রেলক্রসিংগুলো যেন মৃত্যুফাঁদ

19

রাহুল দাশ নয়ন

মিরসরাইয়ের বরতাকিয়ায় ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাস্থল রেলক্রসিংটি ছিল উন্মুক্ত। সেখানে নিয়মিত গেটম্যান থাকার কথা থাকলেও ঘটনার সময় ছিলেন না কেউ। একইভাবে সিগন্যাল ব্যবস্থাও ছিল না। যে কারণে মাইক্রোবাসে থাকা তরুণ আরোহীদের তাড়ায় দ্রুত গাড়িটি রেললাইনে তুলে দেন চালক। এতে ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি ঘটে। স্থানীয় লোকজনের এমন দাবির সাথে ভিন্নমত পোষণ করেছেন রেল কর্তৃপক্ষও। রেলওয়ের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, পরপর দুটি ট্রেন সেই ক্রসিং পার হতে গিয়ে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। দুটি ট্রেন এক জায়গা দিয়ে পার হওয়ার সময়ও গেটম্যান না থাকার বিষয়টি ‘অকল্পনীয়’।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ব্যবস্থাপক আবুল কালাম চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম থেকে ঢাকামুখী ৭২১ আপ ট্রেন যাচ্ছিল। পরপরই ঢাকা থেকে আসা চট্টগ্রামমুখী প্রভাতী ট্রেন পার হচ্ছিল। দুটি ট্রেন পার হওয়ার আগেই সেখানে রেলক্রসিংয়ের নিরাপত্তায় ব্যারিয়ার ফেলা হয়েছিল। ঘটনার সময় সেখানে গেটম্যান উপস্থিত ছিলেন। মাইক্রোবাস চালক বুঝতে পারেননি একটি ট্রেন পার হওয়ার পর আরেকটি ট্রেন যাবে। সেটি যাওয়ার আগেই ব্যারিয়ার ক্রস করে মাইক্রোবাস চালক রেললাইনে গাড়িটি তুলে দেন। যে কারণে এতবড় দুর্ঘটনা হয়েছে। এখন রেলক্রসিংগুলো অনেক বেশি সুরক্ষিত।’
রেল দুর্ঘটনার পরপরই গেটম্যান ও সিগন্যাল না থাকা নিয়ে আলোচনা বাড়লেও রেলের এই দুই ‘ব্যর্থতা’র সাথে যুক্ত হয়েছে ক্রসিংয়ের উপর বেপরোয়া গাড়ি চলাচল ও গাড়ি চালকদের আইন অমান্যের মতো অপরাধ। আর এসব কারণেই বারবার লেভেল ক্রসিংগুলোতে ঘটছে দুর্ঘটনা। যেসব দুর্ঘটনায় বেশিরভাগ সময়েই ঘটে প্রাণহানি। গত দুই বছরে শুধুমাত্র রেল ক্রসিংয়েই ঘটেছে কমপক্ষে ২০টি দুর্ঘটনা।
জানা যায়, ২০২১ সালের ২৯ আগস্ট কুমিল্লার বিশ্বরোড গেটের লালমাই এলাকায় মহানগর এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। সেখানে আছে বাঁশঘেরা ক্রসিং। এ গেটটি প্রকৌশল বিভাগের অধীনে (ই গেট)। সেখানে একটি মিনিট্রাক সিগন্যাল অমান্য করে হঠাৎ লাইনে উঠে গেলে গাড়ি স্বজোরে আঘাত করে। সেসময় গাড়িটি লাইনে উঠেই বন্ধ হয়ে যায়। সীতাকুন্ডে গত বছরের ৩০ আগস্ট সোনার বাংলা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। এটি ছিল অনুমোদনহীন গেট। এ গেট দিয়ে নিয়মিত বেপরোয়া গাড়ি চলাচল করে। সেখানেও একটি মিনিট্রাক হঠাৎ লাইনে উঠে বন্ধ হয়ে গেলে চলন্ত ট্রেন এটিকে ধাক্কা দেয়। এতে হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও ট্রেন চালকের সতর্কতার কারণে যাত্রীরা বড়ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায়। গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর পটিয়ায় আউটার সিগন্যাল দিয়ে পিডিবির শাটল ট্রেন যাওয়ার সময় একটি নসিমন অবৈধ রেলগেটে উঠে পড়ে। যার কারণে দুর্ঘটনা ঘটলেও হতাহত হয়নি কেউ। গত বছরের ৫ ডিসেম্বর খুলশী থানাধীন জাকির হোসেন রোডের ঝাউতলা রেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় একজন পুলিশ কনস্টেবলসহ তিনজন নিহত হন। সেদিন ট্রেন আসার সময় যান চলাচল ঠেকাতে সড়কের একপাশে লোহার বার দিয়ে আটকানো হলেও অপর পাশে খোলা ছিল। সেই খোলা অংশ দিয়ে দ্রুতগতিতে ট্রেন যাওয়ার পথে একটি অটোরিকশা ও একটি মিনিবাস উঠে পড়লে এই দুর্ঘটনাটি ঘটে। একই বছরের ২৯ ডিসেম্বর সীতাকুন্ডের বাড়বকুন্ডে এসকেএম জুট মিল সংলগ্ন রেল ক্রসিংয়ে ঢাকাগামী তুর্ণা নিশিথা ট্রেনের সঙ্গে লরির সংঘর্ষের ঘটনায় কেউ হতাহত না হলেও দীর্ঘক্ষণ ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। সর্বশেষ গতকাল মিরসরাইয়ের বরতাকিয়ায় ভয়াবহ দুর্ঘটনায় ১১ জনের প্রাণহানি ঘটেছে।
পরিবহন বিভাগ সূত্র জানায়, রেলের পূর্বাঞ্চলের লেভেল ক্রসিং রয়েছে এক হাজার ২৩০টি। এরমধ্যে ৫১১টি বৈধ থাকলেও অবৈধ আছে ৭১৯টি। বেশিরভাগ অবৈধ ক্রসিং ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, অভ্যন্তরীণ সড়কের মুখে নির্মিত। রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির কারণেও কোন কোন স্থানে নির্মিত হয়েছে লেভেল ক্রসিং। চট্টগ্রাম বিভাগে বৈধ লেভেল ক্রসিং আছে ৭৩টি। যেখানে লোকবল আছে ৩৫টি। ৯০ জন গেটকিপারের মঞ্জুরিকৃত পদের বিপরীতে লোক আছে মাত্র ৪৩জন। অন্যদিকে ৩০টি গেট দেখভাল করেন প্রকৌশল বিভাগের প্রকল্পের লোকজন। ট্রাফিক বিভাগে অনুমোদনহীন গেট নেই, ইঞ্জিনিয়ারিং গেট আছে। রেলের বেশিরভাগ অনুমোদনহীন লেভেল ক্রসিংই দুর্ঘটনার কারণ। অনুমোদনহীন লেভেল ক্রসিং বন্ধ হলে দুর্ঘটনা কমে যাবে। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া বেশিরভাগ দুর্ঘটনায় গাড়ি চালকদের কারণেই ঘটেছে।
সূত্র জানায়, রেলেক্রসিং গেট আছে দুই ধরনের। একটি স্টেশনের আউটার থেকে আউটার পর্যন্ত যে গেট সেগুলো সংশ্লিষ্ট স্টেশন মাস্টারের আওতাধীন। সেখানে যে গেট আছে সেগুলো ট্রাফিক বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করে। যে কারণে এ গেটগুলোকে ‘টি’ গেট কিংবা ট্রাফিক গেট বলা হয়। দুই আউটারের মাঝখানে যে গেটগুলো আছে সেগুলোই ‘ই’ গেট। যা নিয়ন্ত্রণ করে প্রকৌশল বিভাগ। এক্ষেত্রে পূর্বাঞ্চলের ট্রাফিক গেটগুলো অনেকটা ভালো পজিশনে থাকলেও ইঞ্জিনিয়ারিং গেটগুলোর অবস্থা খারাপ। যেখানে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেশি।
প্রকৌশল বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘লেভেল ক্রসিংগুলো রাতের আঁধারেই গড়ে উঠেছে। রেল লাইনের পাশে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন শিল্পগ্রুপের কারখানায় যাতায়াতের জন্যই অনেকেই উর্ধ্বতন মহলের অনুমতি নিয়ে ক্রসিং বানাচ্ছেন। কিছু ক্রসিং রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় গড়ে উঠে। অনেক সময় দেখা যায় আমরা আপত্তি দিলেও ক্রসিং হয়ে যায়। একবার ক্রসিং হয়ে গেলে তা বন্ধ করা কঠিন। অতিরিক্ত লেভেল ক্রসিং গড়ে উঠার কারণে রেলের গতিও কমে যায়। দুর্ঘটনা বাড়ে।’