রোদেলার নতুন দিন

163

রোদেলার ঘুম আসছে না। কাল পহেলা বৈশাখ। মামার সাথে ডি সি হিলে যাবে। বৈশাখী মেলা দেখবে। মা নতুন শাড়ী এনেছে। সাদা জমিনের লাল পাড়। হরেক রকমের নক্সা করা। ছোট ভাই তুর্য। রোদেলা আদর করে ডাকে টুকু। টুকুর জন্য এনেছে লাল পাঞ্জাবী আর সাদা পাজামা।
বন্ধুদের সাথে কথা হয়েছে। সবাই যাবে। খুব মজা হবে। হৈ চৈ হবে। সারাদিন মেলায় ঘুরবে। পান্তা ইলিশ খাবে। রোদেলার ইচ্ছা এবার টুকুকে সাথে নেবে। তাতে আনন্দটা আরও বেশী হবে। টুকুর বয়স দশ। কখনও মেলায় যায়নি। এবার অবশ্যই যাবে। নানা রঙ্গের পোষাক পরা অনেক ছেলে মেয়ে আসবে। দেখলে টুকুর ভালো লাগবে। কিছুটা পরিবর্তনও আসতে পারে।
রোদেলা শাড়ী পরবে। টুকু বার বার দিদির হাত ধরে পাশে বসার ইঙ্গিত করছে। রোদেলা টুকুকে নতুন পোষাক পরিয়ে দিল। দু’জনকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। টুকু শুধু হাসছে। এরই মধ্যে মামা এসে হাজির।
বর্ষবরণ হবে। শোভাযাত্রা হবে। হরেক রকমের লোকজন আসবে। নাচ গান, নাগর দোলা, সার্কাস, যাত্রাপালা, বেলুন আরও কত কি। এটা বাঙালীর প্রাণের উৎসব। ডি সি হিল ঘুরে তারপর সি আর বি শিরিষ তলায় যাবে। ওখানে আর একটা মেলা। কী যে আনন্দ হবে! কত কি ভাবছে রোদেলা।
কাল নববর্ষ। মা টুকুকে ভাত খাইয়ে দিচ্ছে। রোদেলা মার পাশে বসে ভাইকে আদর করছে। রোদেলা মা’কে জিজ্ঞাসা করল-
– মা তুমি কখনও মেলায় গিয়েছ।
– হ্যাঁ মা। কত গিয়েছি। এই ক’দিন আমাদের গ্রাম জুড়ে থাকতো শুধু উৎসবের আনন্দ। আজ চৈত্র সংক্রান্তি। সকালে উঠে ফুল আর নিমপাতা দিয়ে শুরু হতো মালা গাঁথা। তারপর ওগুলো ঘরের সব আসবাবপত্রে লাগানো। কাঁচা হলুদ গায়ে মেখে স্রান করা। আট দশদিন আগে থেকে প্রতিটি ঘরে ঘরে শুরু হতো খই, চিড়া, মুড়ি, মোয়া, নাড়ু তৈরীর উৎসব। বিকালে বটতলায় বসত চৈত্র সংক্রান্তির মেলা। তিনদিন থাকতো। প্রতিদিন মেলায় গিয়ে নাগরদোলা চড়তাম।
– এবার মামা বলেছে আমাকেও নাগরদোলা চড়াবে।
– ঠিক আছে। এবার ঘুমিয়ে পর। কাল সকালে উঠতে হবে।
রোদেলা শুয়ে শুয়ে ভাবছে। ভাইটা গেলে মা’ও যাবে। সাথে ছোট মাসিও যাবে। খুব মজা হবে। সুন্দর ভাবনাগুলো স্বপ্ন হয়ে রোদেলার চোখে নামে। মেলায় ঢুকার আগে টুকুর দু’গালে সুন্দর করে শুভ নববর্ষ ও একতারা এঁকে দিয়েছে একজন শিল্পি। মেলায় এত লোকের মধ্যে টুকুকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। কখনও মাকে বলছে-মা এটা কিনব, ওটা কিনব। কখনও মামা মাসীর কাছে বায়না ধরছে। টুকুকে ধরে রাখা যাচ্ছে না। এত লোকের ভীড়ে রোদেলার ভীষন ভয় হচ্ছে। মেলার এক পাশে নাগরদোলা। মামা টুকু আর রোদেলাকে নিয়ে নাগড়দোলা চড়ছে। তারপর বলল-এবার ঘোড়ায় চড়ব। দু’টো গ্যাস বেলুন নিল। সবাই মিলে মুড়ি বাতাসা খেল। মেলার একপাশে ইয়া বড় একটা ঘোড়া। পাশে একজন বয়স্ক লোক মাথায় লাল কাপড় বেঁধে ডুগড়ি বাজিয়ে টকি সিনেমা দেখাচ্ছে। টুকু দৌড়ে গিয়ে বাক্সের মধ্যে চোখ লাগিয়ে দিল। তারপর কেবল হা হা করে হাসছে তো হাসছে। আর বলছে এ আবার কি সিনেমা। এর চেয়ে টেলিভিশনে ডোরেমন, পাওয়ার রেঞ্জার, মোটু পাতলু দেখা অনেক ভালো।
নজরুল স্কোয়ার। অনেক বড় স্টেজ। কত রকমের নাচ গান হচ্ছে। জারি, সরি, ভাটিয়ারি, পল্লীগীতি, ভাওয়াইয়া। টুকু সেখানে গিয়ে নাচছে, হাসছে, খেলছে। সবার সাথে কথা বলছে। এটা না ওটা, ওটা না এটা, এই করে করে অনেকগুলো খেলনা, ভেপুঁ বাঁশি কিনেছে। সবচাইতে বেশী ভালো লেগেছে একটা বাঁশের বাঁশি।
টুকুকে মেলায় এভাবে হাসি আনন্দ, হৈচৈ আর কথা বলতে দেখে সবাই ভীষণ খুশি। বাঁশির সুরটা কানে বাজতেই রোদেলার ঘুম ভেঙে যায়।সকালের কড়া রোদটা চোখে লাগছে। ব্যালকনিতে এসে দাড়ায় রোদেলা। টুকু উঠেছে আরও আগে। রোদেলা জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিল, ভাই তোর বাঁশিটা কই। আর একটু বাজা। এমন মিষ্টি সুরে বাঁশি বাজানো তুই কোথায় শিখেছিস? তোর বাঁশির সুরেই তো আমার ঘুমটা ভেঙে গেলো।
রোদেলা বারান্দায় এসে ঢোলের আওয়াজ শুনতে পায়। বড় একটা মিছিল। সবাই খুশির জোয়ারে ভাসছে। ঢোল করতাল, কাঁসা, জুরি, মৃদঙ্গ বাজিয়ে নানা রকম বাহারি পোষাক পরে এগিয়ে যাচ্ছে লোকগুলো। বিশাল আকৃতির হাতি, ঘোড়া, দোয়েল, রয়েল বেঙ্গল, শাপলা আরও কত বিচিত্র রকমের মানুষের মুখোশ। রাস্তায় যেন মানুষের ঢল নেমেছে। ঢোলের তালে তালে ছেলে বুড়ো সবাই নাচছে। রোদেলা জানে সবাই পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রা করছে। ঢোলের আওয়াজ শুনে পাশের বাসার মুক্তা এসে বলল-হাতি ঘোড়াগুলো তো শহরের সমস্ত রাস্তা দখল করে নিয়েছে। মানুষগুলো যাবে কোথায়?
রোদেলা হাসল। বলল-ওরে বুদ্ধু, এটা হচ্ছে শোভাযাত্রা। সবাই নানা রঙে সেজে নতুন বছরকে বরণ করছে। রোদেলা দৌড়ে টুকুকে আনতে গেল। টুকু মেঝেতে বিছানার চাদর জড়িয়ে বসে আছে। মাঝে মধ্যে হাত দু’টো দিয়ে কান চেপে ধরছে। হৈচৈ ভালো লাগছে না। রোদেলা আনতে গেলে হাতে জোড়ে একটা খামছি দেয়। রোদেলা একটুও রাগ করেনি। ভাইকে সে খুব ভালোবাসে। মা যেমনটি ভালোবাসে। মাও অনেক চেষ্টা করেছে টুকুকে বারান্দায় আনার জন্য। কিছুতেই আসবে না।
রোদেলাও আর বারান্দায় আসেনি। ওর ভীষণ মন খারাপ। এর মধ্যে মামা সবাইকে তৈরী হতে বলছে। নতুন কাপড় পরাতে চেষ্টা করল টুকুকে। কিছুতেই পরবে না। সবাই মিলে অনেক চেষ্টা করল। টুকুর খুব রাগ হচ্ছে। রাগ হলে পাশে যাকে পায় চেপে ধরে হাতে মুখে খামচি দেয়। ও কিছু বলতে পারে না। কিন্তু পষ্ট বোঝা যায় ওর হাসি আনন্দের লক্ষণগুলো।