছে। তাদের অনেকেই কক্সবাজার অঞ্চলে মাটি কাটার কাজ, প্যাডেল রিকশা, টমটম, সিএনজি অটোরিকশা চালানো ও সাগরে মাছ ধরার ট্রলারে শ্রমিকের কাজ করছে। আবার অনেকে মাদক পাচার, ডাকাতি, ছিনতাই খুনোখুনির মত অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছে। রোহিঙ্গাদের অপরাধমূলক কর্মকান্ড উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে। তাদের নিয়ন্ত্রণে রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাদের অনেকে ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র পর্যন্ত বানিয়ে ফেলছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা নানা অপরাধ কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে তাদের সুনির্দিষ্ট কোনও পরিচয়পত্র বা ফিঙ্গারপ্রিট নেই। তাই ভয়ঙ্কর অপরাধ করলেও তাদের শনাক্ত করা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে একপ্রকার কঠিন। অথচ তারা শরণার্থী হিসেবে ক্যাম্পে সমস্ত সুযোগ-সুবিধাও ভোগ করছে।