রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য ভাসানচর নিরাপদ : গবেষণা

16

আধুনিক সুযোগ-সুবিধা, আশ্রয়ন প্রকল্পের সহনীয়তা, দুযোর্গ নিরাপত্তা ব্যবস্থা, জীবিকা ও মানবাধিকারসহ বিভিন্ন দিক বিবেচনায় নোয়াখালীর ভাসানচর রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য নিরাপদ বলে দাবি করেছেন একদল গবেষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের একদল শিক্ষক পরিচালিত ‘বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে স্থানান্তর: সুবিধা এবং প্রতিকূলতা’ শীর্ষক এক গবেষণায় বরাতে এ দাবি করা হয়েছে।
গতকাল শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট আয়োজিত এক সেমিনারে গবেষণার এই ফলাফল তুলে ধরা হয়। মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির ও তার বাইরে অবস্থান নিয়ে থাকা প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে নিয়ে নানা সামাজিক সমস্যা সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে তাদের একটি অংশকে হাতিয়ার কাছে মেঘনা মোহনার বিরান দ্বীপ ভাসান চরে স্থানান্তরের এই পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। খবর বিডিনিউজের
সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে ২৩১২ কোটি টাকা ব্যয়ে মোটামুটি ১০ হাজার একর আয়তনের ওই চরে এক লাখের বেশি মানুষের বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে পাঁচ দফায় মোট ১২ হাজার ২৮৪ জন রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়েছে।
তবে ভাসানচরে বসবাসের উপযোগিতা নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে নানা প্রশ্ন উঠে। এসব প্রশ্নের ভিত্তিতে সেন্ট্রাল ফাউন্ডেশন ফর ইন্টারন্যাশনাল এন্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ (সিএফআইএসএস) এর অর্থায়নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের গবেষক দল গত নভেম্বর থেকে ফেব্রূয়ারি কয়েক দফায় কক্সবাজার ও ভাসানচরের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গিয়ে এ গবেষণা পরিচালিত করেন। এছাড়া ভাসানচরের আশ্রয়ন প্রকল্পের সহনীয়তা ও বসবাসযোগ্যতার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ প্যানেল নিয়ে ভাসানচর পরিদর্শন ও তাদের মতামত নেওয়া হয়।
কক্সবাজার ও ভাসানচরের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাসযোগ্যতার তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণার অত্যন্ত প্রচলিত গুণগত পদ্ধতি অবলম্বন করে গবেষণা কার্যটি পরিচালনা করা হয়।
সেমিনারে ফলাফল তুলে ধরে গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম বলেন, ভাসানচর বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের জন্য অনেক বেশি নিরাপদ একটি জায়গা। দ্বীপটিতে আধুনিক সকল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা হয়েছে, আয়-রোজগারের ব্যবস্থা করা হয়েছে, উন্নত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, মূল ভূখন্ড থেকে দ্বীপটিতে যাতায়াতের ভাল ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং মানবাধিকারের নিশ্চয়তা সুনিশ্চিত করা হয়েছে।
তবে ভাসনচর দ্বীপটিকে আরও টেকসই করে তোলার লক্ষ্যে পানির সঙ্কট এড়াতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও দৈনন্দিন কাজে এ পানি বেশি করে ব্যবহারের প্রতি জোর দেন তিনি।
রোহিঙ্গা ছেলে মেয়েদেরকে তাদের নিজ ভাষায় পাঠদান এবং রোহিঙ্গাদেরকে নিজস্ব সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ পালন করার ব্যবস্থার করতে হবে। সুপারিশে কিছু ক্ষুদ্র কুটিরশিল্প স্থাপন করার কথাও তুলে ধরা হয়েছে, যাতে করে দরিদ্র রোহিঙ্গারা তাদের আয়ের ক্ষেত্রে আরো বৈচিত্র্য আনতে পারে।
সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, ২০১৭-১৮ সালের ইউএনএইচসিআর ও আমার বিভাগ একটি গবেষণা করেছিল তাতে দেখা যায় যে, রোহিঙ্গারা কক্সবাজারে যে সব জায়তগায় রয়েছে তাতে যে কোন সময় পাহার ধস ও ভূমি ধসের কারণে লক্ষাধিকেরও বেশি মানুষ বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে।
তবে এখন সামাজিক, শারীরিক ও অবকাঠামোগতসহ সকল দৃষ্টিকোণ থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য ভাসানচর তাদের নিজেদের দেশের থেকেও নিরাপদ।
গবেষণায় বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্য সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তারা জীবিকার জন্য কিছু ক্যাশ টাকা পাচ্ছে। কিন্তু ভাসানচরে ক্যাশ টাকার পরিবর্তে তারা হাউজিং, রেশন, খাদ্য, চিকিৎসা ও শিক্ষাসহ সব ধরনের সুবিধা পাচ্ছে, যার কারণে ইয়াং কাপলরা কিন্তু ভাসানচরে যেতে বেশি আগ্রহী হচ্ছে।
গত দুই বছরে ৮০ হাজার রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নিয়েছে। তারা তাদের ছেলে মেয়েদের শিক্ষিত করতে চায়। যে সুযোগটা কক্সবাজারে নাই, সেটা তারা ভাসানচরে পাচ্ছে। তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ করে দিতে হবে।
সেমিনারে সিএফআইএসএসের চেয়ারম্যান কমোডর এম নুরুল আবছার (অব.) বলেন, বাংলাদেশ রোহিঙ্গা জনগণের থাকার জন্য সাহস দেখিয়েছে। লক্ষণীয় বিষয়, কক্সবাজার অঞ্চলে রোহিঙ্গার এত বিশাল জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি অবশ্যই হিউম্যান ট্র্যাফিকিং, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান, আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও জীবন-জীবিকার মতো একাধিক হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার কক্সবাজারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর একটি অংশকে অস্থায়ীভাবে ভাসানচরে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করছে, যাতে তারা নিরাপদ ও সুখী জীবনযাপন করতে পারে। দুর্ভাগ্যক্রমে জীবিকা, আবাসন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদির টেকসইতার দিক দিয়ে ভাসানচরকে অতিরঞ্জিত ও নেতিবাচক প্রচার চালানো হয়েছে। কিন্তু আমাদের গবেষণায় ভাসানচর বাংলাদেশের অন্যান্য দ্বীপের তুলনায় বসবাসের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ বলে উঠে এসেছে।
সেমিনারে বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেনও বক্তব্য দেন। গবেষক দলে শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যায়ন বিভাগের বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মো. তৌহিদুল ইসলাম, একই বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ শাহীনুল আলম ও মারিয়া হোসাইন সদস্য হিসেবে ছিলেন।