‘রায়নন্দিনী’ উপন্যাসের প্রেক্ষাপট

1214

মিনহাজুল ইসলাম মাসুম

১.
আঠারশ সাতান্ন’র মহাবিপ্লবে সিপাহি জনতার পরাজয় এবং তার কিছুকাল আগে পরে শিক্ষা-দীক্ষায় মুসলিমদের নবজাগরণের সূচনা হয়। বিখ্যাত দেওবন্দ মাদ্রাসা ও আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। গঠিত হয় ‘মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটি’, ন্যাশনাল মোহামেডান এসোসিয়েশন, ঢাকায় মুসলমান সুহৃদ সম্মিলনীসহ আরো বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। নবাব আবদুল লতিফ, স্যার সৈয়দ আহমদ, বিচারপতি আমীর আলী প্রমুখ শিক্ষাব্রতীরা বাঙালী মুসলমানদের প্রগতি ও অগ্রগতির জন্য নিজের বিলিয়ে দেন। বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের মধ্যে মীর মোশাররফের হোসেনের পর অনলের মশাল হাতে কলম ধরেন সিরাজী। ‘অনল প্রবাহ’র কবি বলা হয় সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীকে। কেনই বা বলা হবে না? যার মুখ নিঃসৃত বাণীই ছিল অনলের ফুলকির মতো! মুনশী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহর এক জনসভায় আবৃত্তি করেন ছাত্রাবস্থায় রচিত ‘অনল প্রবাহ’ কবিতাটি। মুনশী মোহাম্মদ মেহেরউল্লাহ কবিতাটি শুনে মুগ্ধ হন এবং নিজ খরচে ১৯০০ সালে ‘অনল প্রবাহ’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করেন।
‘আর ঘুমিও না নয়ন মেলিয়া
উঠরে মোসলেম উঠরে জাগিয়া
আলস্য জড়তা পায়েতে ঠেলিয়া।
পূত বিভু নাম স্মরণ করি।’
(অনল প্রবাহ)
বৃটিশরা রাজশক্তি প্রমাদ গোণে। এভাবে মুক্তবুদ্ধি চর্চা স্বাভাবিকভাবে চলতে দিলে আবার বিদ্রোহ দানা বাঁধবে। তাই ইংরেজরা ‘অনল প্রবাহ’ কাব্যগ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত করেন এবং সিরাজীর প্রতি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। বাংলা সাহিত্যে ‘অনল প্রবাহ’ সর্বপ্রথম বাজেয়াপ্ত কাব্যগ্রন্থ। সিরাজী ফরাসীদের দখলীকৃত চন্দননগরে গিয়ে প্রায় ৮ মাস যাবৎ আত্মগোপন করে থাকেন। পরবর্তীতে তিনি আত্মসমর্পণ করলে বৃটিশ রাজের বিরুদ্ধে উস্কানি ও বিদ্বেষমূলক প্রচারের অভিযোগ আনা হয়। প্রহসনের বিচারে তাকে দু’বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়।
কারাগার থেকে যখন মুক্ত হন তখন তুরস্কে চলছে ব্যাপক যুদ্ধ। সিরাজী কংগ্রেস সভাপতি মুখতারসহ একদল চিকিৎসকের সাথে তুরস্কে গিয়ে যুদ্ধ করেন দেশটিকে সাহায্য করার জন্য। এই যুদ্ধে সাহস আর বীরত্ব প্রদর্শন করায় তুরস্ক সরকার তাঁকে ‘গাজি এ বলকান’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯১৩ সালে দেশে ফিরে সারাদেশ ঘুরে ইংরেজ বিরোধী অগ্নিঝরা বক্তৃতা দেয়া শুরু করেন। বৃটিশ সরকার প্রায় ৮২ বার তাঁর সভা পÐ করার জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। এরপরও তাকে থামাতে হিমশিম খান বৃটিশরা।
কবি সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী ছিলেন প্রাথমিক দিকে কাজী নজরুল ইসলামের অনুপ্রেরণা। ‘অনল প্রবাহ’র প্রেরণায় সৃষ্টি হয়েছিল নজরুলের বিখ্যাত ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যটি। ‘অনল প্রবাহ’ প্রসঙ্গে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীও বলেন, ‘একটি সুপ্ত জাতিকে কলঙ্কলিপ্ত করিতে না দেওয়া এবং ঘুমন্ত জাতিকে জাগাইয়া অতীত গৌরবের মহিমায় উদ্বুদ্ধ করিবার কঠিনতম পথে একাকী তিনি অগ্রসর হইয়াছিলেন। আমাদের তরুণ বয়সে তাঁহার ‘অনল প্রবাহ’ রক্তে রক্তে বিদ্যুতের সঞ্চার করিয়াছিল।’ (৫ মার্চ ১৯৪৬)
২.
সিরাজগঞ্জ জেলার বাণীকুঞ্জ গ্র্রামে ১৮৮০ সালে ১৩ই জুলাই সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন কবিরাজ আব্দুল করিম খন্দকার এবং মাতা নূরজাহান খানম। বাল্যে তিনি স্থানীয় মক্তব ও জ্ঞানদায়িনী মাইনর ইংরেজি স্কুলে পড়ালেখা করেন। পরবর্তীতে সিরাজগঞ্জ বনোয়ারীলাল হাই স্কুলে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। এর বেশি আর পড়েননি। পরে মক্তবে ফার্সি এবং বাড়িতে সংস্কৃত ভাষা শিখতেন। তিনি কিছু হিন্দুধর্মীয় গ্রন্থ যেমন-বেদ, মনুসংহিতা ও উপনিষদ প্রভৃতিতে বেশ পারদর্শী ছিলেন।
‘অনল প্রবাহ’ কাব্যগ্রন্থটি সিরাজীর জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। এছাড়া তিনি আরো কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। এগুলো হলো : ‘উচ্ছ¡াস’ (১৯০৭), ‘নব উদ্দীপনা’ (১৯০৭), ‘উদ্বোধন’ (১৯০৮), ‘স্পেন বিজয়কাব্য’ (১৯১৪), ‘মহাশিক্ষা কাব্য’ (প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড-১৯৬৯ ও ১৯৭১) ইত্যাদি। তাঁর পরিশীলিত চিন্তার গদ্যভাবও অত্যন্ত চমৎকার! ইসলামি চেতনা ও সভ্যতার আলোকে রচনা করেন অসংখ্য প্রবন্ধ। ‘স্ত্রী শিক্ষা’ (১৯০৭), ‘স্পেনীয় মুসলমান সভ্যতা’ (১৯০৭), ‘তুর্কী নারীজীবন’ (১৯১৩), ‘আদব-কায়দা শিক্ষা’ (১৯১৪) ও ‘সুচিন্তা’ (১৯১৪) ইত্যাদি। উপন্যাস এবং ভ্রমণ কাহিনি রচনায়ও তিনি সিদ্ধহস্ত। তাঁর উপন্যাসগুলো হলো : ‘রায়নন্দিনী’ (১৯১৫), ‘তারাবাঈ’ (১৯১৬), ‘ফিরোজা বেগম’ (১৯১৮) ও ‘নূরউদ্দীন’ (১৯১৯)। তাঁর সঙ্গীত গ্রন্থ দু’টি হলো : ‘ সঙ্গীত সঞ্জীবনী’ (১৯১৬) ও ‘প্রেমাঞ্জলি’ (১৯১৬)।
মানুষকে বলা হয় সামাজিক জীব। রাজনৈতিক জীবও কোনোভাবে কম নয়। তিনিও রাজনৈতিক সচেতন ছিলেন এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সমিতিতে সক্রিয় ছিলেন। প্রথমে কংগ্রেস, পরবর্তীতে মুসলিম লীগ, জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ, স্বরাজ পার্টি ও কৃষক সমিতি ইত্যাদি। তবে এসবের চেয়ে তাঁর চিন্তাধারায় প্যানইসলামিজমের প্রবক্তা জামাল উদ্দিন আফগানী, আল্লামা শিবলী নোমানী ও মহাকবি আল্লামা ইকবালের প্রভাব সুস্পষ্টভাবেই ফুটে উঠেছে। সিরাজীর ৫১ বছরের মধ্যে সাহিত্য সাধনা ছিল বত্রিশ বছর (মৃত্যু: ১৭ জুলাই, ১৯৩১)। তাঁর কথা ও লেখনিতে ইংরেজ দখলদারদের আজীবন বিদেশি দখলদার হিসেবেই দেখেছেন। তাঁর জ্বালাময়ী বক্তৃতায় ইংরেজরা সবসময় তটস্থ ছিল।ফলে রাজরোষ থেকে তিনি রেহাই পাননি। মুসলিম নবজাগরণের যে স্বপ্ন কৈশোরেই তাঁর দেহের রক্তকণায় আলোড়ন তুলেছিল, পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যেই তার সুফল পেতে শুরু করে উপমহাদেশবাসী বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানরা বটেই।
৩.
‘রায়নন্দিনী’ উপন্যাসে আমরা দেখতে পাই খিজিরপুরের মসনদে আলা ঈসা খাঁ অত্যন্ত ধর্মপ্রিয়, মাতৃভক্ত, সৎ, ন্যায়পরায়ণ শাসক এবং সাহসী পুরুষ। মায়ের অবাধ্য হওয়া যেমন সম্ভব নয়, তেমনি তার প্রেমকেও অস্বীকার করতে পারছে না। ঈসা খাঁর মা আয়েশা বলেন,
“আমি প্রতিমাপূজক কাফেরের কোনোও কন্যাকে কদাপি ঘরে এনে বংশ কলুষিত করবো না।… হিন্দুর নিস্তেজ রক্ত মুসলমানের রক্তে মিশ্রিত হয়ে মুসলমানকে ক্রমশ হিন্দুর ন্যায় ভীরু, কাপুরুষ, ঐক্যবিহীন, জড়োপাসক, নিবীর্য, নগণ্য জাতিতে পরিণত করবে।” (পৃ-৫২)
ভাগ্যকে খোদার ইচ্ছে কাছে সঁপে দিয়ে স্বর্ণময়ীর পত্রের জবাবে লিখল, “এক্ষণে কল্যাণময় প্রভু পরমেশ্বরের কল্যাণ বারির জন্য প্রতীক্ষা কর।…তোমাকে সম্পূর্ণ হৃদয়ের সহিত গ্রহণ করিলাম, প্রকাশ্যে অভ্যর্থনা অভিনন্দন করিতে কিঞ্চিত বাধা আছে। সে বাধা করুণাময়ের আশীর্বাদে দূরীভূত হইবে বলিয়া আশাকরি।”
পত্র শেষে আরো লিখলেন, ‘হে প্রেমময়ী! ব্যায়াম চর্চা এবং অস্ত্র সঞ্চালনায় পটুতা লাভ করিতে বিশেষ যত্ম করিবে, ঐ পটুতাই সেই বাধা দূরীকরণে বিশেষ সহায়ক হইবে।’ (পৃ-৫৫)
দুজনের মিলনে সহায়ক শক্তি ছিলো রাজা প্রতাপাদিত্যের সেনাপতি মাহতাব খাঁ। ইদিলপুরের বন থেকে স্বর্ণময়ীকে উদ্ধার করে বিশ্বস্তরূপে পরিচয় দেন ঈসা খাঁর। ঈসা খাঁও তাকে সমস্ত দায়িত্বে নিয়োজিত করে জিহাদে গমন করতে পেরেছিলেন। তিনিও মাহতাব খাঁকে উপযুক্ত প্রতিদান দেন অরুণাবতীকে সতীদাহ প্রথার অগ্নি থেকে রক্ষা করে। এ উপন্যাসে দুই জোড়া মুসলিম বীরের নিকট দুইজন হিন্দু নারী ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়। নানা বাধা মোকাবেলা করে তাদের মিলন সফল হয়।
‘রায়নন্দিনী’ সম্পর্কে যদি বলতে হয়, আসলে ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের ‘অঙ্গুরীয় বিনিময়’ (১৮৫৭) গ্রন্থে আওরঙ্গজেব কন্যা রওশন আরার সঙ্গে মারাঠা বীর শিবাজীর যে প্রণয়চিত্র এঁকেছেন কিংবা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দুর্গেশ নন্দিনী’ (১৮৬৫) উপন্যাসে মুসলিম পাঠান কন্যার সঙ্গে রাজপুত বীরের যে প্রেমের চিত্র এঁকেছেন এর জবাব কাউকে না কাউকে দিতেই হবে। এ যে ঘোরতর অপবাদ। যা শুনে চুপ থাকাও পাপ। এগিয়ে এলেন প্রতিবাদের অনল হাতে। এর কারণ সম্পর্কে তিনি ‘রায়-নন্দিনী’ উপন্যাসের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘একই দেশের অধিবাসী হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সদ্ভাব থাকা সর্বদা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাঙ্গালী ভ্রাতারা কাল্পনিক আর্যা মীর গৌরব-গানে বিভোর হইয়া কান্ডজ্ঞানহীন অবস্থায় লেখনী পরিচালনায় দারুণ অসদ্ভাবের বীজ রোপন করিতেছেন। দেশমাতৃকার কল্যাণের নিমিত্ত তাঁহাদের সাবধানতার জন্য এবং মুসলমানদের আত্মবোধ জন্মাইবার জন্যই, উপন্যাসের ঘোর বিরোধী আমি, কর্তব্যের নিদারুণ তাড়নায় ‘রায় নন্দিনী’ রচনা করিয়াছি।………. তাঁহাদের মোসলেম কুৎসাপূর্ণ জঘন্য উপন্যাসগুলির পরিবর্তন করিয়া সুমতির পরিচয় দিবেন এবং ভবিষ্যতে বীর্যপুষ্ট গৌরববিমন্ডিত আদর্শ চরিত্র অঙ্কিত করিতে চেষ্টিত হইবেন। নতুবা তাহাদের চৈতন্য উৎপাদনের জন্য আবার ঐসলামিক তেজঃদীপ্ত অপরাজেয় বজ্রমুখ লেখনী ধারণ করিতে বাধ্য হইব।’ প্রকৃতপক্ষে তিনি অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের হয়েও কতিপয় অমুসলিম লেখকের মুসলিম চরিত্র বিকৃত করার প্রতিবাদে তিনি বাধ্য হয়ে মুসলিম ঐতিহ্য ও গৌরব বিষয়ক উপন্যাস রচনা করেছেন।
রায়নন্দিনী’ সিরাজীর সেরা উপন্যাস। বাংলা সাহিত্যের সেরা উপন্যাসগুলোর মধ্যে একটি। মূলত বাংলার শ্রেষ্ঠ বারো ভূঁইয়া মসনদ এ আলা ঈসা খাঁর সঙ্গে আরেক বারো ভূঁইয়া কেদার রায়ের সুন্দরি কন্যা স্বর্ণময়ীর প্রেম এবং তার ইসলাম ধর্মগ্রহণসহ বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার রোমাঞ্চকর কাহিনি। এর মধ্যে বর্ণিত হয়েছে ধর্ম হিসেবে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব এবং জাতি হিসেবে মুসলমানদের শৌর্য-বীর্য-মহত্ত¡-উদারতার নানা সৌন্দর্যময় দিক। এক্ষেত্রে রাজা প্রতাপাদিত্যের সেনাপতি মাহতাব খাঁর উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য। স্বর্ণময়ীকে অপহরণে রাজার আদেশের বিরুদ্ধে বলেন, ‘মহারাজ! আমি মুসলমান, আমি বীরপুরুষ। তস্করের ন্যায় লুটে আনতে পারব না।ওটা দস্যুর কার্য। স্ত্রীলোকের প্রতি অত্যাচার কাপুরুষের পক্ষেই শোভা পায়।’ (পৃ-৫৯)
উপন্যাসটি তৎকালে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ও সিরাজীকে অনন্য মর্যাদায় তুলে ধরেছিল। এ উপন্যাসে ঈসা খাঁ ও মাহতাব খাঁর বীরত্বের পাশাপাশি রাজা প্রতাপাদিত্য, হেমদাকান্ত ও অভিরাম স্বামীর লাম্পট্যপনা, মা আয়েশার দৃঢ়তা ও বোন ফাতেমার শিল্পচর্চা, কেদার রায়ের মেয়ে মতের সাথে মিল ও স্বর্ণময়ীর মায়ের অমতসহ নানা চরিত্র রূপায়ন ঘটেছে। এর প্রেক্ষাপট, স্থান, কাল ও চরিত্র সব মিলে ঐতিহাসিক উপন্যাসের পর্যায়ে ফেলেছেন বিদ্বজ্জনরা। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এ উপন্যাসের স্থান অনন্য। ঔপন্যাসিক সিরাজীর অমরত্ব ও বিশিষ্টতা তাই আজ অবধি।