রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ খারিজ

15

অমল সরকার, কলকাতা থেকে

কংগ্রেস সাংসদ তথা দলের প্রাক্তন সভাপতি রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ আচমকাই খারিজ হয়ে গেল গতকাল শুক্রবার। ভারতের লোকসভার সচিবালয় দুপুরে বিজ্ঞপ্তি জারি করে এই সিদ্ধান্তের কথা জানায়।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর রাজ্য গুজরাটের সুরাট জেলার একটি আদালত গত বৃহস্পতিবার রাহুল গান্ধীকে চার বছরের পুরনো মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে দু’বছরের কারাদন্ড দেয়। কংগ্রেস নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি ‘মোদী’ পদবিধারীদের অবমাননা করেছেন। ভারতের বর্তমান জনপ্রতিনিধিত্ব আইন অনুসারে কোনো জনপ্রতিনিধির দু’বছর জেলের সাজা হলেই তাঁর সদস্যপদ খারিজ হয়ে যাবে।
লোকসভার সদস্য পদ খারিজের পর রাহুল গান্ধী বলেছেন, ‘আমার লড়াই ভোটের জন্য নয়। ভারতের ধারণা যখন ধুলোয় মিশছে, আমার লড়াইটা তখন রাজনীতির বিকল্প ধারা নির্মাণের’। তাৎপর্যপূর্ণ হল, এর আগে রাহুলের ঠাকুমা প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, মা সোনিয়ারও সাংসদ পদ খারিজ হয়েছিল ভিন্ন ভিন্ন কারণে। দু’জনেই অবশ্য রাজনীতিতে ঘুরে দাঁড়ান। এখন রাহুলের পরিণতি কী হয় সেটাই দেখার বিষয়।
প্রাক্তন এই কংগ্রেস সভাপতির সাংসদ পদ খারিজের সিদ্ধান্তের রাজনৈতিক পরিণতি কোন দিকে গড়াবে এখনই বলা মুশকিল। প্রাথমিকভাবে লক্ষণীয় হলো- কংগ্রেসের সঙ্গে দূরত্ব রেখে চলা দল আম আদমি পার্টি, সমাজবাদী পার্টি, ভারত রাষ্ট্র সমিতি এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ খারিজের সিদ্ধান্তের বিরোধিতায় মুখর হয়েছে। বেশিরভাগ বিরোধী দলই এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছে।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টুইটে লেখেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নতুন ভারতে বিরোধী নেতারাই কেবল আক্রমণের মুখে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা আলো করে রয়েছে সব অপরাধীরা। কিন্তু বিরোধীদের কথা বলতে দেওয়া হচ্ছে না। দেশের সংসদীয় গণতন্ত্র ক্রমশ নীচের দিকে যাচ্ছে’। তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় টুইটে লিখেছেন, ‘গণতান্ত্রিক ভারত এখন সোনার পাথরবাটির মতো’।
রাহুলকে নিয়ে এই বিবাদ, মামলার সূত্রপাত ‘মোদী’ পদবিকে কেন্দ্র করে। ‘মোদী’ শুধু ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পদবি নয়, সা¤প্রতিক কিছু বছরে ওই পদবিধারী বেশ কয়েকজনের নাম আলোচনায় এসেছে যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, আর্থিক নয়ছয়ের অভিযোগ আছে। কংগ্রেসের অভিযোগ, এমন বেশ কয়েকজন প্রধানমন্ত্রী মোদীর ঘনিষ্ট এবং তাঁর দ্বারা উপকৃত।
গত বৃহস্পতিবার ২০১৯ এর একটি মামলার রায় ঘোষণা করে সুরাতের আদালত। সেই বছর কর্নাটকে ভোটের প্রচারে গিয়ে রাহুল মন্তব্য করেছিলেন- ‘দেখা যাচ্ছে যাঁরাই দুর্নীতি করছেন তাঁদেরই পদবি মোদী। আইপিএলে লুট করেছিলেন ললিত মোদী। নীরব মোদী টাকা লুট করে পালিয়ে গিয়েছেন। আর যিনি তাঁকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন তিনিও একজন মোদী। দু’জনেই একই রাজ্যের’। এরপরেই গুজরাতের বিজেপির এক প্রাক্তন বিধায়ক, বর্তমান সাংসদ সুরাতের আদালতে মামলা করেন। ঘটনাচক্রে তাঁর পদবিও মোদী।
রাহুল গান্ধীর শুধু চলতি সংসদের সদস্য পদ চলে গেল তাই-ই নয়, উচ্চ আদালতে সাজার মেয়াদ না কমালে তিনি দু’বছর জেল খাটার পর আরও ছয় বছর ভোটে প্রার্থী হতে পারবেন না। এর আগে একই আইনি বিধানে বিধায়ক ও সাংসদ মিলিয়ে আরও চারজনের সদস্যপদ খারিজ হয়েছে।
তবে তাঁদের সঙ্গে রাহুল গান্ধীকে মেলালে চলবে না। দীর্ঘ ২২ বছর পর গত অক্টোবরে কংগ্রেসের সভাপতি হয়েছেন গান্ধী পরিবারের বাইরের মানুষ মলি­কার্জুন খাড়েগ। কিন্তু তাতে কংগ্রেসের অন্দরে ক্ষমতার ভারসাম্যের বিন্দুমাত্র হেরফের হয়নি। খাড়েগ সভাপতি হলেও কংগ্রেসের মুখ রাহুল গান্ধীই। তাঁর নেতৃত্বে ভারত জোড়ো যাত্রাও সফল হয়েছে বলে কংগ্রেস এবং রাজনৈতিক মহলের অনেকেরই অভিমত। আর রাহুলই কংগ্রেসের আসল নেতা বুঝে শাসক দল বিজেপিও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসাবে তাঁকেই পাখির চোখ করেছে।
বিগত প্রায় দশ দিন ভারতের সংসদে অচলাবস্থা চলছে রাহুল গান্ধী এবং শিল্পপতি গৌতম আদানির ইস্যু নিয়ে। রাহুল স¤প্রতি লন্ডনে গিয়ে অভিযোগ করেন, ‘ভারতে গণতন্ত্র বিপন্ন। এমনকী সংসদে পর্যন্ত বিরোধীদের কথা বলতে দেওয়া হয় না’।
রাহুলের এই মন্তব্যকে দেশ বিরোধী আখ্যা দিয়ে বিজেপি দাবি তুলেছে তাঁকে সংসদে দাঁড়িয়ে ক্ষমা চাইতে হবে। অন্যদিকে, কংগ্রেসের দাবি আদানি শিল্প গোষ্ঠীর সঙ্গে সরকারের বিশেষ সম্পর্কের অভিযোগ নিয়ে সংসদীয় কমিটিকে দিয়ে তদন্ত করাতে হবে। রাহুলের লন্ডনের বক্তব্যের জন্য তাঁর সদস্যপদ খারিজের দাবিও স্পিকারের কাছে পেশ করেছিল বিজেপি। সেই বিষয়ের নিষ্পত্তির আগেই মানহানির মামলার জেরে শুক্রবার রাহুল গান্ধীর সাসংদ পদ খারিজ হয়ে গেল।
রাহুল এবং কংগ্রেস এরপর কী করবে? কোন দিকে বইবে বিরোধী জোটের রাজনীতি? দ্বিতীয়টির বিষয়ে এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলা মুশকিল। রাহুলের ইস্যুতে কংগ্রেসের পাশে দাঁড়ানো আঞ্চলিক দলগুলি লোকসভা ভোটের আগে বিজেপি বিরোধী এক জোটে নাও থাকতে পারে।
তবে রাজনৈতিক মহল মনে করছে, রাহুলের পাথেয় হতে পারে তাঁর ঠাকুমা, ‘লৌহমানবী’ বলে খ্যাত প্রয়াত ইন্দিরা। গত শতকের সত্তরের দশকের মাঝামাঝি প্রথমে তাঁর নির্বাচনকে অবৈধ ঘোষণা করে এলাহাবাদ হাইকোর্ট সাংসদ পদ কেড়ে নিয়েছিল। পরে জনতা পার্টির সরকার দুর্নীতির ভুয়া অভিযোগে তাঁকে জেলে পাঠিয়ে নিজেদেরই পায়ে কুড়াল মারে। ১৯৭৭ সালে ক্ষমতায় এসে তিন বছরের মাথায় ছত্রখান হয়ে যায় জনতা পার্টির সরকার। ফের দিল্লির কুর্সিতে বসেন ইন্দিরা। ১৯৮০- তে তাঁর ক্ষমতায় ফেরার পিছনে মহৌষধের মতো কাজ করেছিল জনতা সরকারের তাঁকে জেলে পোরার সিদ্ধান্ত। সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সারা দেশে সহানুভ‚তির ঢেউ উঠেছিল ইন্দিরার পক্ষে। জেল থেকে বেরিয়ে ছন্নছাড়া দলকে গোছাতে দেশের নানা প্রান্তে ছুটেছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী।
অন্যদিকে, রাহুলের মা তথা আর এক প্রাক্তন কংগ্রেস সভাপতি সোনিয়া গান্ধীর সাংসদ পদ মাঝপথে খারিজ হয়েছিল প্রশাসনিক কারণে। তিনি লাভদায়ক একটি পদে থাকায় তাঁকে সাংসদ পদে ইস্তফা দিতে হয়। নতুন নির্বাচনে জিতে তিনি ফের সংসদে ফেরেন।
অনেকেই মনে করছেন, ভারতের শাসক দল যেভাবে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে রাহুল গান্ধীকে উচ্চ আদালতে যেতে না দিয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সাংসদ পদ খারিজের ব্যবস্থা করেছে তাতে প্রয়াত ইন্দিরার মতো তাঁর নাতির পক্ষেও সহানুভূতির ঢেউ উঠতে পারে। তবে সবটাই নির্ভর করবে রাহুল এবং কংগেস বর্তমান পরিস্থিতিকে নিজেদের পক্ষে কতটা কাজে লাগাতে পারবে নরেন্দ্র মোদী ও বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে তার উপর।