রেলগাড়ি ঝিক ঝিক কক্সবাজার যাবে ঠিক ঠিক

11

মুশফিক হোসাইন

পূর্ব প্রকাশের পরের কিস্তি:
১৯২৯ সালে চট্টগ্রাম থেকে হাটহাজারী রেলস্টেশনটি চালু হয়। ১৯৩১ সালে বিদ্যমান রেলপথ থেকে দোহাজারী পর্যন্ত রেলপথটি চালু হয়। বর্তমানে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ব্রডগেজ ও মিটার গেজ রেলপথ সম্প্রসারণের কাজ চলমান। শেখ হাসিনার সরকারের ফাস্ট ট্যাক এই প্রকল্প চট্টগ্রামবাসীকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে। দুর্গম পথে রেলপথ বসিয়ে মিয়ানমারের আকিয়াব হয়ে রেঙ্গুন পর্যন্ত রেলপথ বিস্তারের একটি পরিকল্পনা আছে সরকারের। অবশ্য এই ভাবনা ছিল শত বছর আগেই। ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে করিডোরে যুক্ত হওয়ার ভিত্তি হচ্ছে এই শাখা রেলপথ। অতীতের আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে ও ইস্টার্ন বেঙ্গল যুক্ত হয়ে দ্যা বেঙ্গল এন্ড আসাল রেলওয়ে নামে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৪৭ সালে ইস্ট পাকিস্তান রেলওয়ে এবং বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ রেলওয়ে নামকরণ করা হয়।
বলছিলাম রেলগাড়িতে কক্সবাজার যাওয়ার কথা। স্বপ্ন বাস্তবায়নের এই রেলপথ এখন দৃশ্যমান। বাস্তবতা হল ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের করিডোরে সংযোগস্থাপন। পর্যটন শহর যেতে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারকে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় আনা। ভ্রমণযাত্রীদের জন্য সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব যোগাযোগ ব্যবস্থা ও স্বল্প খরচে পণ্য পরিবহন এই প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য।
ঢাকা থেকে বক্সবাজার পর্যন্ত সরাসরি রেল সংযোগের জন্য চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০২ কিলোমিটার এবং কক্সবাজার থেকে মিয়ানমারের ধুমধুম পর্যন্ত ২২.৭৫ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। এই লক্ষ্যে ২০১০ সালের ৬ জুলাই প্রকল্পের ডিপিপি অনুমোদন দেয়া হয়। ২০২১ সালে ১৯ জুলাই আবার প্রকল্পের সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদিত হয়। এতে প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ স্থির হয়েছিল জুলাই ২০১০ থেকে জুন ২০২২ পর্যন্ত। বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব তহবিল এবং এশিয়ান ডেভলমেন্টের অর্থে ব্যয় ধরা হয় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লক্ষ টাকা। এতে এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাংকের ১৫০ কোটি ডলার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সারের ৩ এপ্রিল ঝিলংজা মৌজার চৌধুরী পাড়ার দোহাজারী রামু-কক্সবাজার এবং রামু ধুমধুম রেলপথের ভিত্তিপ্রস্তর করেন। এরি মাঝে অর্থায়ন নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। অবশেষে ২০১৭ সালের ১৭ জুন এবং ২০১৯ সালের ২৩ মে এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাংকের সাথে দুইদফা চুক্তি হওয়ার পর অর্থায়নের জটিলতা কেটে যায়। প্রকেল্পর ভূমি অধিগ্রহণের কাজ প্রায় শেষ। বন বিভাগের সাথে জন ও বন্যপ্রাণী রক্ষা জটিলতার নিরসনও শেষমেশ হয়। অতঃপর বাংলাদেশ রেলওয়ে দুটি লটে প্রকল্পটির কাজ শুরু করে। একটি লটে চীনের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে কর্পোরেশন ও দেশীয় প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। অন্যলটে কাজ করছে চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ও দেশীয় প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ইনফ্র্যাকস্ট্রাক লিমিটেড। প্রথম পর্যায়ে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া, রামু ও কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ হবে। চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত রেলপথ আছে। দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০২ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে মূল রেলপথ এবং ৩৯.২ কিলোমিটার লুপ লাইনসহ মোট ১৪১ কিলোমিটার নতুন সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণের কাজ চলমান। ইতিমধ্যে ৯০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের জন্য মাটি ভরাট ও পুর্তকাজ চলছে। রেলপথের জন্য ছয়টি বড় আকারের ব্রিজের নির্মাণ কাজ শেষ। অপেক্ষা শুধু গ্যার্ডার লাগনোর। গ্যার্ডার লাগানো শেষ হলে বলা যাবে সেতুর কাজ পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবে। ছোট আকারের ৩৯টি ব্রিজের মধ্যে ৩০টির কাজ শেষ, এগুলোতেও গ্যার্ডার ও ¯িøপার বসবে। এছাড়া আরও ১৪৫টি ছোট ছোট ব্রিজ ও কালভার্টের কাজ শেষ। বিভিন্ন ধরনের ৯৬টি লেভেল ক্রসিং নির্মাণের প্রস্তুতি চলছে।
ইতিমধ্যে বন্যপ্রাণী বিশেষ করে হাতি চলাচলের জন্য যে পথগুলো ছিলো সেগুলোর জন্য নির্মিত হচ্ছে আন্ডারপাসও ওভারপাস। দোহাজারী, লোহাগাড়া হারবাং, চকরিয়া, ডুলাহাজারা, ইসলামাবাদ, রামু ও কক্সবাজারে। রেলপথের মূল জংশন হবে রামুতে। কক্সবাজারের আইকনিং ইন্টারমডেল টার্মিনাল বিল্ডিং যা কেন্দ্রীয় রেলস্টেশন হিসাবে ব্যবহৃত হবে। ঝিনুক আকৃতির এই স্টেশনটি বেশ নান্দনিক ও চোখ ধাঁধানো। চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত মিটার গেজ রেলপথ আছে। তবে নতুন প্রকল্পে ডুয়েল গেজে রূপান্তর করা হবে। পাশাপাশি ফৌজদার হাট থেকে একটি কার্ভ বা কর্ড লাইন নিয়ে ষোলশহর রেলস্ট্রেশনের সাথে যুক্ত হবে। অন্যদিকে ঢাকা থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত আরও একটি কর্ড লাইন হবে। সময় বাঁচাতে ও যাত্রীদের নিরবচ্ছিন্ন সেবা দিতে এই পথে প্রস্তাবিত কর্ড লাইনের গুরুত্ব অপরিসীম। এতে করে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে সরাসরি রেলপথে সহজে ও কম সময়ে স্বচ্ছন্দে এবং আরামদায়ক ভ্রমণে কক্সবাজার যেতে পারবেন পর্যটকগণ।
বিশাল এই কর্মযজ্ঞ শেষ হতে সময় লাগতে পাবে। তবে বলা যায় ঠিাকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো যথেষ্ট আন্তরিকতার সাথে কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। সরকার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও চাচ্ছেন তাঁর মেয়াদ কালে প্রকল্পটির কাজ শেষ হউক। দেশবাসি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে রেল চড়ে তাঁরা কক্সবাজার যাবেন। বিশ্বপর্যটক ও অপেক্ষায় আছে বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্র সৈকতে যেতে রেলে ভ্রমণ করবেন। আমরা অপেক্ষা করছি আমাদের বহুল প্রতিক্ষিত স্বপ্ন বাস্তবায়িত অতি শ্রীঘ্রই।

লেখক : কবি, নিসর্গী ও ব্যাংক নির্বাহী (অব)