রেলে মুজিববর্ষের কাজেও গাফিলতি!

27

রাহুল দাশ নয়ন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী (মুজিববর্ষ) উপলক্ষে যাত্রীদের আরামদায়ক রেলভ্রমণ নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে পূর্বরেলের ৩২টি স্টেশনের উচ্চতা বৃদ্ধি, ভবন আধুনিকায়ন, এক্সেস কন্ট্রোল (ঘেরাবেড়া) পার্কিং ও প্ল্যাটফর্ম শেডের মান উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। সরকারের পক্ষ থেকে পূর্বাঞ্চলের ৩২টি স্টেশনের মান উন্নয়নে বিশেষ বরাদ্দ দেয়া হয় ১০০ কোটি টাকা। কিন্তু মুজিববর্ষের নির্ধারিত সময়ে স্টেশনগুলোর মধ্যে মাত্র ৬টির কাজ শেষ হয়েছে। যে কারণে বিশেষ বরাদ্দের টাকা ফেরত যাওয়ায় রাজস্ব খাতের টাকা দিয়েই স্টেশনগুলোর মান উন্নয়ন করতে হচ্ছে।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. আবু জাফর মিঞা পূর্বদেশকে বলেন, ‘কিছু কিছু স্টেশনের কাজ চলছে। মুজিববর্ষ শেষ হওয়ায় বাজেটও ক্লোজ হয়ে গেছে। এখন রাজস্ব খাত থেকে করতে হচ্ছে। মুজিববর্ষকে সামনে রেখে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে এটি করতে হয়েছিল। যে বাকি কাজ রয়েছে সেগুলো রাজস্ব খাত থেকে করা হবে। ছয়টি স্টেশনের কাজ শেষ হয়েছে। বাকিগুলোর কাজও চলছে। এ বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।’
সরকার ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ সময়কে মুজিববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করে। মুজিববর্ষ উদ্যাপনের লক্ষ্যে গৃহীত কর্মসূচি কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারির কারণে নির্ধারিত সময়ে যথাযথভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব না হওয়ায় মুজিববর্ষের সময়কাল ২০২২ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছিল। মুজিববর্ষ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ৩৩ মাস পেরিয়ে গেলেও ৩২ স্টেশনের কাজ শেষ করতে পারেনি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো. জাহাঙ্গীর আলম পূর্বদেশকে বলেন, ‘৩২টি রেলস্টেশনের মধ্যে কিছু কিছু জায়গায় কাজ হয়েছে। গত অর্থ বছরের কিছু টাকা ফেরত গেছে। এ বছরও একটু টাকার সংকট আছে। এরপরেও কাজ দ্রæত শেষ করার জন্য তাগাদা দিয়েছি।’
রেলওয়ে সূত্র জানায়, মুজিববর্ষে পশ্চিমাঞ্চলে ২৮টি ও পূর্বাঞ্চলে ৩২টি স্টেশনের মান উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া হয়। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চলের গফরগাঁও, ময়মনসিংহ, জামালপুর, ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, নেত্রকোনা, মোহনগঞ্জ, সরিষাবাড়ি, মেলান্দহ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, জাফরশাহী, নরসিংদী, ভৈরববাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আজমপুর, নোয়াপাড়া, শায়েস্তাগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, ভানুগাছ, কুলাউড়া, কিশোরগঞ্জ, জশদলপুর, সাথিয়াজুরি, ঢাকা (কমলাপুর), চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিরা, ফেনী, লাকসাম, নোয়াখালী, চাঁদপুর ও সোনাইমুড়ি রেলওয়ে স্টেশনের মান উন্নয়নে মুজিববর্ষে প্রকল্প নেয়া হয়েছিল। প্রথমে ২৬টি স্টেশনের মান উন্নয়ন করার কথা বলা হলেও পরবর্তীতে আরও ছয়টি স্টেশন সংযোজন করা হয়। স্টেশনগুলোর মধ্যে প্লাটফর্মের ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। ভবনের কাজেরও প্রায় ৭০শতাংশ শেষ। কিন্তু এক্সেস কন্ট্রোলেই বড় ধরনের জটিলতায় পড়তে হয়েছে। অনেক রেলস্টেশনের ভেতরে দোকান ও অবৈধ বসতি থাকায় সেখানে ঘেরাবেড়া দেয়া সম্ভব হয়নি।
জানা যায়, পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে মুজিববর্ষের বিশেষ বরাদ্দের কাজ যাচাইয়ে ১২টির মতো কমিটি করা হয়। ২-৪টি স্টেশন মিলে একটি কমিটিকে কাজের অবস্থা দেখভাল করার দায়িত্ব দেয়া হয়। এ কমিটি পূর্বাঞ্চলে কাজের তথ্য চাইলে ১৬টি স্টেশনের কাজ শেষ হয়েছে বলে তথ্য দেয়া হয়। এ তথ্যের ভিত্তিতে মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটি ছয়টি স্টেশন ছাড়া বাকিগুলোর কাজ অসম্পূর্ণ থাকায় আপত্তি তুলে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অযোগ্য ও পছন্দের ঠিকাদারদের কাজ দেয়া, প্রতিটি স্টেশনে একাধিক দরপত্র আহŸান, নির্মাণ সামগ্রীর দাম বৃদ্ধি, একই ঠিকাদারের হাতে কয়েকটি স্টেশনের কাজ দেয়া, দরপত্র আহবান ও চুক্তিকালে সময়ক্ষেপনসহ নানা কারণে স্টেশনগুলোর কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি। তালিকায় থাকা ৩২টি স্টেশনের মধ্যে একই ঠিকাদার একাধিক কাজ পেয়েছেন। প্রকৌশল দপ্তরের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই কাজগুলো ভাগিয়ে নিয়েছেন ঠিকাদাররা। ৩২টি স্টেশনের মধ্যে প্রতিটি কাজের পৃথক টেন্ডার দেয়ার কারণেও জটিলতা বেড়েছে। ময়মনসিংহ, জামালপুর, নেত্রকোনা, মোহনগঞ্জসহ কয়েকটি স্টেশন ছাড়া বেশিরভাগ স্টেশনের কাজ কয়েকভাগে বিভক্ত করেই টেন্ডার আহŸান করা হয়েছে। সবমিলিয়ে ৩২টি স্টেশনে ৬০-৭০টি টেন্ডার হয়েছে। বেশি ঠিকাদারকে খুশি করতে গিয়ে বেশি টেন্ডার আহŸান করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। যেটি পশ্চিমাঞ্চলের ২৬ স্টেশনের ক্ষেত্রে হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলওয়ের এক ঠিকাদার বলেন, ‘প্রকৌশল দপ্তরে মুজিববর্ষের কাজগুলো নিয়ে বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে। একজন ঠিকাদার একাধিক কাজ পেয়েছেন। অনেকেই রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ও প্রধান প্রকৌশলীকে ম্যানেজ করে কাজগুলো ভাগিয়ে নিয়েছিলেন। এখন নির্মাণ সামগ্রীর দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় স্টেশনের কাজগুলো সেসব ঠিকাদারদের গলার কাঁটা হয়েছে। চট্টগ্রামের যে তিনটি স্টেশনের কাজ হয়েছে এগুলো তদন্ত করলেই অনিয়মের চিত্র ফুটে উঠবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রেলওয়ে স্টেশন, কুমিরা রেলওয়ে স্টেশন এই তিনটি স্টেশনের বেশিরভাগ কাজ পেয়েছে কর্ণফুলী বিল্ডার্স নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান শীট না পাওয়া, মালামাল সংকটসহ নানা অজুহাতে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে পারেনি। অন্যান্য স্টেশনের কাজে যুক্ত থাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোও কাজ শেষ করতে না পারায় একই সমস্যায় পড়তে হয়েছে।
গতকাল সন্ধ্যায় স্টেশনে কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে ফোন দেয়া হলে রিসিভ করেননি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী বিল্ডার্সের মালিক শাহদাত হোসেন তানিম। কিন্তু গতমাসে কথা হলে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম স্টেশনে নির্ধারিত সময়ে শীট না পাওয়ায় কাজ শেষ করতে পারি নাই। ডলারের দাম বাড়ার কারণে এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এখন শীট এসেছে সেগুলো বুয়েট টেস্টের জন্য পাঠানো হয়েছে। সেগুলো না আসার কারণে লাগাতে পারি নাই। সেখানে প্লাটফর্মে বøকের কাজও করে ত পারছি না। রেল সহযোগিতা করছে না। সঠিক সময়ে মালামাল না পাওয়ার কারণেই আমরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। রেলে আমার অনেক টাকা আটকে গেছে। কুমিরায় সিগন্যালিং একটি রুমের কাজ করছি। কক্ষটি না সরালে কাজ শেষ করতে পারছি না। টেকনিক্যাল সমস্যার কারণে এমন সমস্যায় পড়তে হচ্ছে বলে জানান তিনি।’
সরেজমিনে দেখা যায়, চট্টগ্রাম রেলস্টেশনের ৬ ও ৭নং প্লাটফর্মের মাঝামাঝি প্ল্যাটফর্মটি উচুঁ করা হলেও শেডের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি। এখনো প্লাটফর্মের উপর বালি ও ইটের স্তুপ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেলওয়ে স্টেশনের ভবনের কাজ এখনো শুরু হয়নি। কুমিরা স্টেশনেও ভবনের কাজ শেষ করতে পারেনি ঠিকাদার।
চট্টগ্রাম রেলস্টেশনের ব্যবস্থাপক রতন কুমার চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, ‘৭নং প্ল্যাটফর্মে ছাউনি দিচ্ছে। ৫নং প্লাটফম উঁচু করেছে। ভবনের উপরে শ্যাওলা জমতো সেগুলোও পরিষ্কার করেছে। কিন্তু কাজগুলো অনেকদিন পর্যন্ত চলছে। উনারাতো শেষ করতে পারছে না।’ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রেলস্টেশনের দায়িত্বে থাকা ফতেয়াবাদ স্টেশনের মাস্টার আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘স্টেশনে কিছু কাজ করেছে। তবে ভবনের কাজ করার কথা ছিল। তা শুরুই হয়নি।’