রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনই সমাধান

40

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে পাহাড় কেটে বন ধ্বংস করে একের পর এক রোহিঙ্গা শিবির গড়ে তোলা হয়েছে। যে এলাকায় রোহিঙ্গা শিবিরগুলো গড়ে উঠেছে, সেখানে ছিল সবুজ অরণ্যেঘেরা উঁচু উঁচু পাহাড়। যেখানে ছিল বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর বসতি। বিশাল এলাকা ছিল জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। রোহিঙ্গাদের বসতি স্থাপন ও জ্বালানির জন্য ইতোমধ্যে উজাড় হয়েছে ৬ হাজার একরের বেশি বনভূমি। প্রতিনিয়ত ধ্বংস হচ্ছে কৃষিজমি ও পাহাড়। এমন পরিস্থিতিতে শুরু হয়েছে মৌসুমী বৃষ্টি। টানা বৃষ্টিতে পাহাড়ের ঢালে গড়ে উঠা কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয় শিবির ঘিরে২৫ হাজার পরিবারের দেড়লাখের বেশি রোহিঙ্গা দিন কাটাচ্ছে পাহাড়ধস ও বন্যার ঝুঁকিতে। উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গত পাঁচদিনে শিশুসহ ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন অন্তত ২০ জন। ক্ষতিগ্রস্ত তালিকায় ওঠে এসেছে ৩ হাজারের বেশি বাড়ি। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম এর হিসাব মতে, পাঁচদিনের ভারী বৃষ্টি এবং ঝড়ো হাওয়ায় উখিয়া-টেকনাফে ভূমিধসে এক হাজার ১৮৬টি, বন্যায় ২১৬টি এবং ঝড়ো হাওয়ায় এক হাজার ৮৪০টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ক্ষতির মুখে পড়েছেন ১৫ হাজার ৫৩৪ জন রোহিঙ্গা। এছাড়াও ক্যাম্পগুলোতে ৩৯১টি ভূমিধসের পাশাপাশি ঝড়ো হাওয়া বয়ে গেছে ৫১ বার। সংস্থাটি বলছে এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ২০১৮ সালের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছাড়িয়েছে।
কক্সবাজারের টেকনাফে প্রায় ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বসবাস। এখানের পরিবেশ এখন হুমকির মুখে। পাহাড় ও গাছ কেটে ফেলায় বন্যহাতির আবাসস্থল হারিয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে রাতের আধারে রোহিঙ্গা শিবিরে হানা দেয় বন্যহাতি। হাতির আক্রমণে একাধিক রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। পরিবেশ বিপর্যয়ের পর এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হানা দিয়েছে রোহিঙ্গা শিবিরে। এ দুর্যোগ রোহিঙ্গাদের যেমন বিপর্যস্ত করছে তেমনি বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য হারিয়ে যেতে বসেছে। এ অবস্থায় সপ্তাহে রাজধানীর একটি হোটেলে ‘ঢাকা মিটিং অব দ্য গ্লোবাল কমিশন অন অ্যাডাপ্টেশন’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিস্থিতি অনুধাবন করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের অতি দ্রুততার সঙ্গে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করে বলেছেন, মিয়ানমারের ১১ লাখ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছি। কিন্তু এর ফলে আমাদের ওই অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। সেখানে পাহাড়ি এলাকায় জঙ্গল কেটে বসতি হচ্ছে। ফলে ওই এলাকা অনিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আমরা চাই, তারা যত দ্রুত সম্ভব নিজের দেশে ফিরে যাক। সেটা বাংলাদেশের জন্য মঙ্গল হবে। আমরা মনে করি, রোহিঙ্গা শিবির স্থাপনের কারণে বন ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের দায় শুধু বাংলাদেশের একার নয়। গোটা বিশ্বকেই এ ক্ষতিপূরণ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের সঙ্গে শামিল হয়ে কাজ করতে হবে। আশার বিষয়, বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে চীন দেশটির সরকারকে সম্মত করতে চেষ্টা করবে বলে আশ্বস্ত করেছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরকালে বাংলাদেশ ও চীনের প্রধানমন্ত্রী মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে চীন এ আশ্বাস দিয়েছে। এ বিষয়টি আমাদের আশাবাদী করে। চীনের এ আশ্বাসের বাস্তবায়ন আমরা দেখতে চাই।
অতীতে দেখেছি, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বরাবরই গড়িমসি করেছে। রোহিঙ্গারা তাদের নিরাপত্তাজনিত ভয়-ভীতির কারণে মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায় না। রোহিঙ্গা সংকটের কারণে দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিঘিœত হচ্ছে। যতই সময় যাবে এ সমস্যা ততই বড় আকার ধারণ করবে। এই উদ্ভূত পরিস্থিতির পরও বাংলাদেশ সরকার যে ধৈর্য, সহনশীলতা, উদারতা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে তা প্রশংসনীয়।
একথা বলার আর প্রয়োজন পড়ে না যে, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বহুমাত্রিক ঝুঁকিতে পড়েছে বাংলাদেশ। আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যাসহ বাড়ছে নিরাপত্তা ঝুঁকি। এসব সমস্যার মোকাবেলা করা এখন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে রোহিঙ্গাদের পাহাড় থেকে সরিয়ে আনা প্রধান কাজ। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমিতে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে কাজ চালিয়ে যেতে হবে।
আমরা চাই, দ্রæত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হোক। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার পাশাপাশি সে দেশে তাদের নিরাপদ বসবাসের পরিবেশ ও নাগরিক মর্যাদা নিশ্চিত হওয়ার বিষয়টিও জরুরি।
সম্প্রতি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রধানত রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের মানসে চিন সফরে গিয়েছিলেন। চিনের প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট গতানুগতিকভাবে বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত নেয়ার জন্য মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার কথা জানিয়েছেন। সময়ই বলে দিবে কি ধরনের চাপ এবং কত মাপের চাপ চিন মিয়ানমারকে দিতে পারবে।
আমাদের দেশে লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানের (মিয়ানমারের নাগরিক) জাতিসংঘের একজন মুখপাত্র বলেছিলেন, ‘ইটস অ্যান ইনডাইরেক্ট অ্যাটাক অন বাংলাদেশ। রোহিঙ্গা আসা ব্যাপারটা নতুন নয়। অনেক বছর আগে থেকেই তারা আসছে এবং আসতে বাধ্য হচ্ছে। তবে এখনকার প্রায় ১২ লক্ষ শরনার্থী সমস্যাটা গোটা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে। নাগরিকত্ববিহীন নিরস্ত্র অসহায় একটা মানবগোষ্ঠীর নিপীড়িত ও নিরুপায় হয়ে দেশত্যাগ বিশ্ব মেনে নিতে পারছে না। প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে শান্তিকামী বিশ্ববাসী। উন্নত বিশ্বের দায়িত্বশীল সরকারগুলো। জাতিসংঘ, ইইউ, মানবাধিকার সংস্থা, নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তরাও নিন্দা ও ধিক্কার দিচ্ছেন অং সান সুচি ও তার নেপথ্যের সামরিক জান্তাকে। গণতন্ত্রের ছদ্মাবরনে গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট চালিয়ে যাচ্ছে মিয়ানমার সরকার। একটি দেশের সরকার যদি তার জনগণকে রক্ষার বদলে গণহত্যা করতে থাকে তাহলে কে পারবে নাগরিকদের বাঁচাতে ?
খুবই উদ্বেগজনক ব্যাপার হলো বার্মার বৌদ্ধ নাগরিকরাও সেনাবাহিনীর সাথে হাত মিলিয়ে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালিয়েছে। বৃদ্ধ নারী, শিশু কাউকেই এরা বাদ দিচ্ছে না নির্যাতন থেকে। এই বৈশ্বিক যুগে মধ্যযুগীয় গণহত্যা আর অত্যাচার করে নিকটস্থ বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া কোনো মতেই মেনে নেয়া যায় না। আরও আশ্চর্যজনক সংবাদ হলো গণচীন নামের অন্যতম বিশ্বশক্তি নজিরবিহীন এই অত্যাচারী সরকারকে অব্যাহত মদদ দিয়ে যাচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে জাতিসংঘে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আনা যেকোনো প্রস্তাবের বিরুদ্ধে চীন ভেটো দিতেই থাকবে। এই কি সমাজতন্ত্রের নীতি ? চীনের আন্তরিক ইচ্ছা থাকলে কয়েক দিনের মধ্যেই মিয়ানমার সরকারকে একটি আদর্শ সভ্য সরকারে পরিণত করার মতো প্রভাব রাখতে পারে।
আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা যায়, এখন মিয়ানমারের হাতে রয়েছে যুদ্ধবিমান-২৬৪টি, সাজোয়া যান ৮৮৬টি, ক্ষেপনাস্ত্র ৪২১২টি, নৌযান- ২৭টি, কামান ৩৯২টি তা ছাড়াও রয়েছে অত্যাধুনিক ড্রোন হেলিকপ্টারসহ হাতে বহনযোগ্য অত্যাধুনিক হালকা অস্ত্র। অতিসম্প্রতি ইসরাইল এবং উত্তর কোরিয়ার কাছ থেকে গোপনে কী পরিমাণ অস্ত্র তারা পেয়েছে তা এখন পর্যন্ত সংবাদমাধ্যমে আসেনি। মিয়ানমারের সরকার, তথা সেনাবাহিনীকে অস্ত্রের সরবরাহকারী দেশের মধ্যে চীন, রাশিয়া, ভারত, ইসরাইল এবং উত্তর কোরিয়া উল্লেখযোগ্য। উত্তর কোরিয়া এবং মিয়ানমারের আচরনের মধ্যে বহু মিল লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মিয়ানমার উত্তর কোরিয়ার মতো জাতিসংঘ, ইইউ, মানবাধিকার সংস্থাসহ কোনো দেশের অনুরোধ কেই পাত্তা দেয় না। এমতাবস্থায় এই প্রশ্নটিই অগ্রাধিকার পায় যে ওদের এই শক্তির মদমত্ততার উৎস কোথায়? মুসলিম জাতির প্রতি চীন এবং রাশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি যে কত নিষ্ঠুর। তা দেশ দু’টির আচরণ থেকে অতি নগ্নভাবে ফুটে উঠেছে। তারা অন্ধভাবে মিয়ানমারকে সমর্থন দিচ্ছে এবং রোহিঙ্গা মুসলিমরা যে অমানবিক দুর্দশায় পতিত হয়েছে সে সম্পর্কে সমবেদনার বহিঃপ্রকাশ তাদের বক্তব্যে নেই। এ দিক দিয়ে ভারত কিছুটা ভিন্ন মনোভাবসম্পন্ন। কারণ তারা মিয়ানমারকে সমর্থন দিলেও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সাহায্য বাংলাদেশে পাঠিয়েছে সময়ের ব্যবধানে ভারত বুঝতে পারবে। মিয়ানমার ভারতের প্রকৃত বন্ধু নয়। বিশ্বমানবতার জাগ্রত বিবেক আমাদের পক্ষে সেই বিবেক আমাদের মূল শক্তি। একটি চৌকস বাহিনী দীর্ঘ দিন মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম নিধন চালিয়ে আসছে। অন্য জাতি-গোষ্ঠীর চেয়ে মুসলিম জাতির জন্মহার বেশি বিধায় ওই বাহিনী এশিয়াকে মুসলিম নিধনের অবাধ অঞ্চল বানিয়েছে। মূল কথা হলো শত তালিম দিলেও তারা উপমহাদেশে মুসলিম নিধন করায় সাফল্য পাবে না। বর্তমানে যতটুকু সাফল্য তার মূল কারণ মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রগুলির মধ্যে অনৈক্য। এই অনৈক্যদূর করে যদি মুসলিম বিশ্বের একতা ও ্ঐক্য ফিরে আসে তাহলে তাদের সাফল্য অবধাবিত। এদিকে বার্মার বৌদ্ধ জাতিকে দীর্ঘ মেয়াদের জন্য টেকসই মৌলবাদী হিসেবে গড়ে তুলে মাঠে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। তিব্বতের নির্বাসিত নেতা দালাই লামা আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘গৌতম বুদ্ধ ফের আবির্ভূত হলে রোহিঙ্গা মুসলিমদের রক্ষা করতেন।’ ‘ওম শান্তি, বিশ্বের সকল মানুষ সুখী হোক’Ñ কথা দুটি বৌদ্ধ ধর্মের মূলনীতি। আজ সেই বুদ্ধের কথিত অনুসারীরাই মানব হত্যা, পাশবিত নির্যাতন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ করে আরাকানকে একটি নরকে পরিণত করেছে। সামরিক জান্তা যে কলঙ্ক লেপন করেছে তা মুছে ফেলা আর সম্ভব হবে না। অদূর ভবিষ্যতে এই নারকীয় হত্যাকান্ডের চরম মূল্যদিতে হবে অত্যাচারী মিয়ানমারকে। আধুনিক গ্লোবাল বিশ্ব একটি গ্রামের মতো, সুখে-দুঃখে সবাইকেই সবার অংশীদার হতে হবে। এশিয়া মহাদেশ মুসলিম-হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ জাতির আবাসভ‚মি। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে মানবজাতি অন্যান্য মহাদেশে বসতি স্থাপন করেছে। বিশ্বকে যদি একটি গ্রাম ধরি, ইউরোপ আমাদের পাশের বাড়ি। উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা আর অস্ট্রেলিয়া বিভিন্ন পাড়া, মহল্লা। সেই পাড়াগুলোতে সব ধর্মের মানুষ মিলেমিশে বাস করে। ওই সব পাড়ার মানুষ এশিয়ার নিকটতম আত্মীয়স্বজন। আমাদের ভাই-বোনেরাই ছড়িয়ে আছে সব মহাদেশে। নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ক্ষমতার অধিকারী পাঁচটি বড় শক্তির ভেটোর আঘাত জাতিসংঘের কোমর ভেঙে দিয়েছে।
আসলে জাতিসংঘকে অকার্যকর বানিয়ে বৃহৎ শক্তিগুলো নিজেদের হীনস্বার্থে বিশ্বকে বসবাসের অযোগ্য বানিয়ে ফেলেছে। বিশ্বে এখন সঠিক নেতৃত্বের শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে মধ্যযুগীয় বর্বরতা শুরু হয়েছে। মিয়ানমারের ঘটনাপ্রবাহ তারই একটি নজির মাত্র। বর্বরতা যত ভয়ংকর হোক না কেন তা মোকাবেলা করা সম্ভব যদি শান্তিকামীরা ঐক্য। দৃঢ়তা ও সামর্থ্যরে প্রমাণ দিতে পারে। আগেই বলেছি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ইস্যুর সংশ্লিষ্ট দেশ চীন সফল করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ দেশটির সাথে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীর। বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ ও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য কয়েক বিলিয়ন ডলারের। অর্থনৈতিক স্বার্থকে ছড়িয়ে রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টি এবার আলোচনায় প্রাধান্য পাওয়ায় বোঝা যায়, বাংলাদেশ এই সংকটে কত বেশি আক্রান্ত হয়েছে। এই সংকট সমাধানে সাহায্য করার বিষয়ে চীনের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে আশ্বাস পাওয়া গেছে বলে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। অপ্রিয় বাস্তবতা হচ্ছে, রোহিঙ্গা সংকট সুরাহার এখনো কোনো লক্ষন দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে কী ? এর মধ্যে মিয়ানমারে থেকে যাওয়া বাকি রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের মাত্রা বেড়েই চলেছে। যেভাবে মিয়ানমার সরকার চলছে তাতে বোঝা যায়। এই সংকট মেটাতে দেশটি কোনো চাপ অনুভব করছে না।
রোহিঙ্গাদের গণহত্যা বিষয়ে তদন্তে নিয়োজিত জাতিসংঘ ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের সদস্য ক্রিস্টোফার সিদোতি রাখাইনে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের ওপর একটি বিশেষ তথ্য প্রকাশ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, রাখাইন প্রদেশে বিভিন্ন বন্দিশিবির ও পাড়ায় রোহিঙ্গাদের ওপর আজো নাৎসি কায়দায় নির্যাতন চালানো হচ্ছে। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইউরোপের বিভিন্ন বন্দিশিবিরে ইহুদিদের ওপর নাৎসি বাহিনী যেভাবে নির্যাতন হচ্ছে। নির্ধারিত স্থান ছাড়া তারা কোথাও যেতে পারে না। জেলেরা মাছ ধরতে পারছে না। শিশুরা যেতে পারছে না স্কুলে। এমনকি হাসপাতালে যেতে ছয়টি প্রশাসনিক বিভাগ থেকে অনুমতি নিতে হয়। রোহিঙ্গারা বিয়ে করা ও সন্তান জন্মদানের মানবিক অধিকার থেকেও অধিকার হারা।
সিদোতি যখন ভয়াবহ প্রতিবেদন প্রকাশ করছেন, তখন মিয়ানমারের ওপর এ বিষয়ে কোনো আন্তর্জাতিক চাপ নেই বলা চলে। বরং বিশ্বশক্তি চীন ও রাশিয়া সরাসরি নিপীড়ক দেশটির পক্ষ নিয়েছে। অর্থনৈতিক ও আঞ্চলিক স্বার্থ বিবেচনায় ভারতও মনে হয় মানবতা নিসর্জন দিয়ে। রয়েছে মিয়ানমারের সাথেই। ইউরোপ ও আমেরিকাও তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। কোনো সরকার যদি হিটলারের কায়দায় কোনো জাতিগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়ন চালায়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার রক্ষায় বিশ্বের সব সভ্য দেশ দেশটির ওপর চাপ প্রয়োগ করাই দায়িত্ব। তখন দেশটি নিশ্চয়ই তার অবস্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য হবে। সেখানে মিয়ানমার, কিভাবে নিশ্চিত থেকে এমন জঘন্য অত্যাচার করে পার পেয়ে যায়। একটি জাতিগোষ্ঠীর ওপর সেটি একটি প্রশ্ন। বাংলাদেশ সর্বোচ্চমহল থেকে অগ্রাধিকার দিয়ে চীনের সাথে ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনা করলেও কার্যত চীনের অবস্থান কতটা পরিবর্তন হবে। সেটি নিশ্চিত নয়, তারা এখনো বিষয়টি ‘দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার মাধ্যমে সমাধান করার ওপর জোর দিচ্ছে। কিন্তু সবাই জানে মিয়ানমার দ্বিপক্ষীয় অঙ্গীকার রক্ষা করেন।
রোহিঙ্গাদের সবচেয়ে বড় অংশটি বাংলাদেশে আশ্রয়ে রয়েছে। এত বিপুল জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিতে গিয়ে বিরাট এলাকা স্থানীয় মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠছে। এটি চাপ সৃষ্টি করছে জাতীয় অর্থনীতির ওপর। দেশের অগ্রগতির জন্য এটি একটি হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে, ব্যাপারটি অযাচিতভাবে বাংলাদেশের ওপর চেপে বসেছে। এ অবস্থায় সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো, আন্তর্জাতিক অঙ্গন বাংলাদেশের ন্যায্য স্বার্থে যথাযথ সাড়া দিচ্ছে না ; যার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের দাবি প্রতিষ্ঠা করা যাবে এবং বাংলাদেশও ১০/১২ লাখের বেশি মানুষের ভারমুক্ত হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট