রেকর্ড ছাড়িয়ে ভারী বর্ষণ

188

খানিকটা দেরিতে এবার বর্ষা অঝোর ধারায় চেনারূপে ধরা দেয়ার পর থেকেই টানা ভারী কিংবা অতি ভারী বর্ষণ কতটা যে ভারী হতে পারে, তা গত কয়েকদিনে সবচেয়ে বেশি টের পেয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগের মানুষ। আষাঢ়ের শেষ সপ্তাহে এসে গত ৭ জুলাই থেকে শুরু হওয়া মৌসুমের প্রথম টানা ভারী বর্ষণ চট্টগ্রামের কোনও কোনও অঞ্চলের মানুষের কাছে ক্রমেই অসহনীয় হয়ে উঠছে।
বিশেষ করে সবচেয়ে বেশি বর্ষণকবলিত উপকূলীয় জনপদ টেকনাফ, কুতুবদিয়া, সীতাকুÐ, স›দ্বীপ, হাতিয়া ও পার্বত্য জেলা রাঙামাটির বাসিন্দাদের মনে জানমাল হারানোর শঙ্কা ভর করেছে। মৌসুমের প্রথম টানা ভারী বর্ষণের কারণে উপকূলীয় ও পাহাড়ি জনপদের পাশাপাশি নি¤œাঞ্চলের বাসিন্দারা স্বল্পমেয়াদী বন্যাক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি পাহাড়ধস এবং বেড়িবাঁধ ও নদী ভাঙনের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে প্রতিদিন বাড়ছে মানুষের ভিড়।
এদিকে, আবহাওয়া অধিদপ্তরের রেকর্ডে গত এক সপ্তাহে শুধুমাত্র চট্টগ্রাম বিভাগেই বৃষ্টিপাতের পরিমাণ সাড়ে ছয় হাজার মিলিমিটার ছাড়িয়ে গেছে। সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার বর্ষণের মাত্রা ভারী থেকে মাঝারিতে নেমে এলেও আষাঢ়ের বিদায় আর শ্রাবণের যাত্রা শুরুর এ সপ্তাহের কয়েকদিনও কমবেশি বর্ষণমুখরতা অব্যাহত থাকার আভাস দিয়েছে আবহাওয়াবিদরা। অধিদপ্তরের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের আবহাওয়াবিদ একেএম রুহুল কুদ্দুছ গতকাল শুক্রবার সকাল দশটা থেকে আজ শনিবার রাত দশটা পর্যন্ত চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভারী বর্ষণের সতর্কবার্তা জানিয়েছেন।
তিনি পূর্বদেশকে বলেন, মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকার কারণে শনিবার রাত দশটা পর্যন্ত পূর্ববর্তী চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে চট্টগ্রাম, রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট এবং চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও ভারী (৪৪ থেকে ৮৮ মিলিমিটার) থেকে অতি ভারী (ন্যূনতম ৮৯ মিলিমিটারের বেশি ) বর্ষণ হতে পারে। অতি ভারী বৃষ্টির কারণে চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি এলাকায় কোথাও কোথাও ভ‚মিধসের শঙ্কাও রয়েছে।
প্রসঙ্গত, বাংলা বর্ষপঞ্জিকার হিসাবে আর মাত্র দু’দিন পরেই বিদায় নিতে যাচ্ছে আষাঢ় মাস। আগামী ১৬ জুলাই যাত্রা শুরু হবে শ্রাবণ মাসের।
অধিদপ্তরের রেকর্ড অনুযায়ী, গত ৭ জুলাই থেকেই দেশে মৌসুমী বায়ুর প্রবেশদ্বার সমুদ্রতীরবর্তী কক্সবাজার অঞ্চলের টেকনাফ ধরেই চলতি বর্ষা মৌসুমের প্রথম টানা ভারী বর্ষণ শুরু হয়। অবশ্য তার আগে জুলাইয়ের প্রথম দুদিন সেখানে ভারী বৃষ্টিপাত হলেও লঘুচাপের প্রভাব পুরোপুরি কেটে না যাওয়ায় তা কেবলমাত্র ওই অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল। পরের সপ্তাহে আবহাওয়া পরিস্থিতিতে মৌসুমী বায়ু এককভাবে আধিপত্য বিস্তার করতেই কার্যত পুরো চট্টগ্রামবিভাগই ভারী বর্ষণের কবলে পড়ে। যা একটানা গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ওই সময়ের মধ্যে বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় সার্বিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ প্রতিদিন গড়ে হাজার মিলিমিটারের ঘর অতিক্রম করেছে।
একইভাবে প্রতিদিনই চট্টগ্রাম বিভাগের অন্ততপক্ষে দুটি এলাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ দুশ’ মিলিমিটার ছাড়িয়ে গেছে। একশ’ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে চট্টগ্রাম মহানগরসহ বিভাগের পাঁচ থেকে ছয়টি এলাকায়। এর মধ্যে গত ৯ জুলাই মৌসুমের এযাবত সর্বোচ্চ দুইশ’ ৬৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় কুতুবদিয়ায়। ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকাকালে প্রতিদিন দেশের বাকি সব বিভাগের রেকর্ডকৃত বৃষ্টিপাতের পরিমাণের তুলনায় চট্টগ্রাম বিভাগের বৃষ্টিপাতের পরিমাণ দ্বিগুণ ছিল।
গত বৃহস্পতিবার সপ্তাহের শেষদিনেও বিভাগজুড়ে ভারী বর্ষণের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকার পর গতকাল শুক্রবার বর্ষণধারা ভারী থেকে মাঝারি মাত্রায় নেমে আসে।
চলতি বর্ষা মৌসুমের প্রথম টানা ভারী বর্ষণধারা অব্যাহত থাকার শেষদিনে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী চব্বিশ ঘণ্টায় আবহাওয়া অধিদপ্তর দেশের সর্বোচ্চ দুইশ’ ১৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে সীতাকুÐে। একইভাবে ওইদিন কুতুবদিয়ায় রেকর্ড করা হয় দুইশ’ দুই মিলিমিটার বৃষ্টিপাত।
এছাড়া চট্টগ্রাম সদরে ৯৯, স›দ্বীপে একশ’ ৪২, রাঙামাটিতে একশ’ ৮৯, কুমিল্লায় ৩৪, ফেনীতে ৪০, হাতিয়ায় একশ’ ৭৭, কক্সবাজারে ৬২ এবং টেকনাফে ৩২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। তবে গতকাল শুক্রবার বর্ষণধারা মাঝারি মাত্রায় নেমে আসায় সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী চব্বিশ ঘণ্টায় অধিদপ্তর চট্টগ্রাম সদর, কক্সবাজার ও টেকনাফে সিঙ্গেল ডিজিটের বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে। আগের দিন দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুইশ’ দুই মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা কুতুবদিয়া গতকাল শুক্রবার ছিল বৃষ্টিহীন।
এছাড়া বিভাগের অন্যান্য এলাকার মধ্যে স›দ্বীপে ৩১, সীতাকুÐে ২১, রাঙামাটিতে ৩৫, কুমিল্লায় ৬৭, চাঁদপুরে ৬২, মাইজদীকোর্ট বা নোয়াখালীতে ৪১, ফেনীতে ৩৬, হাতিয়ায় ৩৭মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। শুক্রবার সন্ধ্যা ছয়টার পর থেকে পরবর্তী চব্বিশ ঘণ্টার জন্য আবহাওয়া অধিদপ্তরের প্রচারিত পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ঢাকা, রংপুর, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় এবং রাজশাহী, খুলনা ও বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ী দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি হতে পারে। সেইসাথে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে। সারাদেশে দিনের তাপমাত্রা সামান্য বাড়লেও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
এর আগে গত পয়লা জুলাই আবহাওয়া অধিদপ্তরে বিশেষজ্ঞ কমিটির নিয়মিত বৈঠকে জানানো হয়েছিল, চলতি বছর বিদায়ী জুন মাসে স্বাভাবিকের তুলনায় ৩৭ দশমিক সাত শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হলেও জুলাই মাসে এই অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে। জুনে স্বাভাবিক গড় হিসেবে চারশ’ ৪০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা থাকলেও অধিদপ্তরে রেকর্ড করা হয়েছে দুইশ’ ৭৩ দশমিক ৯ মিলিমিটার।
তবে স্বাভাবিক ১৮ দিনের স্থলে দেশজুড়ে বিক্ষিপ্তভাবে বৃষ্টিপাত হয়েছে মাসের ৩০ দিনই। স্বাভাবিক গড় হিসেবে জুলাই মাসে পাঁচশ’ ১৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা থাকলেও এবার তা চারশ’ ৯০ থেকে পাঁচশ’ ৭০ মিলিমিটার পর্যন্ত হতে পারে। বৃষ্টিপাতের ব্যাপ্তিকাল স্বাভাবিক হিসেবে ২২ দিন হলেও এবার তা হতে পারে ২০ থেকে ২৫ দিন।
এছাড়া জুন মাসে বৃষ্টিপাত, লঘুচাপ, কৃষি আবহাওয়া এবং দেশের নদ-নদীর অবস্থা পূর্বাভাসের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল উল্লেখ করে আরও বলা হয়, জুলাইয়ের মধ্য ও শেষভাগে মৌসুমী বায়ু দেশের ওপর প্রবলভাবে সক্রিয় হলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও বেড়ে যেতে পারে। একই কারণে ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্য আসাম এবং মেঘালয়েও যদি বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়ে, তাতে পাহাড়ি ঢলে দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদ-নদীর পানি বেড়ে গিয়ে বিপদসীমার উপরে প্রবাহিত হতে পারে। এজন্যই মাসের শেষার্ধে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মধ্যমেয়াদি বন্য পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।