রেমিট্যান্স প্রবাহে অন্তরায় : মুক্তি কোন পথে ?

11

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

অতি সম্প্রতি গণমাধ্যম সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যমতে, প্রবাসী কর্মমুখী বাঙালি বা রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের বিমানের টিকেট সংগ্রহ-যাত্রা নিশ্চিতকরণ, ভিসা সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন, কোভিড মুক্তির প্রত্যয়ন পত্রসহ শাহজালাল বিমান বন্দর থেকে শুরু করে সর্বত্রই হয়রানির দৃশ্যাদৃশ্যের করুণ আর্তনাদ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। করোনা অতিক্রান্তের পরবর্তী পর্যায়ে প্রবাসীদের কর্মসংস্থান নিয়ে স্বদেশ এবং বিদেশে নানামুখি সংকট অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে দুর্ভেদ্য অন্তরায় নির্মাণ করছে। প্রতিনিয়ত এসব নেতিবাচক সংবাদে দেশবাসী যারপরনাই যন্ত্রণাকাতর। অনতিবিলম্বে উদ্ভট এসব সমস্যার নিবিড় তদন্ত ও সমাধানের প্রায়োগিক পদক্ষেপ গ্রহণ অনিবার্য হয়ে পড়েছে। এটি অনিস্বীকার্য যে, বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে রেমিট্যান্স। প্রবাসীদের অতি কষ্টার্জিত রেমিট্যান্সের উপর ভর করে মজবুত হয়েছে দেশের অর্থনীতির ভীত, নির্মিত হচ্ছে বিভিন্ন সেতু-ফ্লাইওভারসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন। দেশের জিডিপিতে প্রায় ১২ শতাংশ অবদান রাখা এই রেমিট্যান্স পরিণত হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের উল্লেখযোগ্য অংশীদার হিসেবে। করোনাকালীন অর্থনীতিতেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল এই রেমিট্যান্স।
দুঃখজনক হলেও সত্য; এই ধরিত্রীর বিভিন্ন দেশে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্জিত অর্থ-রেমিট্যান্স যারা দেশে পাঠাচ্ছে তাদেরকে দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। তাদের প্রতি বিদেশে বাংলাদেশী দূতাবাসগুলোর অসহযোগিতা-অভিযোগের অন্ত নেই। দালালের দৌরাত্ম্য, পাসপোর্ট জটিলতা, কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তা নিয়ে অস্বস্তিকর পরিবেশ নতুন কোন বিষয় না হলেও তার সাথে যুক্ত হয়েছে মৃত্যুর পর প্রবাসীদের প্রতি অবহেলাও। প্রবাসীদের অস্বাভাবিক মৃত্যু বৃদ্ধি পেলেও তা প্রতিরোধে বা ঘটনা তদন্তে উদ্যোগী নয় দূতাবাসগুলো। সম্প্রতি দেশে বেড়াতে আসা বহু প্রবাসীর অভিযোগ, দেশে তারা ন্যূনতম অধিকারটুকুও পাচ্ছেন না এবং তাদের তৃতীয় শ্রেণির নাগরিকের মর্যাদাও দেওয়া হচ্ছে না। প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুসারে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স প্রেরণকারী মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমিকেরা দেশে অধিকতর নিগৃহীত হচ্ছেন। বিমানবন্দরে নেমেই তারা অরাজক আচরণ-ভোগান্তিতে নিপতিত হয়। চলতি বছরের ফেব্রæয়ারি মাসে সৌদি ফেরত এক প্রবাসী বিমানবন্দরের অভিজ্ঞতার বর্ণনায় বলেন, ‘এমিরেটসের ফ্লাইট থেকে নামার পর ইমিগ্রেশন কাউন্টারে যাবার আগে তাকে টেনে-হিচড়ে একটি কক্ষে নিয়ে গিয়ে অহেতুক দেহ তল্লাশী করা হয়। মধ্যপ্রাচ্য থেকে যে কোনো শ্রমিক ফিরলেই ঐ কক্ষে নিয়ে যাওয়া যায়। কেউ এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে ফেরার সময় অযাচিত কষ্টের মুখোমুখি হতে হয়।’
করোনাকালে ছুটিতে আসা প্রবাসী কর্মীরা কর্মস্থলে ফিরতে পদে পদে ভোগান্তিতে পড়েছেন। বিদেশে যাওয়ার টিকেট পাওয়ার জন্য রাত জেগে বসে থাকাসহ করোনা টিকার দাবিতে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে মিছিলও করতে হয়েছে। প্রবাসীদের অভিযোগ, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন গন্তব্যে বিমান ভাড়া লাখ টাকা ছাড়িয়েছে। বিমান ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় দিশেহারা প্রবাসীরা কীভাবে গন্ত্যব্যে ফিরবেন কোনও উপায় খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তাছাড়াও ছিল ফ্লাইটের সংকট। অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (বামারু) প্রতিবেদনেও প্রবাসী কর্মীদের নানান দুর্দশার চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে উপস্থাপিত তথ্যমতে, উপসাগরীয় দেশগুলোতেই বেশি মৃত্যু হচ্ছে প্রবাসী কর্মীদের। বিদেশের মাটিতে অনেক প্রবাসীর দাফন হচ্ছে। কিন্তু এসব মৃত্যুর কারণ নিয়েও কখনো অনুসন্ধান করেনি মন্ত্রণালয়। মৃত্যু সনদে গণহারে ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ বা ‘হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধে মৃত্যু’ লিখে দেওয়ায় অর্ধেকের বেশি মৃত্যুর কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় নি। প্রতিবেদন প্রকাশের অনুষ্ঠানে ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের’ প্রতি রাষ্ট্র তার দায়বদ্ধতা পালনে ব্যর্থ হয়েছে বলে স্বীকার করেছেন সরকার দলীয় এক সাংসদ।
করোনা অতিমারি ক্রান্তিকালে বিশ্বব্যাপী ব্যবসা-বাণিজ্য-পর্যটনশিল্পে ধস ও রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা প্রতিকূলতায় সংকটে পড়া মধ্যপ্রাচ্যসহ প্রবাসীদের নিয়োগদাতা দেশসমূহে কর্মী ছাটাই ও বেতন বন্ধসহ বহুবিধ সমস্যার মোকাবেলা করছেন বিভিন্ন দেশে কর্মরত রেমিট্যান্স যোদ্ধারা। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে; বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ, করোনার কারণে কাজ না থাকা, চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়া, প্রতারিত হওয়া, ভিসা-আকামার মেয়াদ না থাকাসহ বিভিন্ন কারণে ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত সোয়া দুই লাখের বেশি কর্মীকে দেশে ফিরতে হয়েছিল। তাদের মধ্যে সৌদি আরব ও আরব আমিরাত থেকে দেশে ফিরেছেন ১ লাখ ২০ হাজার ৮৮৯ জন যা মোট দেশে ফেরার ৫৩ দশমিক ৫৯ শতাংশ। অর্থমন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বর্তমানে ১৭৪টি দেশে বাংলাদেশের শ্রমিকদের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ২০ লাখের বেশি। এর চার ভাগের তিন ভাগ শ্রমিক নিয়োজিত আছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুসারে, রেমিট্যান্স আয়ের তিন ভাগের দুই ভাগও আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। ২ জানুয়ারি ২০২২ গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য উপাত্তের আলোকে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ২০২১ সালের শুধু ডিসেম্বর মাসে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ১ শত ৬২ কোটি ৯০ লাখ (১.৬২ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার। দেশের ইতিহাসে বছরের সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স প্রাপ্তির বছর হচ্ছে ২০২১। ঐ বছর দেশে রেকর্ড ২ হাজার ২০৭ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ১ লাখ ৮৯ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা (ডলার প্রতি ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা ধরে)। বিপরীতে ২০২০সালে অর্জিত হয়েছিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২ হাজার ১৭৪ কোটি ডলার এবং ২০১৯ সালে এর পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৮৩৩ কোটি ডলার।
৪ এপ্রিল ২০২২ গণমাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশে ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থ বছরে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স কমতে শুরু করে। যদিও পবিত্র রমজানকে সামনে রেখে মার্চ মাসে এর প্রবাহ বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। যা বিগত আট মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। মার্চ মাসে পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ১৮৬ কোটি বা ১ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সংশ্লিষ্টদের মতে, রামজান মাসের পাশাপাশি রেমিট্যান্সে সরকারের বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা এবং নতুন করে অনেকে বিদেশ যাওয়ায় এর প্রবাহ বেড়েছে। উল্লেখ্য যে, ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে সরকার প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা দিয়ে আসছে। উক্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ ১ হাজার ৫২৯ কোটি ৮৫ লাখ ডলার। বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ ১ লাখ ৩১ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৮৬ টাকা ২০ পয়সা হিসাবে)। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৩০ কোটি বা ১৮ শতাংশ কম। ২০২০-২১ অর্থবছরে উল্লেখ্য সময়ে এসেছিল ১ হাজার ৮৫৯ কোটি ৮২ লাখ ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর, নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রæয়ারি মাসে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১৮৭ কোটি ১৫ লাখ, ১৮১ কোটি, ১৭২ কোটি ৬৭ লাখ, ১৬৪ কোটি ৬৮ লাখ, ১৫৫ কোটি ৩৭ লাখ, ১৬৩ কোটি, ১৭০ কোটি ৪৫ লাখ ও ১৪৯ কোটি।
১ জানুয়ারি ২০২২ অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিসূত্রে বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশী শ্রমজীবী মানুষের উপার্জিত বৈদেশিক আয় বৈধ পথে দেশে আনার ব্যাপারে উৎসাহিত করার জন্য প্রণোদনা ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে। মানুষের সার্বিক জীবনমান উন্নয়ন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের গুরুত্ব বিবেচনায় এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে আরও উল্লেখ ছিল এই প্রণোদনার হার বৃদ্ধির বিষয়টি প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে নববর্ষের উপহার। ১২ মে ২০২২ গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ব্রিফ” শীর্ষক প্রতিবেদনের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, চলতি বছরে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ মাত্র ২ শতাংশ বাড়বে। সংস্থাটির মতে, মহামারির মধ্যে নিয়মিত প্রণোদনা দেওয়ায় ২০২১ সালে ২২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পেয়েছিল বাংলাদেশ। ২০২২ সালে তার চেয়ে ২ শতাংশ বেশি রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পেতে পারে। বিশ্বব্যাপী রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে ৬৩০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। দক্ষিণ এশিয়ায় এই প্রবাহ কমবে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। নি¤œ ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে বাড়বে ৪ দশমিক ২ শতাংশ। সংস্থাটি ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল অর্থনীতির দেশগুলোতে রেমিট্যান্স প্রবাহে বড় পতন হবে বলেও সতর্ক করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি বছরের শুরুতে প্রণোদনা বৃদ্ধির ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। জানুয়ারি মাসে আসা ১৭০ কোটি ৪৪ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পূর্বের চার মাসে আসা রেমিট্যান্সের মধ্যে সর্বোচ্চ। যদিও এ আয় ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসের তুলনায় প্রায় ১৩ শতাংশ কম। ব্যাংক সংশ্লিষ্টদের মতে, আগের চেয়ে বেশি হারে প্রণোদনা দেওয়ার কারণে রেমিট্যান্স আসা বেড়েছে। ১২ মে ২০২২ কেন্দ্রীয় ব্যাংক আয়োজিত ‘বাংলাদেশ ব্যাংক রেমিট্যান্স অ্যাওয়ার্ড ২০১৯-২০’ বিতরণ অনুষ্ঠানে সম্মানিত অর্থমন্ত্রী প্রবাসীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনারা বৈধ পথে দেশে রেমিট্যান্স (প্রবাসী আয়) পাঠাবেন। এতে নিজেরা উপকৃত হবেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও সহযোগী হবেন। রেমিট্যান্স পাঠানোর অনেক সোর্স আছে। আপনারা আমাকে বিশ্বাস করুন, আপনারা ঠকবেন না। আপনি যখন অবৈধভাবে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাবেন, তখন নিজেরা উপকৃত হলেও দেশ উপকৃত হবে না।’ উক্ত অনুষ্ঠানে ৬৭ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে রেমিট্যান্স তথা প্রবাসী আয়ে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সম্মাননা দেওয়া হয়। এই মূল্যায়নের বিপরীতে রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের অসহনীয় চ্যালেঞ্জসমূহের পরিত্রাণে বাস্তবসম্মত দিকনির্দেশনা থাকলে প্রণোদনার বিষয়টি অধিকমাত্রায় গ্রহণযোগ্য হতো।
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে রেমিট্যান্স প্রবাহের নি¤œমুখীতায় কমতে শুরু করেছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের ২৪ ফেব্রæয়ারি বাংলাদেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক রিজার্ভ ৪৪ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। একই বছরের ২৮ এপ্রিলে হয় ৪৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি। কিন্তু করোনা মহামারির মধ্যেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ দশমিক ০৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের নতুন রেকর্ড ছুঁয়েছিল। ৮ মে ২০২২ মগণমাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মার্চ-এপ্রিল মেয়াদের ২২৪ কোটি ডলারের আমদানি বিল পরিশোধ করার পর রিজার্ভের আকার নেমে আসে ৪ হাজার ১৯০ কোটি ডলারে। দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৩ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। গত দেড় বছরের মধ্যে এটিই সবচেয়ে কম রিজার্ভ। এর পূর্বে ২০২০ সালের নভেম্বরে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ১২৬ কোটি টাকা। অর্থনীতি বিশ্লেষক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তাদের ধারণা; দেশে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি এবং প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৫ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানির বিনিময়ে আগস্টে তা বেড়ে ৬ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। সেপ্টেম্বরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৭ বিলিয়ন ডলারে। উল্লেখ্য যে, বর্তমানের আমদানির খরচ হিসাবে এই রিজার্ভ দিয়ে পাঁচ মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে। অথচ বিগত সাত-আট মাস আগেও ১০ থেকে ১১ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর রিজার্ভ ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের।
অর্থনীতি গবেষক ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘আমদানি বাড়লে রিজার্ভ কমবে এটাই স্বাভাবিক। এতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। এখনও মোটামুটি সন্তোষজনক আছে। আর আমদানি বাড়াতো ভালো। এতে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে, অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হবে এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে।’ সার্বিক পর্যালোচনায় এটি সুস্পষ্ট যে বৈশ্বিক তেল-নিত্যপণ্য-মুদ্রার বাজারে চরম অস্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করছে। দ্রæততার সাথে পণ্য মূল্যের উর্ধ্বগতি, চাহিদা-সরবরাহে ভারসাম্যহীন অসঙ্গতি-ডলার মানদন্ডে টাকার মূল্যমানের নি¤œগতি, আমদানি খাতে বাজার ব্যবস্থার বেসামাল পরিস্থিতি এখন থেকেই গুরুত্বসহকারে আমলে নেওয়া অত্যন্ত জরুরী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পণ্য মূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ইতিমধ্যে সামাজিক-রাজনীতিতে বিরূপ প্রভাব ও গণবিক্ষোভ সংঘাতের রূপ পরিগ্রহ করছে। যথাযথ বিশ্লেষণে উদ্ভূত বিষয়সমূহ-সংকট মুক্তির লক্ষ্যে দেশের আপামর জনগণকে পর্যাপ্ত প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে সচেতন করা এবং একই সাথে সরকার সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হলে চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রকারী অন্ধকারের অশুভ শক্তিগুলো দেশ বিরোধী ধ্বংসাতœক কার্য সংঘটনে তৎপর হয়ে উঠবে – নিঃসন্দেহে তা বলা যায়।

লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী, সাবেক উপাচার্য চ.বি